মতামত

বিশৃঙ্খল সড়ক, অপরাধীকে রুখবে কে?

 

রোববার কলেজ থেকে ফিরে আমার কন্যা যখন মায়ের হাতে ভাত খাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে মিম এবং রাজিবকে পিষে মেরেছে বেপরোয়া গতির বাস। ওদের জন্যও খাবার সাজিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন প্রিয়জন। ওরা বাড়ি ফিরেছে নিথর হয়ে। মিম ও রাজিবকে একটি বাস হত্যা করল, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রতিবেশী দেশের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী। দায় এড়িয়ে যান তিনি। সড়কমন্ত্রী না হবার পরেও তার দফতরে গণমাধ্যমকর্মীরা কেন গিয়েছিলেন? কারণ, তিনি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেন।

Advertisement

সড়কে তার প্রভাব ওই দফতরের মন্ত্রীর চেয়ে বেশি। বেপরোয়া চালক, শ্রমিক ও নিয়ন্ত্রণহীন মালিকদের পক্ষে সাফাই ও হুমকি তিনিই বেশি দিয়েছেন এবং দেন। পরিবহন শ্রমিক ও মালিকরা তার প্রশ্রয়েই ধর্মঘট ডাকে, সড়ক অবরোধ করে। নৌ পরিবহনমন্ত্রীর হাসি মিম ও রাজিবের মৃত্যুর প্রতি কেবল বিদ্রুপই ছিল না, বিদ্রুপ-উপেক্ষা ছিল সকল শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের প্রতি। সার্বিকভাবে তিনি সকল যাত্রী ও নাগরিকদেরকেই অবজ্ঞা করেছেন।

যদিও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর ভর্ৎসনা পর তিনি সেই হাসির জন্য ক্ষমা চেয়েছেন এবং বলেছেন, সরকার চালক, শ্রমিক ও পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তিনি ও তার সংগঠন বাধা দেবে না। এখানেই তার ক্ষমতার উত্তাপ পাওয়া যায়। তিনি ক্ষমা চাওয়ার পরেও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ কমেনি। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভকেও প্রশমিত করা যায়নি। তিনি যদিও বলেছেন, তার সংগঠন এবং তিনি বাধা দেবেন না। কিন্তু আমরা নারায়ণগঞ্জ এবং ডেমরাতে দেখলাম শ্রমিকরা শিক্ষার্থীদের সড়কে অবস্থানের বিপক্ষে পথ অবরোধ করেছে।

শিক্ষার্থীরা পথ ছাড়েনি। ঢাকার বিভিন্ন স্পটের পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও শিক্ষার্থীরা পথে নেমে প্রতিবাদ করছে। তারা পরিবহনের কাগজ-পত্র পরীক্ষা করছে। ভাংচুর করেনি তা বলব না। তবে সাধারণ গাড়ি বা পরিবহনের ওপর তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেনি। তাদের লক্ষ্য ছিল বাসের দিকে। দুটো বাসে আগুনও দিয়েছে।

Advertisement

আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রেখে দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার্থীরা যে সড়কে অবস্থান নিয়েছে, তার পেছনে অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে। এই অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষেরা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলমনা নন। সকল মতাদর্শের মানুষকেই দেখছি সন্তানরা যে পথে নেমেছে, তাতে সমর্থন দিচ্ছেন। প্রতিবাদ করছেন তাদের ওপর পুলিশের চড়াও হয়ে ওঠার। শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা আজ এই অবস্থানে কেন? একের পর এক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সাধারণ মানুষ সড়কে প্রাণ দিলেও রাষ্ট্র নির্বাক। তার প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রিয়। দিনের পর দিন এই নিষ্ক্রিয়তায় অসহায় সাধারণ মানুষ, নাগরিকেরা।

আমরা আগে থেকেই জানি, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো-বিআরটিএ, পুলিশ কেন বাস কোম্পানিগুলোর ওপর প্রভাব রাখতে পারে না। কারণ, এই বাস কোম্পানিগুলো রাজনৈতিক ও সামরিক-বেসামরিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। যেই বাসটি দুই শিক্ষার্থীকে পিষে মারল, তার সঙ্গে নৌ পরিবহনমন্ত্রীর আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। অন্য বাস কোম্পানিগুলোও প্রভাবশালী মুক্ত নয়। ওই বাস কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করতে চার দিন সময় লাগল। তবে লাইসেন্স বাতিল করলেও সাধারণ নাগরিকেরা স্বস্তি পাচ্ছেন না। কারণ, কোম্পানিটি যে অন্য নামে ফিরে আসবে না, তার নিশ্চিয়তা দেবে কে?আমরা দেখতে পেলাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বিআরটিএ এবং মহানগর পুলিশকে অবৈধ ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের গাড়ি চালানো ও লাইসেন্সের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে।

অবাক হবার কথা হলো-এই কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চোখ রাঙানির প্রয়োজন হবে কেন? এই কাজটির জন্যইতো বিআরটিএ গঠন। বাস্তবায়নে সক্রিয় থাকার কথা পুলিশের। তারা যে ব্যর্থ হলো, তার জন্যতো চোখ রাঙানি নয়, প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন। তাদের জবাবদিহিতা নেই কেন? তারা কী করে এতদিন ভুয়া সনদ দিয়ে গেল? ট্রাফিক পুলিশের সামনে দিয়ে কী করে লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন চালক ও বাস চলাচল করে? এই বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরাই বা তাদের মন্ত্রণালয়ে কতটা তৎপর থাকেন?

আমরা জানি, নানা সময়ে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কয়েক দফা নির্দেশনা ছিল। যারা সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলেন, তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে? আমরা নানা বিষয়ে ডিজিটাল বা প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের কথা বললেও আমাদের সড়ক পরিচালনা বা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কিন্তু রয়ে গেছে দড়ি-বাঁশ যুগেই।

Advertisement

উত্তরের মেয়র শত বাস কোম্পানিকে চার-পাঁচটি কোম্পানিতে নিয়ে আসার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারও অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সর্বোপরি সড়ক ও গণপরিবহন ব্যবস্থাপণায় যে বিশৃঙ্খলা রয়েছে, সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কেবল আইন নয়; সরকার ও তার অনুশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে আমাদের সেই শৃঙ্খলায় ফিরে যাওয়ার এখনই সময়।

এসআর/আরআইপি