বিশেষ প্রতিবেদন

ভল্টের স্বর্ণ বদল তেমন কিছু নয় : প্রধানমন্ত্রীকে অর্থমন্ত্রী

>> নিরাপত্তা সচেতনতা জাতিগতভাবে ‘একটু কম’>> দুই টুকরো সোনার চাকতিতে সমস্যা>> দশ বছরে নিলাম না হওয়া, খতিয়ে দেখছেন অর্থমন্ত্রী

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টের স্বর্ণ বদল হয়েছে- এমন দাবি করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ভল্টে স্বর্ণ বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। ’তবে শুরু হওয়া বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করতে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

Advertisement

এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখে জানিয়েছেন, বিষয়টি ‘তেমন একটা বিরাট কিছু নয়’।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী বরাবর ঠিঠি পাঠান অর্থমন্ত্রী। চিঠিতে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আমি ইতোমধ্যে অবহিত হওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, বিষয়টি নিয়ে বড় কোনো হৈ-চৈয়ের কারণ নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি মোটামুটি বেশ ভালো আছে। ৩৮টি সিসিটিভি নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে। সব সময় ছয় স্তরভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু আছে। ৭০ জন পুলিশ ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। তবে নিরাপত্তা সচেতনতা জাতিগতভাবে একটু কম বলে আমার মনে হয়।’

চিঠিতে বলা হয়, ‘সমস্যা হলো কালো প্রলেপযুক্ত দুই টুকরো তথাকথিত সোনার গোলাকার চাকতি এবং রিং নিয়ে। শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জব্দকৃত সব সোনা ছয়জন পরীক্ষা করেন। ছয়জনের মধ্যে স্বর্ণকারই আমাদের সচরাচর এক্সাপার্ট এবং তার কষ্টিপাথরই জব্দ করা সব সোনা বিচারে যথেষ্ট।’

Advertisement

এতে আরও বলা হয়, ‘বেশি সংগ্রহ হলো স্বর্ণের বারের। এগুলো বার হিসেবেই চোরাচালান বা আমদানি হয়। অন্যান্য স্বর্ণালঙ্কার বা অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত স্বর্ণ যা জব্দ হয় তা সময়ে সময়ে নিলাম করা হয়। তবে জানা গেছে যে, গত দশ বছরে কোনো নিলাম হয়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। ৯৬৩ কেজি ওজনের সোনা আমাদের ভল্টে মজুত আছে। এর মধ্যে প্রশ্নবোধক মান হলো মাত্র তিন কেজি চাকতি ও রিং নিয়ে। তাই বিষয়টি তেমন একটা বিরাট কিছু নয়।’

এদিকে ভল্টে জমা রাখা স্বর্ণের ওজন ও গুণগত মান নিয়ে দুই সংস্থার দু’রকম তথ্য নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মঙ্গলবার (২৪ জুলাই) ওই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সবকিছু যাচাই-বাছাই করে যত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ এন এম আবুল কাসেমকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে।

কমিটির অন্য চার সদস্য মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের এবং একজন উপ-মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের। কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কমিটি গত মঙ্গলবার (২৪ জুলাই) থেকেই কাজ শুরু করেছে। এ নিয়ে কাজ করার জন্য কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে সর্বোচ্চ দুই মাস সময় দেয়া হয়েছে।’

ওই সদস্য আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে স্বর্ণ জমা রাখার পদ্ধতি আরও আধুনিকীকরণ ছাড়াও স্বর্ণের মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আরও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করা যায় কি না- সেটাও আমরা বিবেচনায় নিয়েছি।’

Advertisement

গত ২৪ জুলাই সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ব্যাংকে স্বর্ণ রয়েছে ৯৬৩ কেজি, এর মধ্যে তিন কেজি দূষিত। এটা কোনো সমস্যা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা স্বর্ণ নিয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে সেগুলো অনার্থক (ইউজলেস)।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা স্বর্ণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা স্বর্ণ নিয়ে অনিয়মের খবর যেভাবে দুনিয়া কাঁপানোভাবে প্রকাশিত হয়েছে, সেটা পুরোপুরি সত্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের মধ্যে যোগাযোগ ঘাটতিতেই এ সঙ্কট। তবে আমরা বিষয়টিকে ছোট করে দেখছি না। পর্যালোচনা করে কারও বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের দেয়া স্বর্ণ জমা রাখার সময় ৪০ শতাংশই ছিল। কিন্তু ইংরেজি-বাংলার হেরফেরে সেটা ৮০ শতাংশ লিখে ভুলবশত নথিভুক্ত করা হয়। ৮০ এবং ৪০-এ ক্লারিক্যাল মিসটেক হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ছয় স্তরের নিরাপত্তা আছে, কোনো স্বর্ণ বাইরে যায়নি। জনগণের সম্পদ রক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর। তাই টোটাল নিরাপত্তা সিস্টেমটা পর্যালোচনা করা হবে। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো সংস্থা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।’

গত ১৭ জুলাই একটি দৈনিকে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ভুতুড়ে কাণ্ড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর দিনভর আলোচনা চলে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক অনুসন্ধানের তথ্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ পরীক্ষা করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনিয়ম ধরা পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখা তিন কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের চাকতি ও আংটির জায়গায় এখন আছে মিশ্র বা শংকর ধাতু। আর ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট।

ওই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক রবিউল হোসেন এবং ভল্টের দায়িত্বে থাকা কারেন্সি অফিসার আওলাদ হোসেন চৌধুরী একই দিন (১৭ জুলাই) জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ভল্টে রক্ষিত স্বর্ণে কোনো ধরনের হেরফের হয়নি; স্বর্ণকারের ভুলে ভাষার গণ্ডগোলে ৪০ হয়ে গেছে ‘এইটটি।’

আওলাদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রুটি বলতে যা আছে, নথিভুক্ত করার সময় ইংরেজি-বাংলার ভুল। এর বাইরে অন্য ত্রুটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই।’

এমইউএইচ/এমএমজেড/এমএআর/আরআইপি