পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে আমাদের হা-পিত্যেশের কী মানে দাঁড়ায়? একাত্তরে পাকিস্তান আমাদের কাছে পরাজিত হবার অর্থ কি দেশটির জনগণ আমাদের পছন্দের কাউকেই ভোট দেবে? বরং আমাদের ভাবনার খোরাক হতে পারে- মুসলিম লীগ ও আওয়ামী পার্টির মত ঐতিহ্যবাহী দলের বিপক্ষে কিভাবে ইনিংস জিতলেন লেডি কিলার ইমরান খান?
Advertisement
পাকিস্তানের ভোটে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে অভিযোগ প্রশ্নাতীত। সেনাবাহিনীর ম্যানিপুলেশন-ম্যাকানিজমও গোপন নয়। কিন্তু তা-ই কি সব? এর আশপাশে বা নেপথ্যে অন্য কোনো বিষয়-আশয় কি কাজ করেনি?
পাকিস্তানের সেদিনের নির্বাচনটি মোটেই বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারি ( ২০১৪), ১৫ ফেব্রুয়ারি ( ১৯৯৬) বা ৩ মার্চ (১৯৮৮)-র মতো ছিল না। সব দল ও জনগণের অংশগ্রহণ ছিল পাকিস্তানের এ নির্বাচনে। এর আগে, ভারতীয়রা উগ্র সাম্প্রদায়িক দল বিজেপিকে নিজের ভোট নিজে দিয়েছে। ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে মোদি গদিনশীন হয়েছেন ভারতে। চা বিক্রেতা, গুজরাটের কসাই, সাম্প্রদায়িকতার শিরোমনি ইত্যাদি কলঙ্কিত খেতাবের নরেন্দ্র মোদি তাদের গর্বের ধন।
ভারতীয়রা ভুল করেছে না শুদ্ধ করেছে-সেই আলোচনার চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে- দেশটিতে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের কারণ কি? কে বা কারা করে দিয়েছে এ সুযোগটি? একইভাবে আমেরিকানরা বেছে নিয়েছে বহু বদনামের ভাগীদার, উম্মাদ, বেনিয়া ট্রাম্পকে। আমাদের দেশের 'সচেতন প্রজন্ম' হায় হায় করে আমেরিকানদের বোকামীতে। একবারও প্রশ্ন তোলেনি- কাদের ব্যর্থতা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কারণে সভ্য দেশটির জনগণ ডজনে ডজনে নারী কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ট্রাম্পের মতো লোকের ওপর ভরসা করেছে?
Advertisement
নারী বিষয়ে পাক্কা ইমরান হালের পাকিস্তানে ধর্ম-কর্ম, সেনাবাহিনী, তালেবান সবকিছুতেই ফর্মে। নারী নিয়ে তার রাখঢাক কম। তেমন লজ্জাও পান না। এক নারীর পর আরেক নারী যেন তৈরিই থাকে তার জন্য। এতে তার সমস্যার বদলে সম্ভাবনার দুয়ার খোলে।
নির্বাচনের পর পাকিস্তানকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর মদিনা সনদ অনুযায়ী পরিচালনার জজবা তুলেছেন এ প্লেবয়। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ইমরান বলেছেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বপ্নের পাকিস্তান গড়বেন তিনি। নতুন পাকিস্তানের রূপরেখা দিয়ে বলেন, ‘মদিনা রাষ্ট্রের আদলে পাকিস্তান গড়ে তুলবেন। মহানবী (সঃ) যেভাবে রাষ্ট্র চালাতেন সেভাবে চলবে পাকিস্তান।’ তার বক্তব্যে মাশাল্লাহ- ছোবহানাল্লাহ-শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলার বহুত আদমি পাকিস্তানে।
আধুনিক, ডিজিটাল, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশও এ ধারায় খানিকটা এগিয়ে বললে ভুল হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো আগেই মদিনা সনদে দেশ চালানোর ঘোষণা দিয়ে মারহাবা পেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মদিনা সনদ ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিদায় হজের ভাষণের নির্দেশনা অনুসারে দেশ চালাবেন। তিনি ঘোষণাটি দেন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন পাস করা হবে না বলে আলেমদের আশ্বস্ত করেন। তার হাদিস-কালাম বর্ণনায় ঝানু পীর-মুর্শিদদের কেউ কেউ হিংসায় পুড়লেও প্রধানমন্ত্রীর ধর্মীয় বয়ান ব্যাপক মারহাবা কুড়িয়েছে। দলের খাসপছন্দের আলেম-ওলামারাও বলছেন, মদিনা সনদ আর ৭২ এর সংবিধানে না-কি বহু মিল রয়েছে।
Advertisement
এদিকে, এক সময়ের ক্রিকেট নায়ক ইমরান খান এমন কথাও বলেছেন, জিতলে বাংলাদেশে ( ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত ) পাকিস্তানের করে যাওয়া অবিচার ও গণহত্যার বিচার করবেন। বাংলাদেশের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে তাদের কাছে ক্ষমা চাইবেন। চাট্টিখানি কথা নয়। পাকিস্তানে কিছুদিন ধরে এ ধরনের কথার বাজার ভালো।
মাস কয়েক আগে তখনকার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেছিলেন, একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির সাথে ঠকবাজি-আহম্মকি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচার করেছেন। এ প্রশ্নে নওয়াজকে ছাড়িয়ে ইমরান এগুলেন আরো কয়েক কদম। এটাই ছিল সময়ের চাহিদা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় ‘মেইক আমেরিকা গ্রেইট এগেইন’ ( আসুন আমেরিকাকে আবার মহান করে তুলি) শ্লোগান মানুষ গিলেছে। ‘মেইক পাকিস্তান গ্রেইট এগেইন’- আসুন পাকিস্তানকে আবার মহান করে তুলি বলে ঠিক ট্রাম্পের মতোই পাকিস্তানে প্রচারণা চালিয়েছেন ইমরান খান। তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই নানাদিক দিয়ে ইতিমধ্যে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে মেলাচ্ছেন। বলছেন, পাকিস্তানের নয়া ট্রাম্প ইমরান।
ট্রাম্প-ইমরান নিজ নিজ দেশে ডান সমর্থনপুষ্ট। মার্কিন শ্বেতাঙ্গদের প্রতি বরাবরই আনুকূল্য ও সহানুভূতি দেখিয়ে আসছেন ট্রাম্প। পাকিস্তানে ধর্মীয় ডানপন্থীদের জন্য একই আনুকূল্য ইমরানের। পৃথিবীর সর্বত্রই খেলাধুলা রাজনৈতিক। ক্রীড়ার উদ্ভবই হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। সেদিন ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে ট্রাম্প তার আলোচনার শুরুতেই পুতিনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন, একটি সফল বিশ্বকাপ আয়োজন ও সে আয়োজনে রাশিয়ার উজ্জ্বল অংশগ্রহণের জন্য। পেলে-জিকো-ডুঙ্গা সকলেই রাজনীতি করেন বা করেছেন। পাকিস্তানের প্লেবয় ক্রিকেটার ইমরান খান ছাড়াও এমন বহু উদাহরণ পৃথিবীতে রয়েছে।
বিশ্বময় ব্যঙ্গাত্মক চরিত্রের অধিকারী উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন চণ্ডালতায় টপ মোস্টে। তার চুলের বিচিত্র ছাঁট, হাঁটা-চলা, কথাবার্তা, পোশাক, শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন, কথায় কথায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরসহ অদ্ভুত শাসকের একচ্ছত্র স্টিয়ারিং তার হাতে।
বিশ্বের খেপাটে শাসক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাকে সমীহ করতে বাধ্য হয়েছেন। শতভাগ শিক্ষিত দেশের মানুষ কিমকে বেছে নিয়েছে তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে। উত্তর কোরিয়ায় কোনো মানুষের নাম ‘কিম জং-উন’ রাখা যায় না। শুধু তাই নয় যাদের এই নাম আছে, তাদেরও তা বদলে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সাল থেকেই এ নির্দেশ বহাল আছে।
উত্তর কোরিয়ার অদ্ভুত আইনগুলোর আরেকটি হচ্ছে সেখানে চাইলেই ইচ্ছেমতো চুল কাটা যাবে না। যার যেমন খুশি চুল কাটবেন সে উপায় নেই? স্বৈরশাসক কিম জং উন ক্ষমতায় আসার পর পরই ঠিক করে দিয়েছেন, দেশের সব পুরুষকে বিশেষ ১০টি আর মেয়েদের ১৮টি হেয়ার স্টাইলের মধ্যেই যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। আর কিম জং উনের যে কাটিং তা আর কেউ কাটাতে পারবে না।
প্রকৃতিও যেন দেশটির নাগরিকদের মন-মননে কিম বানিয়ে ফেলেছে। তারা কিমকে মেনে নিয়েছেন। বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তার কোনো সিদ্ধান্তে কেউ ‘না’ করে না। তিনি একাধারে ওয়ার্কার্স পার্টি অব কোরিয়ার ফার্স্ট সেক্রেটারি, উত্তর কোরিয়ার কেন্দ্রীয় সেনা কমিশন ও জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। কোরিয়ান পিপলস আর্মির সুপ্রিম কমান্ডারও। কারো তাতে আপত্তি নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিও নেই।
২০১১-এর ডিসেম্বরে বাবা কিম জং-ইলের আকস্মিক মৃত্যুর পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি ক্ষেপাটে কিম জন উনকে। ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকেই আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে কিম জং। অল্প বয়সে দেশের শাসনভার তুলে নেওয়ার পর অনেকে তাকে নিয়ে সংশয়ে থাকলেও তা কেটে গেছে। সব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে তিনি এখন বিশ্বজোড়া আগ্রহের ব্যক্তিত্ব। নিজ দেশ ও পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল অনেক কিছুই ঘটিয়েছেন কিম জং উন।
কখনো ক্ষুধার্ত কুকুরের মুখে ঠেলে দিয়ে। কখনো কামানের তোপ। আবার কখনো সামনে থেকে গুলি করে। বিরোধী বা তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে এভাবেই প্রাণদণ্ড দেওয়ার একাধিক নজির রয়েছে উত্তর কোরিয়ায়। ২০১৪ সালে সরকারবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে কিম জং উন ক্ষুধার্ত কুকুরের পালকে খাইয়ে দেন নিজের কাকাকে।
কিছুদিন আগে উত্তর কোরিয়ার প্রথম হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা চালানোর নেপথ্যের ব্যক্তিত্ব এ কোরীয় নেতা। ওই পরীক্ষা চালানোর নির্দেশপত্রে সই ছিল তার। হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে কিম বিশ্বকে এটাই স্মরণ করিয়ে দিলেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হুমকি, চাপ, ভাবনা নিয়ে তার তেমন মাথাব্যথা নেই।
উত্তর কোরিয়ায় বছরের বিশেষ দুটি দিনে কেউ জন্ম নিলে সেই দিনে জন্মদিন উদযাপন করা যাবে না। উত্তর কোরিয়ার সাবেক দুই শাসক কিম ই সুং এবং কিম জং ইল মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে সেই দিনগুলোতে দেশের কোনো সাধারণ মানুষের জন্মদিন উদযাপন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ। এ নিয়ম মানতে গিয়ে প্রায় ১ লাখ মানুষকে ৮ জুলাই বা ১৭ ডিসেম্বরের জন্মদিন উদযাপন করতে হয় একদিন পর, অর্থাৎ ৯ জুলাই এবং ১৮ ডিসেম্বরে।
সামরিক বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলায় দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিওন ইয়ং চলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অদ্ভুত আর নৃশংস ঘটনা আর কখনোই দেখা যায়নি। তাতে কি? জনপ্রিয়তার পারদেও তিনি তুঙ্গে।
হাল বাস্তবতায় গোটা দুনিয়া এখন এই এক্সপ্রেসেরই যাত্রী। যার স্টিয়ারিং ট্রাম্প, মোদি, ইমরান, কিম, পুতিনদেরই কব্জায়। দুনিয়ার নানা প্রান্তে পুতিন থেকে ট্রাম্প, টুডো থেকে মোদি, ইমরান। নিরলস কাজের সাথে দূরদর্শীতা, হাল বুঝে পাল তোলা, ঝোপ বুঝে কোপ মারায় তারা সবাই চ্যাম্পিয়ন। সাফল্যের ম্যাজিকও সেখানেই। বাস্তব বোঝা চেতনাবানদের কাছে তাই তারা আইকন। মানুষের মন, নার্ভ বুঝে যেখানে যা বলা দরকার সেটাই তারা বলেন। করেনও।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর