কৃষি ও প্রকৃতি

পিরোজপুরের খালে পেয়ারা ও নৌকার হাট

জেলার অধিকাংশ এলাকাই নদীবেষ্টিত। এই নদীই জেলার নেছারবাদ (স্বরূপকাঠী) উপজেলাকে বিভিন্ন দিক থেকে পরিচিত করেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে ঐতিহ্যবাহী পেয়ারা চাষ ও নৌকার হাট। মৌসুম ভিত্তিক ফলের এ চাষাবাদকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর প্রচুর মানুষের আগমন ঘটে। তাই পর্যটকদের বিভিন্ন সুবিধা দিতে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে পেয়ারা পার্ক। তবে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখানে সৃষ্টি হবে হাজারও কর্মসংস্থান।

Advertisement

সূত্র জানায়, শত বছরেরও বেশি সময় ধরে আটঘর কুড়িয়ানায় চাষ হচ্ছে স্থানীয় জাতের পেয়ারা। যা সারা দেশে বরিশালের পেয়ারা (বাংলার আপেল) নামে সুপরিচিত। জুন থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী ৫ মাস চলে বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ। এ মৌসুমে সহজে পথ চলাসহ ফলফলাদি বহনের প্রধান বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয় নৌকা। বছরের অন্য সময় নৌকার চাহিদা কম থাকলেও বর্ষা ও পানির মৌসুমকে কেন্দ্র করে জমে উঠছে নৌকার হাটও। আটঘর খালে বিক্রি হয় নৌকা। আশির দশকের প্রথম দিকে উপজেলা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্ব দিকে প্রায় আধা কিলোমিটার জুড়ে প্রতি সোম ও শুক্রবার মানপাশা বাজারের কাছে বসে এ হাট।

প্রতি হাটে প্রায় ৪-৫ শতাধিক নৌকা বিক্রি হয়। লোকজন বিভিন্ন জায়গা থেকে সড়ক ও নৌপথে এসে নৌকা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে কুড়িয়ানার বিখ্যাত পেয়ারা সংগ্রহ, চাঁই দিয়ে মাছ মারা, গোখাদ্য সংগ্রহ ও উপজেলার নার্সারি ব্যবসার কাজে বেশির ভাগ নৌকা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

> আরও পড়ুন- তিতির পালনে লাভবান হওয়ার সুযোগ

Advertisement

ছোট ছোট নৌকায় করে বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয় বিভিন্ন খালের ভাসমান হাটে। সেখান থেকে বড় ট্রলার, ট্রাক ও লঞ্চযোগে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বাগানে থোকায় থোকায় ঝোলা পেয়ারা আর ভাসমান হাট দেখতে প্রতি বছর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ঘুরতে আসে। এখানে এসে তারা ট্রলার অথবা নৌকা ভাড়া করে পেয়ারা বাগানে ঘুরে বেড়ায়। এসময় মাইক, সাউন্ডবক্স বাজিয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন তারা। তবে তাদের অবস্থানের কোন যথাযথ স্থান না থাকায়, তারা বিভিন্ন এলাকায় ট্রলার কিংবা নৌকাযোগে বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরে বেড়ায়। তাদের যথাযথ বিনোদনের জন্য উপজেলার আদমকাঠি গ্রামে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে পেয়ারা পার্ক। সেখানে রয়েছে খাবারসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। কেউ সেখানে রাত যাপন করতে চাইলেও তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬ শ একর জমিতে স্থানীয় জাতের পেয়ারা চাষ হয়। উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, জিন্দাকাঠী, কঠুরাকাঠী, আতা ও মাদ্রাসহ ২৬টি গ্রামে পেয়ারা চাষ হয়। ২ হাজার ২৫টি পেয়ারা বাগানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে প্রায় দেড় হাজার পরিবারের ৫ সহস্রাধিক সদস্য। পেয়ারার ফলন ভালো হলে হেক্টর প্রতি উৎপাদন হয় ৮-৯ মেট্রিক টন।

এছাড়া নৌ-হাটকে কেন্দ্র করে নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ও বলদিয়া ইউনিয়নের প্রায় ১২টি গ্রাম, নাজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কাঠমিস্ত্রীরা নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব এলাকার ২ সহস্রাধিক পরিবার দীর্ঘদিন ধরে নৌকা-বৈঠা তৈরি ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

> আরও পড়ুন- লিচু শুকিয়ে বা ফেটে গেলে যা করবেন

Advertisement

এক সময় সুন্দরী কাঠ দিয়ে এসব নৌকা তৈরি হতো। এখন বিভিন্ন কারণে চাম্বল, মেহগনি, রেইনট্রি, কড়াই, গুলাপ, আমড়া, বাদাম গাছের কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হচ্ছে। নৌকার কারিগর শাহাদাত হোসেন, জামাল আলী ও আলম মিয়া জানান, একটি নৌকা তৈরি করতে দু’জন শ্রমিকের সময় লাগে একদিন। নৌকার আকার ও কাঠের প্রকারভেদে ২-৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় নৌকা। দূর থেকে আসা পাইকাররা এখান থেকে নৌকা কিনে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করেন।

বলদিয়া ইউনিয়নের চামী গ্রামের নৌকা বিক্রেতা কবির মিয়া জানান, তিনি হাটে বিভিন্ন সাইজের ৫০টি নৌকা নিয়ে এসেছেন। নৌকার সঙ্গে বেঠা বিক্রি হয় না বলে পাশেই আলাদাভাবে বসে থাকে বৈঠার দোকান। আমইর, আমড়া, গাব, মেহগনি কাঠের বৈঠা বিক্রি হয় হাটে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ জানান, পর্যটন শিল্পটি যাতে আরও সম্প্রসারিত হয়, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

হাসান মামুন/এসইউ/জেআইএম