ভ্রমণ

শুভ্রতার স্পর্শে : প্রবাসীদের বিশ্বস্ততা

কী আর করার? ঠান্ডায় জমতে লাগলাম! বসে বসে ভাবতে লাগলাম- কিভাবে এর সমাধান করা যায়। প্রথমে ভাবলাম জুতো খুলে পা দু’টোকে ভাঁজ করে নিলে কিছুটা উষ্ণতা পাওয়া যেতো। কিন্তুু আমার দু’পাশেই ব্যাগ, নড়াচড়ার জায়গা কই? হ্যালিও চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছেন। অগত্যা বসে বসে ভাবতে লাগলাম- কবে একজোড়া জুতো কেনা যায়, যেনতেন জুতো নয় বরফে হাঁটার জন্য বুট!

Advertisement

চোখ বুজে পড়ে রইলাম আর এদিকে মনে হচ্ছে পায়ে বোধ হয় কোনো জুতোই নেই! পা জোড়া জমে জমজমাট! কোন হর্নের শব্দ ছাড়াও বোধ হয় এতদূর পথ কখনো অতিক্রম করিনি! চলার সময় মাঝে মাঝে বরফের কারণে গাড়ির টায়ারে অদ্ভুতুড়ে একরকম শব্দ হচ্ছে! খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ড্রাইভার সাহেবকে জিজ্ঞেস করি। কিন্তুু হ্যালির দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম।

যদিও অন্ধকারে তেমন কিছু দৃশ্যমান না। তবে এটুকু বুঝছিলাম, উনি হয়তো ঘুমাচ্ছেন। কিছুক্ষণের ভেতরেই হ্যালির স্বল্পকালীন নিদ্রা ভঙ্গ হলো আর আমি এটা বুঝতে পারছিলাম না আমার ঘুম পাবে কবে? বলতে গেলে সেই যে ২৮ তারিখ রাতে উঠেছি এখন ৩০ তারিখ মধ্যরাত। টানা এতক্ষণ না ঘুমিয়ে কখনো ছিলাম বলে মনে পড়ে না! এমনকি আমাদের ডেন্টালের পেশাগত পরীক্ষার সময়ও কিছুক্ষণ হলেও ভয়ে ঘুমিয়ে নিতাম এই ভয়ে যে, পরের দিন পরীক্ষার হলে মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে যেন না যাই!

হ্যালি ড্রাইভারকে রাস্তাঘাটের বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করছিল। সুযোগ বুঝে আমিও প্রশ্নটা করে ফেললাম, এরকম শব্দের কারণ কি? উনি বললেন, এটা এক বিশেষ ধরনের টায়ার যাতে রাস্তার অমসৃণ বা বিপজ্জনক জায়গায় পড়লে শব্দ হয়। যাতে ড্রাইভার অনায়াসেই এটা কাটিয়ে যেতে পারেন!

Advertisement

> আরও পড়ুন- মাটির নিচে ভিন্ন জগৎ!

হ্যালিও এটার সাথে পরিচিত, উনিও কয়েক লাইন যুক্ত করলেন। আমি ভাবতে লাগলাম, আরে বাহ! এ তো তাজ্জব ব্যাপার! চাকাই বলে দিচ্ছে কী করতে হবে? এতদিন তো জানতাম চালক যেভাবে গাড়ি চালায় সেভাবেই সবকিছু হয়, এখন তো দেখছি ক্ষেত্রবিশেষে উল্টোটাও ঘটে!

রাজপথ ছেড়ে ছোট রাস্তায় প্রবেশ করলাম, বুঝলাম যাত্রার সময় ফুরোচ্ছে! হ্যালি বলতে লাগল, কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। চলে এলো হ্যালির বাড়ি! কিন্তুু বাড়ি কোথায়? এটা তো একটা দোকান বলে মনে হচ্ছে! বোধ হয় ওটার পেছনেই হবে। হ্যালি ফোন করলেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওনার স্বামী এখানে আসলেন। এর আগেই ড্রাইভার ব্যাগ নামানো শুরু করেছেন।

দরজা খোলার সাথে সাথেই ঠান্ডা কাকে বলে? হ্যালি নেমে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্বামীর সঙ্গে। বিশালাকার লম্বাটে মার্কিন ভদ্রলোক যেমনটা আমরা টিভিতে দেখে থাকি। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বেশ আন্তরিকতার সাথেই আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। জীবনে বোধ হয় প্রথমবার কোন মার্কিন ভদ্রলোক আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন।

Advertisement

বললেন, ‘হাই এ.ডি, (আমার ইংরেজি নামের প্রথম বর্ণ) হাউ আর ইউ?’ বললাম, ‘ফাইন!’ (কতটা যে ফাইন(!) সেটা তো বুঝতেই পারছেন)। ‘হাউ ওয়াজ দ্য জার্নি?’ বললাম, ‘সো ফার সো গুড’। দু’জনই বিদায় জানিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

এবার শুরু হবে অচেনা পথে যাত্রা। কারণ সবকিছুই অজানা। ড্রাইভার যদি ভুল পথেও নিয়ে যায় কিছু বলা তো দূরের কথা, টেরই পাব না কিছু! মাঝে মাঝে উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসছিল, পরে সব ঝেড়ে ফেলে মহাদেবকে স্মরণ করলাম। ড্রাইভারের সঙ্গে কিছুটা স্বাভাবিক হতে গল্প করা শুরু করলাম। পুরো ভ্রমণের গতিপথ বললাম। কতঘণ্টা না ঘুমিয়ে আছি তা বললাম।

ও বললো, ‘ইট মাস্ট বি ভেরি হার্ড।’ মিনিট পনেরোর মধ্যেই আরও ছোট্ট রাস্তায় ঢুকে গেলাম। ড্রাইভার ঠিকানা খুঁজছে, পেয়ে গেল অবশেষে! ৬২, মিলটন স্ট্রিট! বাড়ির নাম ‘প্যারাডাইজ ফাউন্ড’। আর কারও জন্য না হোক অন্তত আমার জন্য এটা স্বর্গতুল্যই! ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামার আগে যা বলল, সেটা শুনে আমি শুধু আশ্চর্যই হলাম না- রীতিমত অভিভূত হলাম!

> আরও পড়ুন- মন হারায় ধরন্তির ঘোলা জলে

উনি বললেন, ‘তুমি গিয়ে ডোর বেল দাও, আগে সুনিশ্চিত হও কেউ দরজা খুলছে কিনা! যতক্ষণ না কেউ দরজা খুলছে, আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবো।’ আর কি কিছু বলার আছে? এর থেকে ভালো ড্রাইভার আর কি কেউ হতে পারবে? উনি ব্যাগ নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আর আমি দরজা খুলে যখন নামলাম, মনে হচ্ছিল এন্টার্কটিকা মহাদেশের বরফে জুতো ছাড়া নামলাম! তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কলিং বেল দিতে লাগলাম!

মধ্য রাত! অবশ্যই মারসিয়া ঘুমিয়ে আছেন। আমি কলিং বেল দিচ্ছি আর তাকিয়ে দেখছি ট্যাক্সিচালক আছে কি নেই? কয়েক মিনিটের মধ্যেই লাইট জ্বলে উঠলো। সেই সাথে আমার হৃদকম্পনও স্বাভাবিক হয়ে এলো। মারসিয়া চোখ কচলাতে কচলাতে এসে দরজা খুললেন।

স্তিমিত স্বরে বললেন, ‘ওয়েলকাম আতানু!’ আমি বললাম, ‘হাই!’ দুটো ব্যাগ ভেতরে রেখেই ড্রাইভারকে হাত দেখালাম। উনিও হাত দেখিয়ে বিদায় নিলেন। আগেই অবশ্য লাগেজ দুটোকে উপরে উঠিয়ে নিয়েছিলাম। তাই বাসার সামনে থেকে ভেতরে ঢুকালাম। মারসিয়া আমাকে উপরে নিয়ে রুম দেখিয়ে দিলেন এবং নিজের ঘরে চলে গেলেন।

আমি বিছানায় বসলাম। ঢাকা থেকে সিডনি, কানাডা যাত্রা শেষ হলো।

চলবে...

এসএইচএস/এসইউ/জেআইএম