মতামত

এবার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিখি

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার দাবিতে বাংলাদেশে এর আগেও অনেক আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু এবারের আন্দোলনটি ছিল একেবারে ব্যতিক্রম, যা আলোড়ন তুলেছে কোটি মানুষের হৃদয়ে। স্কুল-কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ইউনিফর্ম পরে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে। তারা দলবেঁধে রাস্তায় যানবাহন চালকদের কাছ থেকে লাইসেন্স দেখতে চেয়েছে। রিকশা ও গাড়ি চলাচলের জন্য পৃথক লেন রেখেছে। আবার অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের মত জরুরি সেবাদানকারী সংস্থার গাড়ি যাওয়ার জন্য আলাদা লেন করেছে। রাস্তায় এসব শিক্ষার্থী তাদের নিজেদের নাগরিকবোধ থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে এসেছে। তাদের আন্দোলন এত আলোড়ন তুললো কেন? উত্তর একটাই- তাদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা উন্মোচিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ঘটে যাওয়া একাধিক সড়ক দুর্ঘটনার ফল এই আন্দোলন। এসব দুর্ঘটনায় অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে, কত মানুষ যে প্রতিবন্ধী হয়েছে তার হিসাব নেই।

Advertisement

পুঁজিবাদী সমাজের একটি অবশ্যম্ভাবী ফল হলো অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সম্প্রতি যে সড়ক দুর্ঘটনাগুলো আমরা দেখছি, সেগুলোর বেশিরভাগই সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির বাসগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে। তারা একে অপরকে ওভারটেক করে গাড়ি চালায় প্রতিনিয়ত। মানুষের জীবনের যেন কোন মূল্য নেই তাদের কাছে। চালকরা এত উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস পায় কী করে? এর কারণ হলো- সরকারের কিছু দায়িত্বশীল মানুষের সাথে বাস মালিকদের সম্পর্ক আছে, যারা চালকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হলেও তারা চালকদের বেতন কম দেন। ফলে বিভিন্ন কোম্পানির চালকরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে বেশি যাত্রী তোলার জন্য। গাড়ির ফিটনেস আছে কিনা, চালক ঠিকমতো গাড়ি চালাতে পারে কিনা, সে পরীক্ষা না করেই তারা রাস্তায় গাড়ি চালাতে নেমে যায়। কোন দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে তাদেরকে যখন আইনের আওতায় আনা হয়, তখন তারা নিজেদের শক্তির জানান দেয় অবরোধ করে পুরো দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে। তারা যেন আইনের ঊর্ধ্বে। তাদের ভুল হতেই পারে। শাস্তির চিন্তা মাথায় নিয়ে তারা গাড়ি চালাতে পারবে না।

আবার রাষ্ট্রে সুষ্ঠু জবাবদিহিতার অভাব এবং আইন অমান্য করার প্রবণতাও এসব দুর্ঘটনার কারণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আমরা দেখেছি, সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত অনেকের গাড়িতেই লাইসেন্স নেই। আবার যাদের আছে তাদের অনেকেরই লাইসেন্সের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। যারা আইনশৃঙ্খলার প্রয়োগ নিশ্চিত করবেন; তারাই যখন আইন অমান্য করেন তার প্রভাব পড়ে বাসমালিক ও চালকদের উপর। তারা হয়ে ওঠে আরও বেপরোয়া। কিন্তু কোন সুস্থ রাষ্ট্রযন্ত্র এভাবে চলতে পারে না। কিছু দুবৃর্ত্তের কাছে রাষ্ট্র জিম্মি থাকবে, তা কখনোই কাম্য নয়। তাই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। সর্বস্তরে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে সুষ্ঠু জবাবদিহিতা। যারা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী থাকবে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাধ্য করতে হবে। জীবন বাঁচানোর জন্য না হোক, অন্তত টাকা বাঁচানোর জন্য তারা দায়িত্বশীল হতে বাধ্য হবে। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। সরকারি পর্যায়ে যাদের নিজেদের স্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থ পরিবহন ব্যবসার সাথে জড়িত তারা যেন এখানে জড়িত থাকতে না পারে।

দুর্নীতিমুক্ত প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান সড়কপথ নির্মাণ ও মেরামত নিশ্চিত করতে হবে। ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকদের নিষিদ্ধ ও শাস্তি প্রদানের বিধান চালু করতে হবে। ক্রটিযুক্ত ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ করতে হবে; এ বিষয়ে ব্যর্থ বা অনাগ্রহী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকামুখী ব্যবসা-বাণিজ্য কমাতে হবে এবং দেশের অন্যান্য জেলাতে শিল্প কলকারখানা গড়ে তুলতে হবে। সেইসাথে রেল ও নৌ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করতে হবে এবং সড়ক নির্ভরতা কমাতে হবে। পথচারীদের জন্য ফুটপাত রাখতে হবে। ফুটপাত থাকলে দুর্ঘটনা কম হয়। তাই সব সড়কে ফুটপাতের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। একটি রুটে শুধু একটি কোম্পানির গাড়ি চলার ব্যবস্থা করতে হবে। একটি কোম্পানির গাড়ি চললে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে না। এতে লাভ যা হবে তা শেয়ারহোল্ডাররা ভাগ করে নেবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিরবচ্ছিন্ন অভিযান চালাতে হবে।

Advertisement

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কেবল সরকারি পদক্ষেপের আশায় বসে থাকলেই হবে না। আমাদের নিজেদেরকেও সড়ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। ভিআইপি গাড়ি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো যাতে উল্টো পথে না চলে তার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরকেই। ফুটপাত দিয়ে যেন মোটরসাইকেল না চলে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যখন-তখন রাস্তা পার হওয়া যাবে না। ফুটপাত এবং ওভারব্রিজ ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থা মনিটরিং করার জন্য নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির সমন্বয়ে স্থানীয় ভিত্তিক তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে।

সর্বোপরি সর্বক্ষেত্রে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক সচেতনতা। নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা যে ন্যায্য আন্দোলন করছে, তা যেন কোন রাজনৈতিক অপশক্তি তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহারের সুযোগ না পায়। আজকে ডিজিটাল যুগের শিক্ষার্থীরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে কাজ করতে হয়। এবার দায়িত্ব নেওয়ার পালা আমার, আপনার, আমাদের।

লেখক: প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/পিআর

Advertisement