এক দশক আগেও সমুদ্রসৈকত ঘিরে পর্যটকদের আনাগোনা, হোটেল ব্যবসা, লবণ ও চিংড়ি চাষে সীমাবদ্ধ ছিল পর্যটন নগরী কক্সবাজারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এখন পরিস্থিতির বদল হয়েছে। বাড়তে শুরু করেছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বড় বড় প্রকল্প আসছে কক্সবাজারে। এখন উন্নয়নের মহাযজ্ঞ শুরুর অপেক্ষা মাত্র। এ কারণে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কক্সবাজার জেলা। এসব বিষয়ের তদারকি করতে কক্সবাজারে আসছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ৯ জন সচিবসহ ১৩ জন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। তারা কক্সবাজারে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি আনতে তদারকি এবং সার্বিক উন্নয়নের সমন্বয় সাধনে তিনদিন কক্সবাজারে অবস্থান করে কাজ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে কক্সবাজারে আসা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা হলেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিউল আলম, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম, সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএএন সিদ্দিক, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব মনোয়ার ইসলাম, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মালেক, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড.কামাল উদ্দিন আহমদ, পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান অপরুপ চৌধুরী, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব মো. হারানুর রশিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ একেএম মাহবুবুর রহমান এবং উপ সচিব মলয় চৌধুরী।সূত্র জানায়, এ অঞ্চলের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর ও মহেশখালীতে ৫০০ থেকে ৭ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। মূলত দীর্ঘমেয়াদে দেশের বিদ্যুৎ সঙ্কট নিরসনের জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আমদানি-রফতানিতে পরিচালন ব্যয় কমাতে বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়টিও নীতিনির্ধারকদের সামনে চলে আসে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে জাপানভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাদের সমীক্ষায় সম্ভাব্য স্থানগুলোর মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালী সোনাদিয়া এলাকায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের পক্ষে মত দেয়া হয়। এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও দৈনিক দৈনন্দিন পত্রিকার সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য সোনাদিয়া অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। যা আশপাশের বেশকিছু দেশকে সংযুক্ত করবে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কক্সবাজার। তবে আরো আগে থেকেই এ ধরনের পরিকল্পনা নেয়া উচিত ছিল। শুধু গভীর সমুদ্রবন্দর করলেই হবে না, এর সুফল পেতে হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন, পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য বড় অবকাঠামো এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।সরেজমিনে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই মহেশখালীতে ধান চাষ হলেও এখন বেশিরভাগ জমিই লবণ চাষে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা এলাকার মানুষ ও তাদের জীবনমানের উন্নয়নেই এক ধরনের পরিবর্তন এনেছে। এ ধরনের পরিবর্তন তাদের ভাগ্যের কিছুটা উন্নয়ন ঘটালেও পরিবেশের জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নতুন অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমেই টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন এলাকাবাসী।কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সরকার জেলার একাধিক এলাকাকে সমৃদ্ধ করতে চায়। প্রথম পর্যায়ে মহেশখালীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এতে পুরো এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নতি হবে। অবহেলিত এ জনপদকে নতুনভাবে সাজাতে চায় সরকার। পর্যায়ক্রমে আরো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি জাইকা মহেশখালীতে মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্পে ঋণসহায়তা দেয়ার চুক্তি করেছে সরকারের সঙ্গে। চুক্তি অনুযায়ী, এ প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে জাইকা দেবে মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৮৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৩ হাজার ১৫৪ কোটি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন ছাড়াও কয়লা আমদানির লক্ষ্যে জেটি নির্মাণ সঞ্চালন লাইন ও সেতুসহ অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুতায়ন ও টাউনশিপ গঠন করা হবে। জানা গেছে, চায়না থার্মাল পাওয়ার স্টেশন এবং চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড পৃথকভাবে মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে। প্রথম ধাপে ১ হাজার ৯৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চায় তারা। জানা গেছে, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। তিন ধাপে ২০৫৫ সাল নাগাদ এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। ২০২০ সালের মধ্যে প্রথম ধাপ, ২০৩৫ সালের মধ্যে দ্বিতীয় ও ২০৫৫ সালের মধ্যে তৃতীয় ধাপের নির্মাণকাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এটি নির্মাণ হলে প্রায় ১০ কোটি টন পণ্য ও ৫ মিলিয়ন টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। এছাড়া রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে কক্সবাজারকে রেলযোগাযোগের আওতায় নিয়ে আসার একটি প্রকল্পও চলমান। এটি হলে এ জেলার সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের উন্নতি হবে। পাশাপাশি কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কাজও শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের সম্ভাবনার দেখা মিলছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। এমজেড/এমএস
Advertisement