শিক্ষার্থীদের চলমান অবরোধের মধ্যে বুধবার সচিবালয়ে দুই মন্ত্রী, এক প্রতিমন্ত্রী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ তথ্য জানান।
Advertisement
সভায় নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা, পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ, বাংলাদেশ বাস ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান উপস্থিত ছিলেন।
শাজাহান খান শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেন এবং মশিউর রহমান রাঙ্গা পরিবহন মালিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। এজন্য তাদের সভায় ডাকা হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
গত ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের চাপায় ঘটনাস্থলে নিহত হন শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব।
Advertisement
এরপর থেকে নয় দফা দাবিতে রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো- বেপরোয়া চালককে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে, নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিড ব্রেকার দিতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে, শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে, শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে, রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল এবং লাইসেন্স ছাড়া চালকদের গাড়ি চালনা বন্ধ করতে হবে এবং বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না।
‘দুর্ঘটনা ঘটানো জাবালে নূর দুই গাড়ির চালককে গ্রেফতার করা হয়েছে, গাড়ির রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে’ জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আইন অনুযায়ী দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাতে হয় প্রশাসন থেকে সেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘হঠাৎ করেই কোমলমতি ছাত্ররা তিনদিন ধরে লাগাতার বসে আছে, তাদের সঙ্গে আমরাও দুঃখিত। তাদের যেমন সহপাঠী নিহত হয়েছে আমাদের ছেলেমেয়েও নিহত হয়েছে। যারা অবরোধ করছে, রাস্তায় বসে আছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে তারই দাবিতে তারা বসে আছে।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের কাছে যে সমস্ত দাবি তারা (শিক্ষার্থী) তুলেছে আমরা যেগুলো পেয়েছি, আমরা মনে করি তাদের দাবিগুলো সঠিক ও যৌক্তিক এবং আমরা সবগুলো আমলে নিয়েছি, সবগুলো আমরা ইমপ্লিমেন্ট (বাস্তবায়ন) করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা আশা করি, ছাত্রছাত্রীরা অবরোধ তুলে নিয়ে ক্লাসে ফিরে যাবেন।’
‘ফিটনেট ও রুট পারমিটবিহীন গাড়ি যাতে চলতে না পারে, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে গাড়ি চালাতে না পারেন সে বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কঠোর আইন প্রয়োগের দাবি জানিয়েছেন’ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা সবাই একমত। এগুলো যাতে চলতে না পারে সেই ব্যবস্থা আমরা করব।’
আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘দেশব্যাপী বাস-ট্রাক টার্মিনালের স্টার্টিং পয়েন্টে আমরা গাড়ি চেক করব। মালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতি পরীক্ষা করবে। প্রয়োজনে প্রশাসনের লোক থাকবে। গাড়ি যখন বের হবে তারা চেক করবে। ফিটনেস, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ঠিকমতো আছে কি না- চেক করার পর ফিট হলে গাড়িটা টার্মিনাল থেকে বের হতে পারবে, নইলে বের হতে পারবে না। নিরাপত্তা বাহিনী রাস্তায় থাকবে, চ্যালেঞ্জ করবে, এসব (প্রয়োজনীয় কাগজ) না দিতে পারলে সেখানেই তার ব্যবস্থা হবে।’
কবে নাগাদ স্টার্টিং পয়েন্টে গাড়ি পরীক্ষা শুরু হবে- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ইতোমধ্যে চালু করে দেয়া হয়েছে বলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব নিজেই মোবাইল কোর্টে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা কী করি? সব আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না- সেটা দেখি। আমরা সেটাই করছি।’
‘দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন’ জানিয়ে কামাল বলেন, ‘তিনি নির্দেশনা দিয়েছিলেন যারা ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’
আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, ‘শ্রমিক-চালক যাতে কাজগুলো সঠিকভাবে করে, সেজন্য সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে মালিক সমিতি। তারা দায়িত্ব নিয়েছেন। বিভিন্ন টার্মিনালে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অভিভাবক ও শিক্ষকদের অনুরোধ করব, আপনারা আপনাদের ছাত্রদের অনুরোধ করুন তারা যেন ক্লাসে ফিরে আসে। কারণ এতে হচ্ছে কী, জনদুর্ভোগ বাড়ছে, সারা শহর অচল হয়ে পড়ছে, এটা কারো কাম্য নয়। যারা অবরোধ করছেন তারও কাম্য নয়, আমরা যারা রাস্তায় চলাচল করছি তাদেরও কাম্য নয়। প্রিয় ছাত্রছাত্রী ভাই-বোনেরা এই অবরোধ তুলে নেবেন।’
‘ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও কারও কাম্য নয়’ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘ছাত্র-ছাত্রীরাও এটা চায় না। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহল এই সুযোগে ২৯ তারিখে (২৯ জুলাই) ১৫০টি গাড়ি ভেঙেছে। ৩০ জুলাই ২৫টি এবং ৩১ জুলাই ১৩৪টিসহ মোট ৩০৯টি গাড়ি ভেঙেছে। আটটি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের একটি, ফায়ার সার্ভিসের একটি- এগুলো অত্যন্ত দুঃখজনক।’
‘শিক্ষার্থীরা অবরোধ করছে আর এই সুযোগে স্বার্থান্বেষী মহল ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানোর মতো কাজগুলো করছে। অনুরোধ করব, প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা অবরোধ তুলে নেবেন এবং তারা আবারও ক্লাসে আসবেন, পড়াশোনায় মনোযোগী হবেন।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সইনবোর্ডে পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করেছেন বলে জানা গেছে। শিক্ষার্থীদের অবরোধের মধ্যে কাদের উস্কানিতে পরিবহন শ্রমিকরা পথে নেমেছেন- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘দেখুন, আমরা যে কোনো অবরোধকারীদের বলছি, যার যার অবস্থানে ফিরে যাবেন। এখানে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা আমাকে স্পষ্ট জানিয়েছেন, তারা কোনোক্রমেই ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে যাবেন না। ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে।’
‘দীর্ঘ সময় অবরোধ থাকলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। স্বার্থান্বেষী মহল এটাকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করতেই পারে। সেজন্য আমি বিশেষ অনুরোধ রাখব, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে অনুরোধটা রাখে, তারা যাতে ফিরে যায়।’
তিনি বলেন, ‘মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ওই অংশ তারা গিয়েছেন কিংবা যাবেন। তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন। তারা (পরিবহন শ্রমিক) সেখানে থেকে সরে গিয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে না যায় সেই ব্যবস্থা তারা করেছেন।’
‘বিআরটিএর লোকবল সংকট রয়েছে। কোথাও মোবাইল কোর্ট বসলে সারা ঢাকায় বাস চালাচল বন্ধ হয়ে যায়’- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি, স্টার্টিং পয়েন্টেই মালিক, শ্রমিক সংগঠনের লোক, প্রশাসনের লোক থাকবে। সবকিছু ঠিক না থাকলে স্টার্টিং পয়েন্ট থেকেই গাড়ি বের হতে দেবে না। তারপরও কোনো মালিক এটা করলে মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হবে।’
নতুন সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার বিষয় আছে- এ বিষয়ে শাজাহান খান বলেন, ‘আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে পরিবহন সেক্টরের অনেক অনিয়ম দূর হয়ে যাবে। আমরা পরিবহন সেক্টরের অনিয়ম দেখতে চাই না। কোনটা হত্যা, কোনটা দুর্ঘটনা- এটা নির্দিষ্ট করা আছে আইনে। আমরা আইনের কথা বলেছি। যেটা হত্যা সেটা হত্যা, যেটা দুর্ঘটনা সেটা দুর্ঘটনা, সেটা আইনে নির্ধারিত হবে।’
‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় ব্যবস্থা নেবেন। আমরা মালিক ও শ্রমিকরা তাকে সহায়তা করব’ বলেন শাজাহান খান।
পরিবহন সেক্টরে দীর্ঘদিনের সমস্যা অল্প সময়ে শেষ হবে কি না- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যথার্থই বলেছেন। আমাদের ইন্টেনশনটা কী? আমাদের ইন্টেনশন হলো যাতে দুর্ঘটনাগুলো না ঘটে। আমাদের ইন্টেনশন হরো আইন যাতে মেনে চলে, ট্রাফিক আইন যাতে মেনে চলে সবাই। সেজন্য সবার সহযোগিতা চাচ্ছি।’
প্রভাবশালীরাই গাড়ির ব্যবসা করেন, অনেক সময় পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে না- এ বিষয়ে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। কারও ফোন পেয়ে প্রশাসনের লোকজন ছেড়ে দিচ্ছে- এ রকম ঘটনা আজকাল ঘটে না। আপনারা যেগুলো দেখছেন সেগুলো হয়তো আগের ঘটনা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সব সময় ঘোষণা করে আসছেন, আইন সবার জন্য সমান। আজকে আপনারা এর প্রমাণও পেয়েছেন।’ ‘এখন জেলখানায় কারা কারা অবস্থান করছেন, সেটাও আপনারা জানেন। এ ব্যাপারে আপনারা নিজেরাই জানেন, আর প্রশ্ন করে লাভ নেই।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘প্রতিদিন ১৫০টি নতুন গাড়ি ঢাকায় নামছে। আমাদের জায়গার সংকট আছে। এখন আমাদের অনেক কিছু চিন্তা করতে হচ্ছে। আমরা যখন ধরেছি, পর্যায়ক্রমে শেষ করব। ঢাকাকে একটি সুন্দর ও যানজটমুক্ত শহর হিসেবে গড়ে তুলব।’
আরএমএম/এমএআর/জেএইচ/আরআইপি