কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর স্বীকৃতি লাভ করার গৌরব অর্জন করেন। শুধু তাই নয়, ববিতা হ্যাটট্রিক করে একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তাকে বলা হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আন্তর্জাতিক মানের অভিনেত্রী। কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে তিনি ঢাকাই ছবিকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বজুড়ে। তিনি ববিতা। আজ তার জন্মদিন।
Advertisement
ববিতার চলচ্চিত্রে শুরুটা হয়েছিল ষাটের দশকের শেষ দিকে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রায় দুই শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন ববিতা। এই পথচলায় দেশ-বিদেশের অনেক নায়কের সঙ্গেই জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন ববিতা। তার সেরা সময়ে তিনি ছিলেন দর্শকের স্বপ্নের মানবী। শুধু তাই নয়, নায়কদের মধ্যেও ববিতাকে নিয়ে ফ্যান্টাসী ছিল। ফারুক-সোহেল রানারা নিজেরাই সেইসব স্বীকার করেছেন। ববিতার জন্মদিনে তার সব নায়কদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই বিশেষ আয়োজন-
ববিতার প্রথম নায়ক ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ইতিহাস বলে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী পপি (ববিতার ডাক নাম) ‘সংসার’ ছবিতে রাজ্জাক ও সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবির নির্মাতা ছিলেন জহির রায়হান। ছবিটি মুক্তি পায়নি। এর কয়েক বছর পর জহির রায়হান ‘জ্বলতে সুরুজ কা নিচে’ নামে একটি উর্দু ছবির কাজ শুরু করেন। সেখানে নায়িকা ছিলেন ববিতা। মাঝপথে থেমে যায় এই ছবিটিরও কাজ। এরপর জহির রায়হান রাজ্জাক ও ববিতাকে নিয়ে তৈরি করেন চলচ্চিত্র ‘শেষ পর্যন্ত’। আর এটিই ছিল ববিতার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। তারপর থেকেই ঢাকাই ছবিতে এই নক্ষত্রের উত্থান। আজও তিনি আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন অভিনয়ে।
দারুণ সম্পর্ক ছিলো রাজ্জাক-ববিতার মধ্যে। ব্যক্তি জীবনে জহির রায়হানকে গুরুর মতো সম্মান করতেন রাজ্জাক। তার শালী ববিতাকে তিনি স্নেহ করতেন ছোট বোনের মতো। নায়করাজ আজীবন ববিতাকে পারিবারিক সদস্য ভেবেছেন। ববিতাও নিজের জীবনের নানা বিপদে-আপদে, আনন্দে স্মরণ করতেন রাজ্জাককে। বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করতেন, নিতেন পরামর্শ, শুনতেন বিধি নিষেধ।
Advertisement
নায়করাজের মৃত্যুর দিন জাগো নিউজকে ববিতা বলেছিলেন, ‘আমার কাছে তিনি নায়ক ছিলেন না। তার সঙ্গে সম্পর্কটা পারিবারিক। তিনি আমার সেরা বন্ধু ছিলেন, ভাই ছিলেন।’ ববিতা বলেন, রাজ্জাকের সঙ্গে ৪০টি ছবিতে নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। রাজ্জাকের নিজের প্রযোজনা ও পরিচালনার ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছেন।
এরপরই ববিতার ক্যারিয়ারে অন্যতম নায়ক বলা যায় চিত্রনায়ক ফারুককে। ঢাকাই সিনেমাতে রাজ্জাক-কবরী জুটির পাশাপাশি যে জুটিটি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ছিলো সেটি ফারুক-ববিতা। দর্শক এবং সমালোচক- উভয় মহলের প্রিয় ছিলেন ফারুক-ববিতা জুটি। ১৯৭৩ সালের সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথমবার একসঙ্গে অভিনয় করেন তারা। এরপর ‘আলোর মিছিল’, ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমনি’, ‘সূর্য সংগ্রাম’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘মিয়া ভাই’ এবং ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ সিনেমায় অভিনয় করেন তারা। সেইসব ছবিতে এই দুই তারকার প্রেম, বিরহ আজও হৃদয়ে মুগ্ধতা ভরা হাহাকার জন্ম দেয়।
দুই তারকাও ব্যক্তি জীবনে নিজেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মজার ব্যাপার হলো ২০১৬ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে দুজনকে একসঙ্গেই আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে। নায়িকা হিসেবে ববিতাকে পেলে সবসময় উপভোগ করতেন ফারুক। তিনি ববিতাকে নিয়ে বলেন, ‘ববিতা তো সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা। আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে তার। ববিতার সঙ্গে আমার বেশ কিছু সুপারহিট ছবি আছে। যে বৈশিষ্ট্য অনেকের মধ্যে নেই, তা আমি ববিতার মধ্যে দেখেছি। সাধারণ জীবনেও তার ব্যবহার অতুলনীয়। সবার থেকে একটু আলাদাই মনে হয়েছে ববিতাকে।’ আর ফারুককে নিয়ে ববিতার বক্তব্য, ‘ফারুক ভাই তো অসাধারণ শিল্পী। প্রতিবাদী গ্রামের যুবকের চরিত্রে তার তুলনাই হয় না। আমি তার সঙ্গে যে কটি ছবিতে কাজ করেছি, সে অভিজ্ঞতা থেকে বলব, তিনি অনেক বড় শিল্পী। আমি যদিও ফারুক ভাইয়ের আগে চলচ্চিত্রে এসেছি, কিন্তু একসঙ্গে অনেক ছবিতে নায়ক-নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছি। একসময়ের সফল জুটি আমরা একসঙ্গে আজীবন সম্মাননা পেয়েছি-সেটা নিঃসন্দেহে অনেক আনন্দের।’
নায়িকা ববিতার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় জাফর ইকবাল। অকাল প্রয়াত চিরসবুজ এই নায়কের সঙ্গে রোমান্টিক জুটির নায়িকা হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন ববিতা। তাদের প্রেম নিয়েও অনেক মুখরোচক গল্প ছড়ানো আছে ইন্ডাস্ট্রিতে। কেউ কেউ তো দাবি করে থাকেন, ববিতার সঙ্গে প্রেমের ব্যর্থতাই জাফর ইকবালকে জীবন থেকে অকালে ছিটকে ফেলেছিল।
Advertisement
সেই সম্পর্ক নিয়ে সরাসরি মুখ না খুললেও নিজের ক্যারিয়ারে সেরা নায়ক হিসেবে জাফর ইকবালকেই এগিয়ে রাখেন ববিতা। দাবি করেন, জাফর ইকবাল তার একমাত্র স্বপ্নের নায়ক। ২০১৬ সালে জাগো নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ববিতা বলেন, ‘আমি বিভিন্ন দেশের অনেক বড় বড় অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি। সবার সঙ্গে কাজ করেই ভালো লেগেছে। কেউ কেউ আমাকে গর্বিতও করেছেন। আমাদের নায়করাজ রাজ্জাক ভাই, ফারুক, সোহেল রানাসহ আরো অনেকের অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব আমাকে আজো মুগ্ধ করে রেখেছে। ভারতের সৌমিত্র দা’র মতো নায়কের সঙ্গেও আমি কাজ করেছি। তাকে নিয়ে বলার নতুন কিছু নেই। তবে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আমার স্বপ্নের বা পছন্দের নায়ক ছিল জাফর ইকবাল। কারণ তার কিছু জিনিস আমাকে একটু বেশিই মুগ্ধ করতো। সে যেমনি সুদর্শন ছিল, তেমনি ছিল তার অভিনয়ের সাবলীলতা, কণ্ঠ, ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন সচেতনতা, রুচিবোধ। জাফর ইকবাল খুব ভালো ইংলিশ গান গাইতে পারতো। গিটার বাজিয়ে ওর মুখে ইংলিশ গান শোনাটা আমাদের সময়কার যে কোনো মেয়ের জন্য স্বপ্নের একটি মুহূর্ত। আমি বলবো ওর মতো সম্পূর্ণ কোনো নায়ক আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আসেনি। সব্যসাচি ছিলো ও। জাফর ইকবালের অকাল প্রয়াণ আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করেছে।’
নায়ক রাজ্জাকের পর জাফর ইকবালই ববিতার সর্বাধিক ছবির নায়ক। এই জুটিকে প্রায় ৩০টি ছবিতে একসঙ্গে দেখেছেন ঢাকাই সিনেমার দর্শক। তার মধ্যে ‘এক মুঠো ভাত’, ‘অবুঝ হৃদয়’, ‘প্রেমিক’, ‘প্রেম বিরহ’, ‘দোষী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে ১৯৮৯ সালে জাফর ইকবাল-ববিতার প্রেমের ছবি ‘অবুঝ হৃদয়’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়।
ববিতা বেশ কিছু ব্যবসা সফল ছবিতে অভিনয় করেছেন নায়ক সোহেল রানার বিপরীতে। তারমধ্যে ‘গুনাহগার’, ‘শরীফ বদমাস’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘হাইজ্যাক’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘নাগপূর্ণিমা’ উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তি জীবনে সোহেল রানার সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে ববিতার। আর ববিতাকে নিয়ে সোহেল রানারও রয়েছে অভিনয়ের তৃপ্তি।
ববিতার নায়ক হয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চনও। একে একে ক্যারিয়ারের প্রথম তিনটি ছবিতেই নায়িকা হিসেবে ববিতাকে পেয়েছিলেন কাঞ্চন। ছবি তিনটি হলো ‘বসুন্ধরা’, ‘ডুমুরের ফুল’ ও ‘সুন্দরী’। জীবনের প্রথম নায়িকা হিসেবে বরাবরই ববিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ইলিয়াস কাঞ্চন। আর ববিতাও দেশীয় চলচ্চিত্রের একজন শক্তিশালী অভিনেতা হিসেবে কাঞ্চনকে সম্মান করে থাকেন।
এছাড়া ববিতা বেশ কিছু ছবিতে নায়ক উজ্জ্বলের বিপরীতেও সফল ছিলেন। এই জুটির তালিকায় ‘এখনই সময়’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘পায়ে চলার পথ’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘বেলা শেষের গান’, ‘অপবাদ’, ‘অপরাধ’ ছবিগুলো উল্লেখযোগ্য।
পাশাপাশি ‘নিশান’ ছবিতে জাভেদ, ‘বড় বাড়ির মেয়ে’ ও ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ ছবিতে আলমগীর, ‘শ্বশুরবাড়ি’ ছবিতে মাহমুদ কলি, ‘ডাকাত’, ‘জালিমের দুশমন’, ‘টাইগার’ ছবিতে জসীমের বিপরীতে, ‘নতুন বউ’ ছবিতে আফজাল হোসেন, ‘বন্দিনী’ ছবিতে ওয়াহিদের বিপরীতে অভিনয় করেছেন ববিতা। বুলবুল আহমেদের সঙ্গে ববিতাকে দেখা গেছে ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘দীপু নাম্বার টু’ ছবিগুলোতে।
দেশের বাইরেও বেশ কয়েকজন নায়কের সঙ্গে কাজ করেছেন ববিতা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রশংসিত হন। এই চলচ্চিত্রে ‘অনঙ্গ বউ’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি বেঙ্গল ফ্লিম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় শ্রেষ্ঠ নায়িকার পুরস্কার পান। ছবিতে তাকে দেখা গিয়েছিল ওপার বাংলার নন্দিত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে।
এছাড়াও যৌথ প্রযোজনায় ‘দূরদেশ’ ছবিতে পাকিস্তানের নাদিম বেগ ও ‘মিস লংকা’ ছবিতে পাকিস্তানের ফয়সাল রহমানের নায়িকা হয়ে অভিনয় করেন ববিতা।
এলএ/পিআর