আন্তর্জাতিক

জাতীয় নির্বাচনেও পাকিস্তানে অভ্যূত্থানের ভয়

পাকিস্তানে আজ ১১তম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু দেশটিতে নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের স্বপ্ন আবারও থেমে যায় কি না, এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। ৭০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, পাকিস্তানে কখনও আপাতদৃশ্যের গণতন্ত্র এসেছে। আবার পালাবদল করে এসেছে পুরোপুরি সামরিক সরকার। এই দুই ধরনের ব্যবস্থা যেন বারবার পালাবদল করেছে। আর এই প্রক্রিয়ার মাঝে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাকিস্তানের সাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দ্বন্দ্ব এবং পাকিস্তান হয়ে উঠেছে জঙ্গী এবং সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল।

Advertisement

এবারের নির্বাচন নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কেউ কেউ 'গণতান্ত্রিক অভ্যূত্থানের' ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন। সেজন্য বরাবরের মতো এবারও সন্দেহ করা হচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে। অতীতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সরাসরি অভ্যূত্থান ঘটিয়েছে, আর তা নাহলে বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটিয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বিভিন্ন সময় নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এমন কৌশল নিয়েছে, যেন সেই সরকার আবার ক্ষমতায় আসতে না পারে।

এসব বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার বন্ধ হয়েছিল ২০০৮ সালে। সে কারণে পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো একটি নির্বাচিত সরকার ২০১৩ সালে তাদের মেয়াদ শেষ করতে পেরেছিল। তখন থেকেই আবার পাকিস্তানের গণতন্ত্রের স্রোত উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে।

সমালোচকরা বলছেন, সামরিক প্রশাসন অতীতের মতো এখন আবার পূর্ণ ক্ষমতা ফিরে পেতে পুরনো কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।

Advertisement

সন্দেহের পেছনে তিন কারণ

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সন্দেহের কেন্দ্রে এসেছে, সেজন্য তিনটি ঘটনাকে প্রমাণ হিসেবে বলা হচ্ছে।

প্রথমত, আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফসহ বেছে বেছে বিদায়ী সরকারের কয়েকজনকে অভিযুক্ত করেছে। আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, পাকিস্তানে বিচার বিভাগ বিভিন্ন আইন ব্যবহার করে বিদায়ী সরকারের ডানা কেটে দিয়ে বিরোধী পক্ষগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করছে।

ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি শওকত আজিজ সিদ্দিকীর বক্তব্যেও বিষয়গুলো উঠে এসেছে। গত রোববার রাওয়ালপিন্ডি বার এসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিচারবিভাগে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে। নওয়াজ শরিফকে যেন মুক্তি দেয়া না হয়, সেজন্য সংস্থাটি চাপ সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ করেন এই বিচারপতি।

Advertisement

গত বছর দুর্নীতির অভিযোগে সুপ্রিমকোর্টের আদেশে ক্ষমতাচ্যুত হন নওয়াজ শরিফ। নিম্ন আদালত তাকে দশ বছরের সাজা দিয়েছেন। কিছুদিন আগে তিনি দেশে ফিরে জেলে গেছেন। এদিকে, বিচারপতি সিদ্দিকী এমন বক্তব্যও দিয়েছেন যে, তিনি আইএসআই এর বিরুদ্ধে সত্য কথা বলতে ভয় পাননা। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে যদি মেরে ফেলতেও চায়, তারপরও আমি ভয় পাই না।’

দ্বিতীয়ত, এবার নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলোকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষ জঙ্গীদের কর্মকাণ্ড দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। নির্বাচনের মাত্র একদিন আগে পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে গ্রেনেড হামলা হয়েছে।

তৃতীয়ত, ভোটের প্রক্রিয়ায় বা তা পরিচালনার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার পর নির্বাচনে সশস্ত্র এই বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এসবের কিছু কিছু আলামত ইতিমধ্যেই দেখা গেছে। নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগের অনেক প্রার্থীকে দল ছেড়ে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফে যোগ দিতে অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধ্য করা হয়েছে। যারা দল ছাড়ার টোপে রাজি হননি, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে বা তাদের হয়রানি পোহাতে হচ্ছে।

প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিও চাপে রয়েছে। দলটির সিনিয়র কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ নতুন করে তোলা হয়েছে। বামপন্থী আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির গুরুত্বপূর্ণ একজন প্রার্থী গত সপ্তাহে পেশোয়ারে আত্নঘাতী হামলায় নিহত হয়েছেন। একই ধরনের হামলায় আরও দু'জন প্রার্থী নিহত হয়।

বেলুচিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী একজন প্রার্থি গিজেন মারিকে গৃহবন্দি হিসেবে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু পাশের নির্বাচনী এলাকাতেই জঙ্গী সম্পৃক্ততা আছে, এমন একজন প্রার্থী শফিক মেঙ্গাল নির্বিঘ্নে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। তার মতো নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনগুলোর অনেক প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

গণমাধ্যমও চাপের মধ্যে রয়েছে। নির্বাচনের বাছাই করা কিছু খবর প্রচারে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল কোনো একটি দলের পক্ষে যাবে, তা স্পষ্ট নয়। ফলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাতে প্রভাব খাটানো সুযোগ থাকে।

এমন পরিস্থিতি তৈরির পেছনেও সামরিক বাহিনীর কৌশল রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আর এই প্রেক্ষাপটে নিরঙ্কুশ গণতন্ত্র আসলে অনেক দূরে বলেই বলা হচ্ছে। আসলে গণতন্ত্রের আড়ালে সামরিক শক্তির অধীনে একটা শাসন ব্যবস্থা বা একটা অভ্যূত্থান হচ্ছে- এই ভয় কাজ করছে বিশ্লেষকদের মাঝে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসআর/পিআর