দেশজুড়ে

চোখের আলো চলে গেল একই পরিবারের ৫ জনের

স্বাভাবিকভাবেই জন্ম হয়েছিল তাদের। দুরন্ত শৈশব-কৈশোরের গণ্ডি পেরিয়ে সমাজের আর দশজনের মতো তারাও স্বপ্ন দেখেছিলেন সুন্দর সাজানো-গোছানো একটা জীবনের। কিন্তু সেই স্বপ্ন কারোরই পূরণ হয়নি। নিভে গেছে স্বপ্ন, থেমে গেছে উচ্ছ্বাস।

Advertisement

দুঃসহ মানবেতর জীবন সংগ্রামে এখন বেঁচে থাকাটাই যেন কঠিন হয়ে পড়েছে রংপুর নগরীর ১নং ওয়ার্ডের পূর্ব রণচন্ডি ডাক্তারপাড়ার মৃত শহিদার রহমানের দুই ছেলে, এক মেয়ে, বোন ও বৃদ্ধা মায়ের।

অমোঘ নিয়তি একে একে কেঁড়ে নিয়েছে শহিদার রহমানের বড় ছেলে আব্দুল আহাদ (৩৫), ছোট ছেলে আনিছুল হক (২৮), মেয়ে শাহনাজ পারভীন (২২), মা মর্জিনা বেওয়া (৭৫) ও বোন হোসনে আরার (৩৮) চোখের আলো।

ওই এলাকার ওসমান গণির ৩ ছেলের মধ্যে দিনমজুর শহিদার ছিলেন সবার বড়। ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মারা যান শহিদার।

Advertisement

চোখের আলো থাকতে ২০০৮ সালে মর্জিনা বেওয়ার মেয়ে হোসনে আরার বিয়ে হয় পানাপুকুর এলাকার আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। দুই মাসের সংসার যেতে না যেতেই এক চোখের আলো নিভে যায় হোসনে আরার। অন্ধত্বের কারণে সংসার টেকেনি তার। ফিরে আসতে হয় মায়ের কাছে।

মা মর্জিনা বেগমও (৭৫) অন্ধ হয়ে গেছেন। লাঠিতে ভর করে অন্যের সহায়তায় পথ চলেন। বাধ্য হয়ে স্থানীয় আকিজ কোম্পানির বিড়ি ফ্যাক্টরিতে স্বামী পরিত্যক্তা হোসনে আরা শ্রমিকের চাকরি নেন। অন্যের সহায়তায় সেখানে গিয়ে কাজ করেন।

উচ্চতায় সাত ফিট লম্বা আব্দুল আহাদ ২০০১ সালে স্থানীয় জাফরগঞ্জ ফাজিল মাদরাসা থেকে দাখিল ও ২০০৩ সালে আলিম এবং ২০০৫ সালে ফাজিল পাস করেন।

২০০৭ সালে রংপুর ধাপসাতগাড়া কামিল মাদরাসা থেকে কামিল পাস করার পাশাপাশি কারমাইকেল কলেজ থেকে তিনি স্নাতক পাস করেন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া আহাদ নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতেন অন্যের বাসাবাড়িতে টিউশনি করে। পড়ালেখা শেষেও টিউশনি করেই চলছিল তার সংসার। এরই মধ্যে বিয়ে করেন। সংসার আলো করে আসে মাহফুজা খাতুন নামে এক সন্তান।

Advertisement

টিউশনির পাশাপাশি ২০০৭ সালে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন মন্থনা মণ্ডলপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে নিজেকে মেলে ধরাই ছিল তার লক্ষ। সেই লক্ষে এগোতেও থাকেন তিনি। কিন্তু ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর হঠাৎই আব্দুল আহাদের চোখের আলো নিভে যেতে থাকে। সেই দিন থেকেই স্কুল থেকে অঘোষিত ছুটি হয়ে যায় তার।

চোখ থেকে আলো নিভে যাওয়ার সেই দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরে আহাদ জানান, ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর আমার জীবনের আলো নিভে যাওয়ার দিন। ওই দিন স্কুলে থাকার সময় হঠাৎ করেই আমার ডান চোখের আলো চলে যেতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে আমি ঢাকার বারডেমসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করাই। কিন্তু ডান চোখে আলো আর আসেনি।

চিকিৎসক বলেছেন, এটি বংশীয় গ্লুকোমা রোগ। এটা ভালো হওয়ার মতো নয়। এরপর বাম চেখের আলোও কয়েক মাস পর চলে যায়। এখন আমি পুরোপুরি দৃষ্টিহীন। অনেক কষ্টে অর্জন করা শিক্ষা এখন আর আমি অন্য কাউকে বিলিয়ে দিতে পারছি না। স্কুল থেকেও বিদায় নিতে হয়েছে। এখন স্ত্রী মারুফা বেগম ও মেয়ে মাহফুজা খাতুনের হাত ধরেই পথ চলি। স্ত্রীর সেলাই মেশিন দিয়ে করা আয়েই কোনো রকমে চলছে আমার সংসার। সবই ছিল আমার, এখন কিছুই নেই। চোখের চিকিৎসাও আর করাতে পারছি না। হয়তো এ সুন্দর পৃথিবীকে আর দেখতে পারবো না।

আব্দুল আহাদের ছোট ভাই আনিছুল ইসলাম প্রাথমিকের গণ্ডি পাড়ি দিতে পারেননি। ২০০৯ সালে ঢাকায় একটি প্যাকেজিং কোম্পানিতে সামান্য বেতনে চাকরি শুরু করেন আনিছুল। সেই টাকার কিছু অংশ বাড়িতে, কিছু অংশ নিজে খরচ করে ভালোই চলছিল তার জীবন।

দুই বছর যেতে না যেতেই ২০১১ সালে আনিছুলের চোখের পর্দায় নেমে আসে কালো মেঘ। নিভে যেতে থকে দুই চোখের স্বপ্ন। চাকরিরত অবস্থায় দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায় তার। কোম্পানির লোকজনের সহায়তায় শূন্য হাতে ফিরে আসেন বাড়িতে। এখন মায়ের আঁচলই আনিছুলের ঠিকানা। যে আনিছুল একটা সময় একাই গ্রামের মেঠোপথ চষে বেড়াতেন সেই আনিছুল এখন অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না।

প্রায় সাত ফিট লম্বা আনিছুলের চোখে এখন ঘোর অমানিশা। কষ্টের জীবনে একজন সঙ্গী পেরে ২০১৩ সালে বিয়েও করেছিলেন আনিছুল। কিন্তু বেশি দিন থাকেননি স্ত্রী। এক বছরের মাথায় ভেঙে যায় আনিছুলের সংসার। বর্তমানে চোখের আলো হারানো কর্মহীন আনিছুলের দিন কাটে বাড়িতে বসে। সামর্থ্যবান এ যুবক এখন কর্মহীন। কেউ তাকে কাজে নেয় না। তার চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্যও নেই পরিবারের।

আহাদ ও আনিছুলের ছোট বোন শাহানাজ পারভীন (২০)। উচ্চতায় ছয় ফিট ৫ ইঞ্চি শাহানাজেরও পাড়ার অন্য মেয়েদের মতো দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল। ছিল স্বামী, সংসার, সন্তানকে নিয়ে সাজানো-গোছানো একটা সুন্দর জীবনের।

স্থানীয় হরকলি ফাজিল মাদরাসা থেকে ২০১২ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করলেও দাখিল পরীক্ষা দেয়া হয়নি তার। পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময় তার চোখের আলো নিভে যেতে থাকে। এখন তিনিও দৃষ্টিহীন। পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতেই বসে থাকেন সব সময়। বাবা নেই, বড় দুই ভাই দৃষ্টিহীন। বয়স হলেও দৃষ্টিহীনতার কারণে কোথায়ও বিয়ে দিতে পারছে না তার পরিবার।

আহাদ, আনিছুল ও শাহনাজের মা রমিছা বেগম বলেন, আমার চার সন্তানের মধ্যে এখন ছোট ছেলে শরিফুল ইসলামের (২০) চোখই ভালো আছে। সে ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। ঘরে আমার দৃষ্টিহীন বিবাহযোগ্য মেয়ে। একমাত্র ভালো থাকা ছেলের আয় এবং অন্যের বাড়িতে কাজ করে পাওয়া আমার আয় দিয়েই সংসার চালাতে হচ্ছে। এদের ভালো চিকিৎসা করার সামর্থ্য নেই। তিন বেলা খাবো সেই সামর্থ্যই নেই। মেয়েটাকে বিয়ে দেই কীভাবে?

জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে হাঁফিয়ে উঠেছেন রমিছা। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার কর্মঠ, মেধাবী ছেলে মেয়েরা তো এ রকম ছিল না। তারা সমাজে সবার কাছে প্রিয় ছিল। এখন দৃষ্টিহীনতার কারণে তারা একঘরে হয়ে গেছে। আমি কী করবো ভেবে পাই না। আল্লাহর ওপর ভরসা করেই ওদের নিয়ে পথ চলছি। বিত্তবান মানুষ এবং সরকারের কাছে দৃষ্টিহীন তিন ছেলেমেয়ের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানিয়েছেন তিনি।

স্থানীয় মাহবুবুল ও আবদুল হক জানান, বর্তমানে এ পরিবারের পাঁচজন সদস্য দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে খুব কষ্টে জীবনযাপন করছেন। এটা তাদের বংশগত রোগ। তাদের বাড়িভিটে ছাড়া আর কিছু নেই। এলাকার বিভিন্ন লোকজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এ পরিবারকে মাঝে মধ্যে কিছু আর্থিক সহযোগিতা দেয়, সেটা দিয়েই কোনো রকমে তাদের সংসার চলছে।

মাদরাসা শিক্ষক হাসান আলী জানান, ওই পরিবারের পাঁচ সদস্য আগে ভালোই ছিলেন। হঠাৎ করেই তারা অন্ধ হয়ে গেছেন। টাকার অভাবে তাদের চিকিৎসাও হচ্ছে না। খেয়ে না খেয়ে সংসার চলছে তাদের। বিশেষ করে শাহনাজ পারভীনের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। ওই মেয়েটিকে নিয়ে ওর মা খুব চিন্তিত অবস্থায় আছেন। সরকার ও বিত্তবানরা তাদের পাশে দাঁড়ালে একটি সুন্দর পরিবারে হয়তো আবারও হাসি ফিরে আসতে পারে।

সংশ্লিষ্ট ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম জানান, সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রাপ্ত প্রতিবন্ধী কোটা থেকে আব্দুল আহাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগামীতে কোনো সুযোগ পেলে ওই পরিবারটিকে সহায়তা করা হবে। তবে সামান্য ভাতা দিয়ে তাদের স্বচ্ছলতা ফেরানো সম্ভব না। এজন্য সমাজের বিত্তবান মানুষের এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান তিনি।

রংপুরের বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন অধ্যাপক মো. মোখলেছুর রহমান জানান, রেটিনাইটিস বিগমেন্টটোসা নামে একটি বংশজনিত ডিজিজ আছে চোখের। এটা বংশানুক্রমে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ট্রান্সলেট হয়। এ রোগটির বংশবাহকেরা যুবক বয়সে মোটামুটি চোখে দেখতে পান। কিন্তু পরে তারা আর চোখে দেখতে পান না। ওই পাঁচ ব্যক্তির দৃষ্টিহীনতা যদি বংশানুক্রমিক হয়, তাহলে তাদের চোখে আলো ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আর যদি অন্য রোগ হয় তাহলে তাদের চিকিৎসা করানা যেতে পারে। পরিবারটি যেহেতু দরিদ্র। সরকার কিংবা বিত্তবানরা যদি তাদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে চিকিৎসার বিষয়ে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

জিতু কবীর/এমএএস/জেআইএম