মতামত

স্বপ্নের বীজ বুনে দিলো কোমলমতি শিক্ষার্থীরা

‘রাষ্ট্র সংস্কার কাজ চলিতেছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’- ছোট্ট এক স্কুলছাত্রের হাতে ধরা পোস্টার। সেই পোস্টারের ভাষা এটি। এতটুকুন বয়সে ছোট্ট শিশুটির ‘রাষ্ট্র’ কি জিনিস, সেটিই তো বোঝার কথা নয়! তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া গেলো, আন্দোলনকারীরা হয়তো কোমলমতি এই শিশুর হাতে পোস্টারটি ধরিয়ে দিয়েছে। তবে সেই আন্দোলনকারীরাও তো বড়জোর কিশোর। কৈশোরের বাধা অধিকাংশই পার হতে পারেনি এখনও; কিন্তু এই বয়সেই ঘুণে ধরা রাষ্ট্রটাকে তারা যেভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল হয়ে থাকবে।

Advertisement

সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুরনো সব জঞ্জাল ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়ার লক্ষ্য নিয়েই সারা দেশের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা নেমে এসেছে রাস্তায়। তারা বিচার চায়, আইনের প্রতিষ্ঠা চায়। বিশৃঙ্খল সমাজকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে চায়। জোর করে হলেও তারা এই দেশের বিশৃঙ্খল মানুষকে ‘শৃঙ্খলা শেখাতে’ চায়।

রাজধানীর বিমান বন্দর সড়কে ‘জাবালে নূর’ বাস নামক দুটি বাসের রেষারেষির ফলে অকালে ঝরে যাওয়া রাজীব এবং মিম নামে দুই কোমলমতি কিশোর-কিশোরীর রক্তের ওপর গড়ে উঠেছে এই আন্দোলন। দাবানলের মত যেটা ছড়িয়ে দিয়েছে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির দায়িত্বহীন মন্তব্য এবং আচরণ।

বাস অ্যাকসিডেন্টকে ‘দুর্ঘটনা’ বলে কোনোভাবেই এই হত্যাকাণ্ডকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। নিহত রাজীব এবং মিমকে খুন করা হয়েছে। নিয়ম না মেনে গাড়ী চালানোর কারণে খুন হতে হলো শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেছের এই দুই শিক্ষার্থী। প্রতিদিনই এভাবে সারাদেশে বাস, ট্রাকসহ গাড়ীগুলোর বেপরোয়া গতি, প্রতিযোগিতা, দায়িত্বহীনতা, রেষারেষিতে অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। দুই বাসের রেষারেষিতে সার্ক ফোয়ারার সামনে হাত হারিয়েছিলেন রাজীব। পরে পৃথিবী থেকেই হারিয়ে যান তিনি।

Advertisement

একই সময় বেপরোয়া গতির কারণে প্রাণ হারান আরও এক নারীসহ বেশ কয়েকজন। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে দুই বাসের রেষারেষিতে প্রাণ হারাণ একটি জনপ্রিয় অনলাইনের বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি। রংপুর অঞ্চলে ট্রাফিক পুলিশের খামখেয়ালিপনায় ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান একজন ডাক্তার। মিম-রাজীব নিহত হওয়ার আগের সপ্তাহেই কুমিল্লা অঞ্চলে হানিফ বাসের ড্রাইভার, সুপারভাইজার এবং কনডাক্টর মিলে আহত সাইদুর রহমান পায়েলকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। কতটা অমানবিক আর নৃশংস হলে এমন কাজ করতে পারে বাস ড্রাইভার আর হেলপাররা?

সুতরাং, বিমানবন্দর সড়কে রাজীব-মিম নিহত হওয়ার পর যখন দোষীদের বিচার দাবি করছিল তার সহপাঠীরা এবং শোকের সাগর যখন প্রবাহিত হচ্ছিল অন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে, তখন দায়িত্বশীল, প্রভাবশালী সেই ব্যক্তির দায়িত্বহীন বক্তব্য এবং আচরণ আগুন জ্বালিয়ে দিলো। মুহূর্তেই শোক পরিণত হলো শক্তিতে। রুখে দাঁড়ানোর শপথ নিয়ে পরদিন দলে দলে রাস্তায় নেমে এলো রাজধানী ঢাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা জানে, এভাবে রুখে না দাঁড়ালে আরও অনেক রাজীব-মিমকে অকালে প্রাণ হারাতে হবে। নিরাপদ সড়ক, দোষীদের শাস্তি, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোসহ- মোট ৯টি দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।

সবকিছু ভালোই চলছিল; কিন্তু সবার ধারণা বদলে দিয়ে, মুগ্ধতার সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার যে কাজটি ছোট ছোট এই শিশু-কিশোররা করে দেখালো তা সত্যিই অভাবনীয়। নতুন এক ইতিহাস রচিত হলো তাদের হাত ধরে। তাদের সৃষ্টি করা উদাহরণ দেখে এখন এই সোনার বাংলাদেশ নিয়ে আবারও স্বপ্নের জাল বোনা শুরু করে দিতে পারি। এই দেশটির সামনে যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হাতছানি দিয়ে ডাকছে, সেটা নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যায় এখন।

আন্দোলনের ৫দিন পার হয়ে গেছে। এই ৫দিনে যা করেছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা, সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। এই দেশটি তো পরিণত হয়েছে মৃত্যু উপত্যকায়। দুর্নীতি আর অনিয়মই যেখানে নিয়ম, যেখানে ব্যাংকের ভল্টে সোনা রাখলে হয়ে যায় ধাতব পদার্থ, যেখানে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, যেখানে পথে-ঘাটে খুনের মহোৎসব চলে, যেখানে নারীরা রাস্তায় বের হলে সম্ভ্রম নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবে কি না তার নিশ্চয়তা থাকে না, যেখানে তিন মাসের শিশুকেও ধর্ষণের শিকার হতে হয়, যেখানে হায়েনার অট্টহাসিতে প্রকম্পিত পুরোটা দেশ, খুন-গুম, হত্যা-সন্ত্রাস যেখানে নিয়ত নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এই দেশটি নিয়ে স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা কারও হওয়ার কথা নয়।

Advertisement

পরিচিত অনেককেই দেখছি, একটু সামর্থ্য থাকলেই পরিবার এবং সন্তানদের নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। নিজেরা যেতে না পারলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন আদরের সন্তানকে। কোনো কিছু করতে না পারলে হা-হুতাশই ঝরে পড়ে অন্য সবার কণ্ঠ থেকে।

দুঃশ্চিন্তা প্রতিনিয়ত আচ্ছন্ন করে রেখেছে প্রতিটি নাগরিকের হৃদয়। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। যেভাবে পুরো সমাজে মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে, স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থীর কথা শোনা যায়- যারা ইয়াবায় আসক্ত, নোংরা রাজনীতির কালো ছায়ার করাল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে, তাতে কোমলমতি উঠতি শিশুদের কিভাবে এসব পঙ্কিলতা থেকে দুরে রাখা যাবে সে চিন্তায় অস্থির প্রতিটি বাবা-মা।

শুধু তাই নয়, অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা যখন পুরো রাষ্ট্র এবং সমাজকে গিলে ফেলেছে, তখন এই সমাজের অচলায়তন ভেঙে সংস্কারের আওয়াজ তোলার বড় একটা প্রয়োজন ছিল। দিশাহীন এই সমাজ এবং রাষ্ট্রকে আলোর দিশা দেখানোর খুব প্রয়োজন ছিল। সচেতন মানুষ মাত্রই এই প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছিল অনেক বেশি।

কিন্তু কে তুলবে সেই আওয়াজ? কে বাজাবে পরিবর্তনের বাঁশি? অচলায়তনের শৃঙ্খল ভেঙে কে জাগিয়ে তুলবে এই ঘুমন্ত জাতিকে? হায়েনার হিংস্র দন্ত্যশূল উপেক্ষা করে সেই মহান কাজটি করার জন্য কে এগিয়ে আসবে? এই সমাজ তো এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আপনি একটি ভালো কথা বলতে যাবেন, দশটি অশুভ হাত এসে আপনাকে চেপে ধরবে। আপনাকে থামিয়ে দেবে। তাও যদি না হয়, তাহলে আপনাকে গুম করে দেবে। আপনি নিখোঁজ হয়ে যাবেন। ভাগ্য খুব বেশি ভালো হলো কিছুদিন পর আপনার পরিবার লাশটি হয়তো পেতে পারে। অনেকের তো লাশই পাওয়া যায় না। চিরদিনের মত হারিয়ে যাচ্ছে।

সুতরাং, ঘুণে ধরা এই সমাজকে ঝাঁকুনি দেয়ার কাজটি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেউ করতে এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না; কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তো একজন আছেন। যার অসীম ক্ষমতার ওপর বিশ্বাসী বলেই আমরা ইমানদার। নিহত রাজীব-মিমের রক্ত মাখা শার্ট আর জুতা হাতে শপথের বলে বলিয়ান হয়ে তাদের সহপাঠীরা যে আন্দোলন নিয়ে মাঠে নেমে এসেছে, সেটাই পরিণত হলো সমাজের অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর এক সংস্কারমূলক আন্দোলনে।

যে কাজটি করার কথা ছিল এই দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের। যে কাজটি করার কথা ছিল এ দেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার। যে কাজটি করার কথা ছিল এ দেশের আইন প্রনয়ণকারীদের। যে কাজটি করার কথা ছিল এ দেশের রাজনীতিবীদদের, সে কাজটি তারা গত ৪৪-৪৫ বছরেও করে দেখাতে পারেনি। করার ইচ্ছাও কখনো করেনি।

অথচ সে কাজটাই করে দেখিয়ে দিলো কোমলমতি শিশু-কিশোররা। সহপাঠী হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন হয়তো খুব বেশি লম্বা হবে না। নানা রাজনৈতিক তৎপরতায় খুব দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে; কিন্তু এই চার-পাঁচদিনে শৃঙ্খলার যে দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করে যাচ্ছে তা এ দেশের মানুষের চিরকাল মনে থাকবে।

শিশু-কিশোররা দায়িত্ব নিয়েছে মানুষকে শৃঙ্খলা শেখানোর। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে তারা। শিশু-কিশোরদের হাতে রাস্তায় অভাবনীয় শৃঙ্খলা ফিরে এলো। অবৈধ ও লাইসেন্সবিহীন, অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক এবং রং সাইডে চলাচল- এসব ঠিক করতে দু’দিনের জন্য দায়িত্বটা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে কোমলমতি এইসব শিক্ষার্থীরা। তাদের কোমল-কঠোর মনোভাব থেকে রেহাই মেলেনি প্রশাসন, রাজনীতিবীদ, বিচারক, মন্ত্রী, এমপি থেকে পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা অনেকের।

পুলিশকে পর্যন্ত লাইসেন্স না থাকার কারণে মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। রং সাইডে আসার কারণে মন্ত্রীর গাড়ী পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। লাইসেন্সবিহীন গাড়ী যে কত শত রাস্তায় চলে এবং এসব গাড়ীকে চলাচলে সহযোগিতা করে ট্রাফিক পুলিশ তার প্রমাণ মিললো স্কুল-কলেজের এসব শিক্ষার্থীদের নিজ হাতে তুলে নেয়া দায়িত্বের কারণে। আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে আইনকে সহযোগিতা করার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো তারা। লাইসেন্স বিহীন চালকদের পাকড়াও করে ট্রাফিক সার্জেন্টের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছে ছাত্ররা। এমনকি লাইসেন্সবিহীন পুলিশকে পর্যন্ত ছাড় দেয়নি তারা। ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে।

অহিংস আন্দোলন হয়তো কখনও কখনও ভুল পথে পরিচালিত হয়েছিল। যে কারণে দু’একটি গাড়ির গ্লাস ভাঙচুর হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা শিখিয়ে দিয়ে গেছে, দিন শেষে কিভাবে রাস্তার জঞ্জাল সরিয়ে রাখতে হয়। নিজেরাই ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করে দিয়েছে। এই আন্দোলনে হয়তো সাধারণ মানুষের সাময়িক কষ্ট হয়েছে। তবে অসুস্থ, বয়স্ক, নারী এবং রোগীবহনকারী গাড়ীগুলোকে নিজেদের দায়িত্বে তারা রাস্তা পার করে দিয়েছে। দিয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা।

রাজপথে গাড়িকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে চলতে বাধ্য করেছে। বিশৃঙ্খল হতে দেয়নি। রিক্সা, বাস, প্রাইভেট গাড়ির জন্য আলাদা আলাদা লেন তৈরি করেছে এবং এই প্রথম বাংলাদেশের মানুষ জানলো, অ্যাম্বুলেন্সের জন্যও আলাদা একটি লেন থাকে। যেটা দিয়ে জরুরিভাবে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, পথচারী মানুষকে সু-শৃঙ্খলভাবে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার শৃঙ্খলাও শিখিয়েছে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা।

ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের হাতে ধরা পোস্টার-প্ল্যাকার্ডে ধরা স্লোগানগুলোও ছিল এই সমাজের জঞ্জাল পরিস্কার এক একটি দারুণ বার্তা। দুটি শিশু পাশাপাশি দাঁড়ানো দুটি পোস্টার নিয়ে। একজনের পোস্টারে লেখা, ‘পুলিশ আঙ্কেল আপনার চা-সিগারেটের টাকা আমি আমার টিফিনের টাকা দিয়ে দিচ্ছি, তাও আপনি এসব গাড়ি চালাতে দিয়েন না।’ পাশে দাঁড়ানো শিশুটির হাতে ধরা পোস্টারে লেখা, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’

আরেকটি শিশুর হাতে লেখা ছোট্ট ফেস্টুন, ‘বাস মামা আস্তে চালাও। মরে গেলে মা কাঁদবে...।’ এসব দেখলে পাষানের হৃদয়ও তো গলে যাওয়ার কথা। আমাদের দায়িত্বশীলদের কী সত্যি সত্যি হৃদয়ে কোনো দাগ কাটে? একটি পোস্টারে শক্তিশালী একটি বক্তব্য লেখা। যা ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রদের আপাতত রাস্তা সামলাতে দিন। মন্ত্রী-পুলিশকে স্কুলে পাঠান শিক্ষিত করতে। উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ একজনের পোস্টারে লেখা, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ নয়, নিরাপদ বাংলাদেশ চাই।’ অন্য একটি পোস্টারে লেখা, ‘৪জি স্পিডে নেটওয়ার্ক নয়, ৪জি স্পিডে বিচার চাই।’

বৈধ লাইসেন্স নিয়ে গাড়ী চালাতে হবে। অবৈধ ড্রাইভারদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে অকাতরে প্রাণ হারায় মানুষ। দায়িত্বশীলদের কর্ণকুহরেও সেই বক্তব্য পৌঁছে দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ছোট্ট এক শিশুর হাতে ধরা একটি ফেস্টুনে লেখা, ‘মন্ত্রী সাহেব! আপনার গাড়ির লাইসেন্স আছে তো?’

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার গাড়ীতে লিখে দেয়া হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী, লাইসেন্স কোথায়?’ বিচারপতির গাড়ীতেও লিখে দেয়া হয়েছে, ‘বিচারপতি লাইসেন্স কোথায়?’ পোস্টার নিয়ে রাস্তায় নেমেছে নিহত সাংবাদিক সাগর-রুনির ছেলে মেঘও। মেঘের হাতে ধরা পোস্টারে লেখা, ‘নিরাপদ সড়ক চাই, বাস চাপায় নিহত আপু-ভাইয়াদের খুনের বিচার চাই। ছোটদের জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ চাই। আমার মিম্মি-বাবার (সাগর-রুনি) খুনে বিচার চাই। উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’

তবে যে পোস্টারটি আন্দোলনকারীদের রক্ত টগবগ করে ফুটিয়ে দিয়েছে, সেই শক্তিশালী স্লোগানটি হচ্ছে, ‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ। যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমিই বাংলাদেশ।’ রুখে দাঁড়ানোর এই মন্ত্রই পুঁতে গিয়েছে কোমলমতি স্কুল-কলেজের শিশু-কিশোরদের হৃদয়ে। তারা রাষ্ট্রের সমস্ত জঞ্জাল না সরানো পর্যন্ত ক্ষান্ত দেবে না।

নিজ চোখে দেখেছি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম। তাতে বরং বিরক্তির উদ্রেক হয়নি। গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছে। এ দেশের মানুষ এতদিন জানতো আন্দোলন করে কেবল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রয়োজনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নামতে পারে, সেটাও দেখা গেছে। চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার প্রতিবাদে সর্বস্তরের ছাত্রসমাজকেও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন করতে দেখা গেছে।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। কিন্তু ঘুণে ধরা, অনিয়ম-অবিচার আর বিশৃঙ্খল একটি সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়ে এই সমাজের বিশৃঙ্খল মানুষগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে শৃঙ্খলা শিখিয়ে গেলো স্কুল আর কলেজের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা। ছোটদের কাছ থেকে শিখছে পুরো দেশ, পুরো রাষ্ট্র।

একইসঙ্গে স্বপ্ন দেখতে পারি আমরা ভবিষ্যতের জন্যও। ১০ থেকে ২০ বছর বয়সী এই শিশু-কিশোররাই আগামী দিনের বাংলাদেশ। তারা স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেলে ভর্তি হবে। কেউ রাজনীতি করবে, কেউ ব্যবসা করবে। কেউ আমলা হবে, কেউ ব্যাংকার হবে। আবার কেউ হবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

কেউ নিজ দেশের প্রতিনিধি হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবে। কিন্তু যে সংস্কারের দাবানল তাদের হৃদয়ে ছড়িয়েছে, অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে শিক্ষা তারা নিয়ে যাচ্ছে, সেই শিক্ষাই আগামী দিনে বাংলাদেশকে পরিচালিত করবে সঠিক এবং সুশৃঙ্খল পথে। সব পাপ-পঙ্কিলতার অবসান ঘটিয়ে একদিন আবার ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে শান্তি এবং সমৃদ্ধির।

রাত যত গভীর হয়, ভোর তত এগিয়ে আসে। এই কোমলমতি শিশু-কিশোরদের হাত ধরেই একদিন ভোরের সূর্য উদয় হবে। একদিন উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে পুরো বাংলাদেশ। এদের নিয়ে স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি। দেখার সাহস তো তৈরি করে দিয়েছে তারাই...!

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম