খেলাধুলা

আবারও সেই ‘ফুলটসে’ কপাল পুড়লো বাংলাদেশের

চীনের দুঃখ যদি হয় হোয়াংহো নদী , ক্রিকেটে বাংলাদেশের দুঃখ তাহলে ‘ফুলটস।’ এই ফুলটস ডেলিভারিতেই স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় বারবার নীল হতে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে। গায়নার প্রোভিডেন্স পার্ক স্টেডিয়ামে আবারও হতাশার প্রতীক হয়ে থাকলো ‘ফুলটস’। পরপর দুই ফুলটসে স্বপ্ন ভঙ্গ হলো বাংলাদেশের। আউট হলেন সাব্বির রহমান রুম্মন আর মুশফিকুর রহীম। তাতেই সাজানো বাগান তছনচ। তীরে এসে তরি ডোবা। নিশ্চিত জয় হলো হাতছাড়া।

Advertisement

হিসেবটা ছিল পানির মত সহজ। শেষ সাত বলে দরকার ছিল ৮ রানের। হাতে ৬ উইকেট। একপ্রান্তে ওয়েলসেট মুশফিক; যার নামের পাশে ততক্ষণে জমা পড়েছে ৬৮ রান। অন্যদিকে সাব্বির। বোলার কিমো পল। তার ছোড়া ফুলটসকে পুল আর ফোরহ্যান্ড সুইপের মত একটা শট খেললেন সাব্বির। বল চলে গেল ডিপ মিড উইকেটে ওঁৎ পেতে থাকা ফিল্ডার হেটমায়ারের হাতে।

ঠিক পরের, মানে শেষ ওভারের প্রথম বলে আবারও ফুলটস। এবার বোলার ক্যারিবীয় অধিনায়ক জেসন হোল্ডার। তার ছোড়া ফুলটসকে পুল শটে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে সীমানার ওপারে পাঠাতে গেলেন মুশফিকুর রহীম। শটের ওপর নিয়ন্ত্রন না থাকায় বল গিয়ে আঘাত হানলো ব্যাটের মাঝখানের চেয়েও ওপরে। ওই জায়গায় লাগলে যা হওয়ার তাই হলো।

বাতাসে ভেসে বল চলে গেল সীমানার প্রায় আট দশ গজ সামনে দাঁড়ানো কিমো পলের কাছে। তা মুঠোবন্দী করে উল্লাসে ফেটে পড়লেন পল। দু’হাত ওপরে তুলে সৃষ্টি সুখের আনন্দে মাতলেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক হোল্ডারও। মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে মাঠ ছাড়লেন মুশফিক। মুখায়ব আর শরীরি অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিলো, না পারার যন্ত্রনায় ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

Advertisement

তারপরও সুযোগ আর সম্ভাবনা দুটোই ছিল। পাঁচ বলে ৮ রান দরকার। এমন কঠিন কিছু নয়। দুটি বাউন্ডারি বা এক চার আর একটি ডাবলস হলেই হয়ে যেত। কিন্তু তা আর হলো কই? এমন অবস্থায় মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত পরপর দুই বলে রানই করতে পারলেন না। তৃতীয় বলের মুখোমুখি হওয়ার আগে নন স্ট্রাইক এন্ড থেকে অধিনায়ক মাশরাফি ছুটে গিয়ে মিনিট খানেক বোঝালেন। হয়ত বললেন, এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। তিন বলে আট রান কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। একটি ছক্কা না হয় ডাবলস আর বাউন্ডারি বের করতে পারলেই হয়ে যাবে।

কিন্তু মোসাদ্দেক চার-ছক্কা কিছুই হাঁকাতে পারলেন না। তার ব্যাট থেকে পরের দুই বলে আসলো তিন। প্রথমে ডাবলস। পরে সিঙ্গেলস। আর তাতেই আসলে শেষ হয়ে গেল জয়ের সম্ভাবনা। মাত্রই উইকেটে আসা এবং কোন বল ফেস না করা অধিনায়ক মাশরাফির সামনে লক্ষ্য দাড়ালো ১ বলে ৫ রানের। চার মারতে পারলে টাই। আর পাঁচ কিংবা ছক্কা হলে জয়- এমন কঠিন ও জটিল হিসেবের মুখোমুখি টাইগার ক্যাপ্টেন।

খালি চোখে বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারি বা ছক্কা অনেক কঠিন মনে হলেও ক্রিকেটে বাউন্ডারি হয় অহরহ। প্রায় প্রতি ওভারের চারের দেখা মেলে। ছক্কাও হয় মাঝে-মধ্যে; কিন্তু পাঁচ আর তিন রান নেয়ার নজির অনেক কম। কঠিনও। তিন তবু হয়ে যায়। একদম ফাঁকা জায়গায় বল চলে গেলে তিন হয়। তাই তিনের দেখাও মেলে মাঝে মধ্যে। কিন্তু পাঁচ রান হয় কালে ভদ্রে। এটা আসলে ক্রিকেটে সব চেয়ে কঠিন ও জটিল শট। দৌড়ে পাঁচ রান নেয়া অসম্ভব। সাধারণত দু’ভাবে পাঁচের দেখা মেলে। এক, নো বলে বাউন্ডারি হলে কিংবা সিঙ্গেলসের জন্য দৌড়ানোর সময় ওভার থ্রো সীমানার বাইরে চলে গেলে।

ওসব ঘটে হঠাৎ। আজ আর সেই অতিকাকতালীয় ঘটনা ঘটেনি। মাত্র উইকেটে আসা অধিনায়ক মাশরাফির পক্ষে তাই ওই শেষ বলে এক রানের বেশি নেয়াও সম্ভব হয়নি। একেবারে কাছে গিয়েও আর জয় ধরা দেয়নি। সুতরাং, একজোড়া ফুলটসের সর্বনাশ। যত আক্ষেপ, হতাশা ও ঐ ফুলটস নিয়েই।

Advertisement

বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোন বড়সড় আসরে প্রথম ফুলটস হতাশার প্রতীক হয়ে দেখা দেয়, ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ। বিশ্ব টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে স্বাগতিক ও মহাপরাক্রমশালী ভারতের সাথে। শেষ ওভারে বাংলাদেশের জয়ের জন্য দরকার ছিল ১১ রানের। ভারতীয় পেসার হারদিক পান্ডিয়ার করা ওই ওভারের প্রথম দুই বলে বাউন্ডারি আর তৃতীয় বলে সিঙ্গেলস নিয়ে জয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশ।

এরপর প্রথমে নিজে পুল খেলতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে আউট হন মুশফিক। তাতে করে শেষ দুই বলে প্রয়োজন হয় মোটে ২ রানের। এক হলে টাই। আর ডাবলস কিংবা চার হলে জয়ের বন্দরে। এমন সমীকরণ সামনে রেখে ফুলটচ বলে ডিপ মিড উইকেট আর ডিপ স্কোয়ার লেগের মাঝামাঝি ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। তিনি ফুলটসকে হাওয়াই উড়িয়ে ছক্কা মারতে নাা গিয়ে মাটিতে খেললেই কিন্তু পরাজয় এড়ানো যেত; কিন্তু মাহমুদউল্লাহ মাটিতে খেলার বদলে গেলেন ছক্কা হাঁকাতে। তাতেই ভাগ্য বিপর্যয়। নিশ্চিত জয়ের আনন্দ মুহূর্তে পরিণত হলো পরাজয়ের বিষাদ-বেদনায়।

কেউ কেউ এই ফুলটসে ভাগ্য বিপর্যয়কে নেহায়েত বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলবেন। আবার কারো কারো চোখে হয়ত এটা কাকতালীয় ঘটনা। আসলে তা নয়। আসল ও কঠিন সত্য হলো, অতীত থেকে শিক্ষা না নেয়া।

আমরা আগেও ফুলটসে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। নিশ্চিত জয় হাতছাড়া করেছি। ‘ডেড ওভারে’ ব্যাটসম্যানকে প্রলুব্ধ করতে ফুলটস ছোঁড়া হতে পারে। আজকাল ফাস্ট বোলারদের অন্যতম কৌশল বা অস্ত্র হলো ফুলটস। ডিপ মিড উইকেটে ফিল্ডার রেখে স্লগ ওভারগুলোয় ফাস্ট বোলাররা ফুলটস ছোড়েন; যাতে ব্যাটসম্যান সঠিক ও পারফেক্ট টাইমিং করতে না পারলে সীমানার আশপাশে ক্যাচ ওঠে এই আশায়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, একই ভুল বারবার কেন হচ্ছে? কেন অতীত থেকে শিক্ষা নিলেন না সাব্বির-মুশফিক? ফুলটস পেলেই ডিপ মিড উইকেটের ওপর দিয়ে চালাতে হবে এবং ছক্কা হাঁকাতে হবে, এই মানসিকতা কেন? এটাই তো বড় ভুল। বড় ব্যর্থতা। ওঠা-নামা ও উত্থান-পতনের ম্যাচের শেষ সমীকরণতো ওই ফুলটস। যে দুই ফুলটসে সাব্বির আর মুশফিক আউট হয়েছেন, সেই দুই বলে একটি করে সিঙ্গেলস আসলেও শেষ বলে পাঁচের বদলে তিন রানের দরকার পড়তো। তখন বাউন্ডারি বা ডাবলসে ঝুঁকতেন মাশরাফি। পুরো চালচিত্রটা ভিন্ন হতে পারতো।

আক্ষেপ-অনুশোচনা যতই হোক। আসল সত্য হলো নিজের শক্তি-সামর্থ্যের প্রতি সত্যিকার ও পরিস্কার ধারণার অভাব। সাব্বির-মুশফিকরা কেন মাথায় রাখেন না যে তারা, মহেন্দ্র সিং ধোনি, গেইল, আন্দ্রে রাসেল, ড্যারেন স্যামি কিংবা কার্লোস ব্র্যাথওয়েট নন। তাদের মত শক্ত সামর্থ্য নই আমরা। শরীর, পেশি আর কব্জিতে অত শক্তি নেই আমাদের। এই বোধ-উপলব্ধি কেন নেই?

এ বোধ-উপলব্ধি কম বলেই বারবার ফুলটস বল পেলেই ছক্কা হাঁকাতে যায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের গেইল, কাইরন পোলার্ড (এ সিরিজে নেই), আন্দ্রে রাসেল, ডারেন স্যামি, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা খুব অনায়াসে ফুলটসকে সীমানার ওপারে পাঠাতে পারেন। তাদের গায়ে ও হাতে তেমন শক্তিও আছে। সে সব শক্ত-সামর্থ্যের উইলোবাজদের সঠিক টাইমিংয়ের দরকার পড়ে না খুব একটা। তাদের মিস হিটও ছক্কা হয়ে যায়।

আর সবচেয়ে বড় কথা বোঝাই যাাচ্ছিলো মুশফিকুর রহীম বেশ অনেক্ষণ ক্রিজে থেকে বেশ কিছু সিঙ্গেলস আর ডাবলস নিয়ে ক্লান্ত অবসন্ন ছিলেন। শেষ ওভারের প্রথম বলে ছক্কা হাঁকানোর আগেই তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ক্লান্ত শরীরে মাঠের সবচেয়ে বড় জায়গা দিয়ে ছক্কা মারতে যাবেন কেন? ওই ফুলটসকে বাতাসে না ভাসিয়ে অনায়াসে মাটিতে নামিয়ে খেলা যেত। তাতে ঝুঁকি থাকতো না। ছক্কা না হলেও বাউন্ডারির সম্ভাবনা থাকতো। কিংবা ডাবলস নিদেনপক্ষে সিঙ্গেলস আসতো।

আর ডিপ মিড উইকেটে যেহেতু ফিল্ডার ওঁৎ পেতে দাঁড়ানো, তাই শরীরকে আরও একটু পিছিয়ে শক্তির ওপর ভর না করে কব্জির মোচরে স্কোয়ার লেগের দিকেও ঠেলে দেয়া যেত। তাতেও ছক্কার বদলে চার রান আসার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মুশফিক গেলেন ছক্কা হাঁকাতে। ভাবখানা এমন, কোমর ও পেট সোজা ফুলটস ডেলিভারিকে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা মারতেই হবে। না হয় ‘মহাভারত অশুদ্ধ’ হয়ে যাবে।

আগের বলে একই ভুল করলেন সাব্বিরও। তার তো আর ক্লান্তি ছিল না। উইকেটে এসেছিলেন মাত্র সাত-আট মিনিট আগে। সেটা ছিল তার ১১ নম্বর ডেলিভারি মোকাবিলা। এমন অবস্থায় পেট সোজা ফুলটচ, একটু দেখে নিয়ন্ত্রণে রেখে খেলা যেত অনায়াসে। কিন্তু ভিতরে যে ছক্কার নেশা! বুদ্ধি আর কৌশল হয়ে গেল গৌণ। আবেগ আর উচ্চাকাঙ্খা- উচ্চাভিলাশ হয়ে উঠলো বড়। সাব্বির পুল আর সুইপের মাঝামাঝি এক শট খেললেন বাতাসে ভাসিয়ে। আর সেটাই কাল হলো।

শেষ ওভারের প্রথম বল ফুলটস দেখে লোভ সামলাতে পারলেন না মুশফিকও। ভাবলেন, আরে এমন সময় ফুলটস। ছক্কা হাঁকানোর মোক্ষম সুযোগ। এ সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না কিছুতেই। এমন ভেবেই বাতাসে ভাসিয়ে পুল খেলা। আর সেটা সীমানার ওপারে আছড়ে না পড়ে জমা পড়লো ক্যারিবীয় ফিল্ডার পলের হাতে। শুধু ক্যাচ নয়। ম্যাচও যে চলে গেল ক্যারিবীয়দের হাতে।

এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি