মাস কয়েক পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনী হাওয়া বইছে রাজনীতির মাঠ থেকে চায়ের টেবিলেও। সে আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে জোট গঠন, জোট ভাঙনের প্রসঙ্গও। সম্প্রতি বামপন্থী আটটি দল নিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠন করা হয়েছে। আবার হঠাৎ করেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈঠকে মিলিত হন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির সঙ্গে। ওই বৈঠকও রাজনীতির আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
Advertisement
নয়াজোট গঠন এবং রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজ’র মুখোমুখি হন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। দুই পর্বের প্রথমটি থাকছে আজ।
জাগো নিউজ : আটটি বাম দল নিয়ে নতুন জোট গঠন করলেন। জোট গঠনে কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিলেন?
আরও পড়ুন >> সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করছে
Advertisement
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : গত কয়েক বছর ধরে সিপিবি ও বাসদ জোটবদ্ধ হয়ে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অন্যদিকে আরও ছয়টি সমমনা বামপন্থী দল বামমোর্চার ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচি পালন করে আসছে।
গত এক বছর ধরে বামের ওই দুই মেরু মিলে যুগপৎ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রায় বছর হয়ে গেলো, আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়েছিলাম এবং একই ব্যানারে পাঁচ দফা দাবি উপস্থাপন করেছিলাম।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে আমরা কতগুলো মৌলিক বিষয় নিয়ে পাঁচ দফা দাবি উপস্থাপন করি। এসব জনদাবি সামনে রেখে আমরা হরতাল, অবরোধ, লংমার্চ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে আসছি। রাজনৈতিক প্লাটফর্মের বাইরেও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে আসছি। যেমন: তেল-গ্যাস-খনি রক্ষার আন্দোলন, রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন প্রভৃতি। সুতরাং আমাদের এ জোট জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গঠিত হয়েছে।
জাগো নিউজ : এ সংগ্রামে সামনের নির্বাচন গুরুত্ব পাচ্ছে কিনা? জোট গঠনের ঘোষণা আগেও আসতে পারতো?
Advertisement
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আমাদের এ জোট গঠন করা হয়নি, যা অন্য রাজনৈতিক জোটের বেলায় দেখা যায়।
এ কারণেই আমরা বলেছি, বাম গণতান্ত্রিক জোট ভোটনির্ভর নয়। জনগণের রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং জনগণের সংগ্রাম বেগবানের জন্যই এ জোট গঠন করা হয়েছে।
জাগো নিউজ : সেই লক্ষ্যে তো নির্বাচন গুরুত্ব পায় বটে? মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুঃশাসনের হাত থেকে রক্ষা করা। দ্বি-দলীয় মেরুকরণের বাইরে বাম গণতান্ত্রিক বলয়কে শক্তিশালী করে জনগণের ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করাই হচ্ছে আমাদের এ জোট।
জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য রাজপথের আন্দোলন যেমন একটি পথ তেমনি নির্বাচনও একটি সম্ভাব্য পথ। সব আন্দোলনকে কেন্দ্রভূত করে গণঅভ্যুত্থানের দিকে আমরা যাব। এ যাত্রায় প্রয়োজন হলে আমরা নির্বাচন করব, প্রয়োজন হলে আবার নির্বাচন বর্জনও করব। নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা নীরব থাকব না।
সুতরাং ভোটনির্ভর জোট নয় বলে আমরা নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে চলে যাব, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
জাগো নিউজ : এ মুহূর্তে কোনটিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : গণমাধ্যমসহ অনেকেই বলতে চাইছেন যে, বামেরা আদর্শ নিয়ে আছে। এরা ক্ষমতায় যেতে চায় না। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমরা বাম গণতান্ত্রিক শক্তির সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কোনো না কোনো একদিন সেই ধারার সরকার প্রতিষ্ঠা হবেই। সেই পথ প্রশস্ত করতেই আমরা রাজপথে সংগ্রাম করছি এবং কৌশলগত অবস্থানে থেকে নির্বাচনেও অংশ নেব।
জাগো নিউজ : নানা বিভাজনে বিভক্তি বাম দলগুলো। দলগুলো ভেঙেই নতুন দল হচ্ছে। বামদের শক্তিহীনতার অন্যতম কারণ এ বিভাজন। জোট করার ক্ষেত্রে মৌলিক কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হলো?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : অনেকগুলো মৌলিক বিষয়কে কেন্দ্র করেই জোট গঠন। সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বলছি না। রাজনৈতিক একটি মৌলিক বিষয়ের কথা উল্লেখ করছি। এ মুহূর্তে আওয়ামী দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্তি করাই হচ্ছে আমাদের মূল লক্ষ্য। একইভাবে দ্বি-দলীয় মেরুকরণ থেকেও জাতিকে মুক্তি দিতে চাই।
আরও পড়ুন >> সমাজের কেউ আজ নিরাপদ নন
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের মেরুকরণে দেশকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। এ দুটি দলই একই শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মুক্তবাজার, সাম্প্রদায়িক শক্তি, দেশি-বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ শক্তির কারণেই আজ এ সর্বনাশ।
জাগো নিউজ : দুই মেরুকে একই পাল্লায় তুলছেন কেন? অন্তত মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তো আওয়ামী লীগকে আলাদা করাই যায়?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : বিএনপির প্রতিষ্ঠাই হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। বিএনপির ব্যাপারে কিছু তো বলার থাকে না। কিন্তু যেটি ভিভ্রান্তিকর এবং যা কৌশলে আড়াল করে রাখা হয়েছে, তা হচ্ছে আওয়ামী লীগও এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বহু দূরে। আওয়ামী লীগ এখন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না।
সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করে মুক্তবাজারে আওয়ামী লীগ। ধর্মনিরপেক্ষ পরিত্যাগ করে হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত। জামায়াতের সঙ্গে জোট না করলেও বিএনপিকে আলাদা করে জামায়াত থেকে কীভাবে সুবিধা নেয়া যায়, তার নানা কৌশল নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। কে বেশি ইসলামপ্রিয় তার প্রতিযোগিতাও চলছে। আবার আমেরিকা-ভারতের আশীর্বাদ নিতেও ব্যস্ত হয়ে পড়ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি।
এগুলো সবই মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থী। আওয়ামী লীগ-বিএনপি আলাদা আলাদা ভিশন ঘোষণা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন না করে নতুন ভিশন ঘোষণা মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অবস্থান নেয়া। আমাদের ভিশন ১৯৭১। আমাদের নতুন কোনো ভিশন বা চেতনার প্রয়োজন নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর দাঁড়িয়েই জাতিকে শতভাগ মুক্তি দেয়া সম্ভব।
জাগো নিউজ : আপনাদের অবস্থান পরিষ্কার করলেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আপনার সঙ্গে বৈঠক করলেন। কী আলোচনা হলো?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : পূর্বঘোষিত কোনো সময় নির্ধারণ ছিল না। ওবায়দুল কাদের সাহেব হঠাৎ করে ফোন করে বললেন, আপনার অফিসে চা পান করতে আসব। বললো, সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর সাক্ষাৎ করতে আসা হয়নি। অন্যদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করছি। এরপর সময় না নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসলেন।
জাগো নিউজ : রাজনীতি নিয়ে কি আলোচনা হলো?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার সুযোগ ছিল না। চা-বৈঠকে ১৫ মিনিটের মতো আলাপ। উনি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ছাত্র রাজনীতির স্মৃতিকথা নিয়েই আলোচনা।
জাগো নিউজ : সুযোগ ছিল না বলছেন কেন? আপনি দলের সভাপতি, ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক। রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হওয়াই প্রাসঙ্গিক ছিল…
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সুযোগ ছিল না এ কারণে যে, আমাদের রাজনীতিই হচ্ছে এখন আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা। আমি এতো আহম্মক নই যে, রাজনীতির এজেন্ডা নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলোচনা করব। মূলত এটি ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ। এমন সাক্ষাতে রাজনীতির আলাপ শিষ্টাচারবহির্ভূত। জাগো নিউজ : পরবর্তীতে সংলাপ বা আলোচনার কোনো প্রস্তাব...
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : না। সৌজন্য সাক্ষাতে এমন কোনো বিষয়ে আলাপ হওয়া উচিত নয় বলে মনে করি। বরং আমি এবং কাদের সাহেব বলেছি, এ সাক্ষাৎ নিয়ে মিডিয়া নানা কথা বলবে। আর মিডিয়ার আলোচনার কারণে সৌজন্য সাক্ষাতের বিষয়টিও এখন আর নেই বললেই চলে।
আরও পড়ুন >> মেধার জায়গায় কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না
জাগো নিউজ : মিডিয়া কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার সেতুও তৈরি করে দিচ্ছে…
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : হ্যাঁ। আমি অবশ্য মিডিয়াকে দোষ দেই না। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো তো এখন বৈঠকে বসে আসন ভাগাভাগির বাজার নিয়ে! কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা এতো বোকা নয় যে, অন্য দলকে কেনা-বেচা করা গেলেও কমিউনিস্ট পার্টিকে কেনার প্রস্তাব দেবে! জাগো নিউজ : আওয়ামী লীগের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তো এর আগে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে সিপিবি আওয়ামী লীগকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছে বলে প্রচার রয়েছে… মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেইনি। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছি। এমনকি বিএনপির সঙ্গেও যুগপৎ আন্দোলন করেছি, এরাশাদবিরোধী আন্দোলনে।
তবে ওই সময়ের আওয়ামী লীগ আর এখনকার আওয়ামী লীগ এক নয়। তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ছিল প্রধানত স্কুলশিক্ষক, কৃষক, উকিল তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। এখন আওয়ামী লীগ পরিচালিত হয় লুটেরা ও ধনিক শ্রেণির নেতৃত্ব দ্বারা। মধ্যবিত্ত শ্রেণির দল থেকে আওয়ামী লীগ এখন ধনিক শ্রেণির দলে রূপান্তরিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি থেকে আওয়ামী লীগ অনেক দূরে সরে গেছে। সিপিবি সরে যায়নি। দূরত্ব আওয়ামী লীগই তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির জোটবদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই। আর বিএনপির সঙ্গে তো নয়-ই।
এএসএস/এমএআর/বিএ