বিশেষ প্রতিবেদন

১৯ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর অজানা কাহিনি

‘বলতে পারো কি, সত্য হয় না কি/আজকে রাতে মজার একটি স্বপ্ন দেখেছি’ গানটি যখন সীমা সাহা গাইছিল, তখন সবার চোখেই স্বপ্নরা খেলছিল। এত স্বপ্নের মেলা! এত জীবন কথা! যার সবই অন্ধকারে। স্বপ্ন দেখতে আঁধার লাগে। আর এই আঁধারেই থেমে যাচ্ছে ওদের জীবনের গতি।

Advertisement

চোখের আলো নিভে গেছে সবারই। কেউ জন্ম বেলার অন্ধ। কেউবা জন্মের পর। এখন আঁধারই ওদের সাথী। যে ভালোবাসা অন্তঃচক্ষুর দর্শনে, সে ভালোবাসার রং মলিন হয় না কখনই। রাজধানীর মোহাম্মদপুর আদাবরে ইমাম ফাউন্ডেশন পরিচালিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ১৯ নারী শিক্ষার্থী অমলিন ভালোবাসার চাদরেই মোড়া।

অন্ধকার ভুবনের নক্ষত্র ওরা। আলোর পরশ পাওয়ার স্বাদ তীব্র সবারই। কিন্তু যে চোখেই আলো নেই, সে চোখে আলোর দেখা মেলে কি করে! কিন্তু ভেতরের আলো যদি তীব্র হয়, তবে আলোর বিকাশ ঘটে ঘোর অন্ধকারও। অন্তঃচক্ষুতে ওরা নিজেকে জানছে, জানছে পৃথিবীকে।

বাংলা, ইংরেজি, গণিত, আরবি শিক্ষাতে সাধারণের মতোই ওরা। ক্লাশ-পরীক্ষায় অংশ নেয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই। ব্রেইন পদ্ধতিতেও শিক্ষার আলো মিলছে কারো কারো। আর যারা এসব অন্ধজনে আলো দিচ্ছেন, তারাও জন্মান্ধ।

Advertisement

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করে ইমাম ফাউন্ডেশনের এই শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষকতা করছেন মাহমুদা আক্তার। তিনি জন্ম থেকেই অন্ধ। দেড় বছরেই শিক্ষার্থীরা ভালোবাসার কেন্দ্রে অবস্থান পেয়েছেন মাহমুদা। শিক্ষকদের আরেকজন ইডেন কলেজ থেকে পাশ করেছেন। দৃষ্টিহীন এই দুই শিক্ষিকার হাত ধরেই ওদের শিক্ষা-জীবনের পথচলা অন্ধ মেয়েদের।

আস্থা, বিশ্বাস আর নিয়তির অমোঘ খেলায় ওরা সবাই এখন একটি পরিবারে যেন। একজনের হাতে হাত রেখেই আরেকজনের ভরসা। ভালোবাসার পরশ পেয়েই তারা ভুলে থাকে পরিবার, আপনজনকে। ভুলে থাকে না দেখার বেদনা।

শিক্ষিকা মাহমুদা বলেন, পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। যে আলো দেখতেই পাইনি, সে আলোর পরশ পাওয়ার স্বাদ জাগিয়ে লাভ কি? অন্তরের আলো দিয়ে জীবনের স্বাদ খুঁজি। অনেকেই তো চোখে দেখলেও জীবনের মানে খুঁজে পায় না। আমরা তো তাদের চেয়ে ভালোই আছি।

নিজের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি বলেন, ‘কর্ম দিয়েই মানুষের পরিচয়। অদম্য শক্তির বলে আমরা শিক্ষার সব শাখায় বিচরণ করতে পারি। এখানে যারা আছে, সবাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিখছে। ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। মনের বলই প্রধান যে কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।’

Advertisement

২০০৩ সালের কথা। ফরিদপুরে তিনজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা দেন ইমাম ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ সাঈয়েদ ইমামুল হাসান ইমাম নিজেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। চোখ ৭৫ শতাংশই দেখতে পান না। চাকরি করেন এলজিইডি মন্ত্রণালয়ে। অন্ধজনে নিজের দৃষ্টি খোঁজার তাগিদ নিয়েই এমন শিক্ষালয়ের জন্ম দেন। সময়ের ব্যবধানে পরিধি বাড়তে থাকে ইমাম ফাউন্ডেশনের। তারই ধারাবাহিকতায় মোহাম্মদপুরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা পায় নতুন শাখার।

প্রতিজন শিক্ষার্থীর জন্য মাসে খরচ হয় ৫ হাজার টাকা। যার বেশির ভাগই আসে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে। তবে ফাউন্ডেশনে আসা অর্থও বিভিন্ন জনের সহায়তা থেকে।

ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা হাসান ইমাম বলেন, অন্ধজনের মনের বেদনা থেকেই আমার এই প্রচেষ্টা। দিন যাচ্ছে, এর পরিধি বাড়ছে। এখন অর্থ সংকটে। সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। সরকার চাইলে সব প্রতিবন্ধীকেই স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ দিতে পারে।

গত বছরের জানুয়ারি মাসে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে এসেছে সীমা সাহা। মুসলমান মেয়েদের সঙ্গে থাকতে কোনোই সমস্যা হয় না বলে জানালেন সীমা। এর আগে রাজশাহীতে একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ছিলেন। সেখানেই পড়ালেখার হাতেখড়ি। গানের রেওয়াজও করতেন সেখানে। মন চাইলেই মিষ্টি সুরে গান গেয়ে আনন্দ দেন সবার মাঝে।

সীমার বাবা মুদি দোকানদার। থাকা-খাওয়ার খরচ আর বাড়ি থেকে আসে না। পরিবার থেকে খরচ মেলে না অন্যদের বেলাতেও। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মুসলমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোরআন শরীফ শিক্ষাতেও মন দিয়েছেন সম্প্রতি। বলেন, শিখছি সবই ভালো লাগা থেকে। তবে শিক্ষাজীবন শেষ করে শিক্ষকতা বা গায়িকা হওয়াতেই মন দেবেন।

শরীয়তপুর থেকে একই বছর এসেছে তাহমিনা আক্তার তনু। তনু চোখে ঝাপসা দেখতে পায় (শতকরা ১৫)। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামেই পড়েছে। এক ভাই চার বোনের মধ্যে তনুই সবার ছোট। আদরের ছোট মেয়ে তনুর খবর নেয় পরিবারের সবাই। ইডেন কলেজ পড়ুয়া বড় বোন খোঁজ নিতে আসে মাঝে মাঝেই।

তনু জীবনকথা বলতে গিয়ে জানায়, এখানেই ভালো আছি। অন্তত শিক্ষা জীবনের নিশ্চিয়তা মিলছে। গ্রামের স্কুলে তো আমার জন্য সমস্যাই হতো। পরিবারে মতো ভালোবাসা পাচ্ছি সবারই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের গ্রাম বিনোদপুর থেকে এসেছে সাবিহা আক্তার। এর আগে জয়পুরহাটে একটি প্রতিষ্ঠানে থেকে পড়ালেখা শুরু। এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে এই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ভাই-বোনের দু’জনই অন্ধ। রিকশাচালক বাবার পরিবারে থেকে পড়ালেখার সুযোগ ছিল না।

সাবিহাও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। বলেন, শিক্ষা বিলিয়েই তো মানুষের কাছে যাওয়া যায় দ্রুত। আর মানুষের মাঝে থাকতে পারলেই সব দুঃখ, কষ্ট ভুলে থাকা যায়।

এএসএস/এমআরএম/পিআর