ফিচার

ছয়বার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত রাফির গল্প

সপ্তম শ্রেণিতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তির মাধ্যমে হাতেখড়ি! এরপর পর্যায়ক্রমে পাঁচবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে আয়োজিত দেশসেরার পুরস্কার পেয়ে বর্তমানে দশম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় এখন পর্যন্ত ছয়বার জাতীয় পুরস্কার পায় রাফি তালুকদার। মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত এমন কৃতিত্বের অধিকারী রাফিকে নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন আবদুর রহমান সালেহ-

Advertisement

পেছন ফিরে দেখা: মায়ের আগ্রহ এবং ফুফাতো বোন ফারজানা সুলতানা দিনার নাচ দেখে প্রাইমারিতে পড়ুয়া ছেলেটির কৌতূহল জন্মে নৃত্য নিয়ে। অবচেতন মনের কৌতূহল মেটাতে ধীরে ধীরে স্কুলের বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে অংশ নেয়। ছেলে হয়ে নৃত্য পরিবেশনের বিষয়টি পরিবার থেকে সমর্থন করলেও বন্ধুরা বিভিন্ন সময় হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে ক্ষ্যাপাতো রাফিকে। রাফির নৃত্য দেখে মুগ্ধ দর্শকদের করতালির কাছে বন্ধুদের হাসি-ঠাট্টাগুলো খুব একটা পাত্তা পায়নি। যার ফলশ্রুতিতে শুধু নৃত্য প্রতিযোগিতায়ই পাঁচবার জাতীয় পুরস্কারের গৌরব অর্জন করে রাফি।

নৃত্যশিল্পী যখন আবৃত্তিশিল্পী: চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে স্থানীয় কমিউনিটি রেডিওতে উপস্থাপনা করার সুবাদে শিখতে হয় আবৃত্তি। শুরুতে শেখার জন্য শেখা হলেও এ মাধ্যমও ভালো লেগে যায় রাফির। উপজেলা পর্যায়ে আবৃত্তি শেখার জন্য প্রতিষ্ঠিত কোনো আবৃত্তিশিল্পীর সান্নিধ্য না মিললেও ইউটিউবের সাহায্যে দেশের নন্দিত অভিনেতা এবং প্রথিতযশা আবৃত্তিশিল্পী আসাদুজ্জামান নূরের আবৃত্তি শুনে শুনে তাকে অনুসরণ করে। এ অনুসরণই রাফিকে নিয়ে গেছে জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে! ২০১৫ সালে তথ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) আয়োজিত আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বিটিভির মহাপরিচালকের কাছ থেকে দেশসেরা আবৃত্তিকারের পুরস্কার গ্রহণ করে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় দ্বিতীয়বারের মত পায় এ পুরস্কার।

> আরও পড়ুন- পনিরের পুলিৎজার বিজয়ের গল্প

Advertisement

ফটোগ্রাফিতেও আগ্রহ: মফস্বলে বড় হওয়া রাফির ফটোগ্রাফির প্রতিও রয়েছে তুমুল আগ্রহ। দেশের অন্যতম ফটোগ্রাফার প্রীত রেজার প্রতিষ্ঠান ‘পাঠশালা’র অনলাইন কোর্সে ভর্তি হয়ে মফস্বল থেকেই নিয়মিত কোর্স চালিয়ে যায় রাফি। দৃষ্টিনন্দন ফটোগ্রাফির মাধ্যমে শখকে পূর্ণতায় নিয়ে যেতে রাফির নিরন্তর প্রচেষ্টা কাছের মানুষকেও করে তোলে ভীষণ রকমের কৌতূহলী।

শিক্ষা জীবনের কৃতিত্ব: পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পাশাপাশি জেলা পর্যায়ের প্রথম স্থানটিও নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে রাফি। এছাড়াও প্রথম শ্রেণি থেকে এপর্যন্ত শ্রেণিকক্ষের ক্রমিক নম্বরটিও কখনোই ওঠানামা করেনি। প্রথম হওয়ার ঘরেই আটকে আছে!

বিভিন্ন অর্জন: প্রাইমারি থেকে শুরু করে মাধ্যমিকের শেষ পর্যায়ে থাকা রাফি অংশগ্রহণ করেছে অসংখ্য ইভেন্টে। শুধু অংশগ্রহণই নয়, হয়েছে বার বার সেরাদের সেরা। উৎসাহটা মূলত এসব ইভেন্টে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই বাড়তে থাকে। একবার সেরা হলে পুনরায় সেরা হওয়ার বাসনা নিয়ে যখন যে ইভেন্টেই অংশ নিয়েছে, সেই ইভেন্টেই রেখেছে সন্তোষজনক কৃতিত্বের স্বাক্ষর। রাফির ভাষায়, ‘লোকাল অর্জনগুলোর তালিকা করা কিছুটা কষ্টসাধ্য। উপজেলা পর্যায়ে কয়েকবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী হওয়া ছাড়াও পঞ্চাশটিরও বেশি পুরস্কার বিভিন্ন সময়ে পেয়েছি। এর মধ্যে বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন এবং শ্রেষ্ঠ বক্তার পুরস্কার পেয়েছি অনেকবার। শ্রেষ্ঠ কাব স্কাউট, সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অর্জনের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে ২০১৬ ও ২০১৮ সালের শ্রেষ্ঠ মেধাবী নির্বাচিত হওয়া, বিভিন্ন রচনা, কুইজ ও নৃত্য প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি অসংখ্যবার। তাছাড়া জেলা পর্যায়ে ২০১৮ সালের উন্নয়ন মেলায় শ্রেষ্ঠ বক্তা এবং বরগুনা জেলার হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি কয়েকবারই।’

জেলা পর্যায়ে রাফির উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত সর্বোচ্চ পাঁচটি বিষয়ে পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়টি। বিভাগীয় পর্যায়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর আয়োজিত মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় ২০১৬ ও ২০১৮ সালে বরিশাল বিভাগের সেরা মেধাবী হওয়ার গৌরবময় অর্জনও।

Advertisement

ছয়বার জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চেই! মাধ্যমিকের শুরু থেকে মফস্বলের রাফিকে বারবার ঢাকাগামী হতে হয়েছে দেশসেরার পুরস্কার গ্রহণের জন্য। সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালীন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও শিশু একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত জাতীয় শিশু পুরস্কার (নৃত্য) পায় রাফি তালুকদার। বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে ২০১৫ সালে প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এবং কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের হাত থেকে প্রথম জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করে রাফি। এরপর একই বছরে তথ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বিটিভির মহাপরিচালকের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ, ২০১৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ পদক (লোকনৃত্য) পুরস্কার ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রাফির হাতে তুলে দেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে অভিহিত। ২০১৭ সালে নবম শ্রেণিতে থাকাকালীন চতুর্থবারের মত নৃত্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং শিশু একাডেমি পুরস্কার রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের হাত থেকে গ্রহণ করে রাফি। একই বছর একই শ্রেণিতে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শিশুকিশোর সংগঠন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে নৃত্যে প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বারের হাত থেকে ঢাকার তেজগাঁও কলেজ অডিটরিয়াম থেকে পুরস্কার গ্রহণ এবং ২০১৭-১৮ যৌথভাবে ষষ্ঠবারের মত লোকনৃত্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে সর্বশেষ জাতীয় পুরস্কার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের হাত থেকে গ্রহণ করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদকটি রাফি দ্বিতীয়বারের মত অর্জন করে।

> আরও পড়ুন- পুলিৎজার পুরস্কার পেলেন বাংলাদেশি সাংবাদিক

রাফির পরিচয়: বরগুনার আমতলী উপজেলার ঘটখালী গ্রামের তালুকদার বাড়িতে রাফির জন্ম। রাফির বাবা আমতলী সরকারি কলেজের কম্পিউটার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার। গৃহিণী মা নাজমুন নাহার এবং মেডিকেল পড়ুয়া বোন রুবাইয়া লরাকে নিয়ে রাফির পরিবার।

পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং সার্বিক বিষয়ে রাফি বলেন, ‘স্থানীয় নৃত্যশিল্পী সাগর দাশের মাধ্যমে নৃত্যে হাতেখড়ি লাভের পর শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম সানির মাধ্যমে নাচের জগতে অবাধ বিচরণ হয়। এরপর বরিশাল অমৃত লাল দে নৃত্যাঙ্গনের শিক্ষক মুরাদুজ্জামান মুরাদ খান, নৃত্যশিল্পী এসআই ইভান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেলায়েত হোসেন স্যারের সান্নিধ্যই মূলত আমার সাফল্যের মূল জায়গা। বিভিন্ন সময়ে এই মানুষগুলোর উৎসাহ-অবদানে আমি এতদূর আসতে পেরেছি। তাছাড়া বাবা-মা এবং বোনের অবদান তো আছেই।’

কম সময়ে খুব বেশি পুরস্কারপ্রাপ্তিতে উৎসাহিত রাফি ভবিষ্যতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। রাফির অর্জনের খাতায় সাফল্যের সমীকরণ বলছে- ভবিষ্যতের ইচ্ছেটি পূরণ হওয়া হয়তো শুধুই সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

এসইউ/পিআর