জাতীয়

হামলার জন্য হলি আর্টিসান কেন?

>> হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল পাঁচ-ছয় মাস আগে>> আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের দৃষ্টি আকর্ষণে হামলা>> প্রথম টার্গেট ছিল না হলি আর্টিসান>> আইএস ও আল-কায়েদার যোগসূত্র পাওয়া যায়নি>> মূল টার্গেট ছিল বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করা

রাজধানী ঢাকার যে কোনো রেস্তোরাঁ বা স্থাপনায় হামলা করে নিজেদের শক্তির জানান দিতে চেয়েছিল নব্য জেএমবির জঙ্গিরা। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে কেন হামলা হলো হলি আর্টিসানে? এর নেপথ্যের কারণ-ই বা কী ছিল?

Advertisement

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘হলি আর্টিসান তাদের প্রথম টার্গেট ছিল না। জঙ্গিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, তারা ঢাকার এমন একটি স্থানে হামলা চালাবে যেখানে বেশি সংখ্যক বিদেশি নাগরিক থাকবে। এরপর তারা বেশ কয়েকটি স্থানে যায় এবং শেষ পর্যন্ত আর্টিসানকে বেছে নেয়।’

সোমবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন তথ্য জানান। দীর্ঘ দুই বছর পর আদালতে ওই মামলার চার্জশিট জমা দেয়ার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়।

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আর্টিসানে ১ জুলাই হামলা হলেও এর পরিকল্পনা হয়েছিল পাঁচ-ছয় মাস আগে। হলি আর্টিসানের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন জোরদার ছিল না। এছাড়া আর্টিসানে হামলা করে পালানো সুবিধাজনক হবে বলে মনে করেছিল। এ কারণেই তারা হামলার দু-তিন দিন আগে আটিসানকে টার্গেট করে।’

Advertisement

হামলার জন্য ১ জুলাইকে বেছে নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হামলার দিন ছিল ২৭ রমজান। জঙ্গিরা মনে করেছিল, পবিত্র ওই দিনে এমন কাজ করলে বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে।’

তদন্ত ও চার্জশিট প্রস্তুতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণ

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ওই ঘটনায় সরাসরি যারা অংশগ্রহণ করেছিল তারা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। হামলাকারীদের মধ্যে কাউকে জীবিত গ্রেফতার করা যায়নি। ফলে তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত আলামত পরীক্ষা করা, সেগুলোর ফলাফল পর্যালোচনা করতে একটু সময় লেগেছে। নিহতদের জীবিত ধরতে পারলে অনেক তথ্য পাওয়া যেত এবং তদন্ত দ্রুত শেষ করা সম্ভব হতো।’

‘ওই ঘটনায় ১৭ বিদেশি, তিন বাংলাদেশি এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তার জীবন আমরা রক্ষা করতে পারিনি- এটিই আমাদের ব্যর্থতা। তবে আমরা চেয়েছি হত্যাকারীদের সাজা নিশ্চিত করতে যাতে নিহতদের স্বজনরা শান্তি পান। তাই তদন্ত নির্ভুল করতে সময় লেগেছে।’

হামলাকারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া

গুলশান হামলায় সরাসরি পাঁচ জঙ্গি অংশ নেন। তারা হলেন- রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।

Advertisement

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নব্য জেএমবির নেতারা টার্গেট করেছিল যে, শহরে ব্যাকগ্রাউন্ডের কিছু ছেলেকে দিয়ে তারা ওই হামলা চালাবে। সেই কারণে তারা চারজনকে বাছাই করে। তারা হলেন- আবির রহমান, রোহান ইমতিয়াজ, মোবাশ্বের ও নিবরাস ইসলাম। তাদের মধ্যে আবিরকে শোলাকিয়াতে কাজে লাগানো হয়। বাকিরা হলি আর্টিসানের জন্য গাইবান্ধায় একটি ক্যাম্পে কথিত ট্রেনিং ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ নেয়। এছাড়া ওই তিনজনকে বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত জঙ্গি অপারেশনে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পাঠানো হয়। পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাকগ্রাউন্ডের যে দুজন ছিল (উজ্জ্বল ও পায়েল) তারা অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ ছিল। তাদের ওই তিনজনের সঙ্গে দেয়া হয়।’

হামলার মোটিভ

সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান বলেন, ‘নব্য জেএমবির সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের দৃষ্টি কাড়তেই ওই হামলা চালানো হয়। তবে হামলাকারীদের কারও সঙ্গে ইসলামিক স্টেট (আইএস), আল-কায়েদা বা অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের যোগসূত্র পাওয়া যায়নি।’

হামলার কারণ হিসেবে তিনি যেসব বিষয় তুলে ধরেছেন সেগুলো হলো- দেশকে অস্থিতিশীল করা, বাংলাদেশকে জঙ্গি-রাষ্ট্র বানানো, সরকারকে কোণঠাসা করে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করা, সরকার যাতে চাপে পড়ে, বিনিয়োগকারীরা যাতে দেশ ছেড়ে চলে যায় বা না আসে, সরকার যাতে বিব্রত হয়, সরকার যাতে আসল জঙ্গিদের ধরতে না পেরে নিরীহ মানুষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করে, মানুষ যাতে অতিষ্ঠ হয় সরকারের ওপর, সাধারণ মানুষ যেন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের দৃষ্টি যেন আকর্ষিত হয়।’

দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ কী তারও একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন মনিরুল। তার ভাষায়, ‘দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা প্রযুক্তিগত, অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা পাবে। বিশ্বব্যাপী যত বড় বড় জঙ্গি সংগঠন রয়েছে তাদের অনেক অস্ত্র রয়েছে। তাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যত বেশি সংখ্যক বিদেশিকে হত্যা করা, ততই দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ লাভ করা। এ কারণেই তারা আর্টিসানকে বেছে নেয়।’

মামলার সাক্ষী ২১১ জন, প্রত্যক্ষদর্শী ১৭ জনের জবানবন্দি রেকর্ড

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘হামলার ওই ঘটনায় ১৭ জন সার্ভাইভার, যারা ভেতরে ছিলেন তাদের জবানবন্দি বিজ্ঞ আদালতে রেকর্ড করানো হয়েছে। এছাড়া উদ্ধারকৃতদের মধ্যে কিছু বিদেশি ছিল, যারা পরবর্তীতে সাক্ষ্য প্রদানে যথাসময়ে উপস্থিত নাও থাকতে পারেন, তাই বিধিমোতাবেক বিজ্ঞ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করানো হয়। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত আলামতগুলো ফরেনসিক করানো হয় এবং প্রাপ্ত অস্ত্রসমূহ ফরেনসিক করে রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়। কিছু আলামত দেশের বাইরেও পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোও হাতে আসার পর যথাযথ পর্যালোচনা করা হয়।’

ওই মামলার সবমিলে মোট সাক্ষীর সংখ্যা ২১১ জন। ১৪৯ জন ঘটনা সম্পর্কে জানেন কিংবা ঘটনা দেখেছেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জানেন (অপারেশনে অংশ নেয়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ)। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত ৭৫টি আলামত আদালতে পাঠানো হয়েছে।

যে কারণে বাদ পড়লো হাসনাত করিমের নাম

চার্জশিট থেকে হাসনাত করিমের নাম বাদ দেয়া প্রসঙ্গে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আর্টিসানে হামলার ঘটনায় করা মামলার এজাহারে আসামির কলামে কারও নাম ছিল না। এজাহারের বডিতে হাসনাত করিমের নাম ছিল। আর্টিসান থেকে যাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল এমন ১৭ জন এবং যেই ছয় আসামিকে জীবিত উদ্ধার করে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দি ও আলামত যাচাই করে যাদের সম্পৃক্ততার নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে চার্জশিটে তাদের নাম দেয়া হয়েছে।

হামলা সম্পর্কে হাসনাত করিমের ব্যাখ্যা কী- জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নব্য জেএমবির একটি সাংগঠনিক পরিকল্পনা নিয়ে ওই হামলা করা হয়। তাদের ওই পরিকল্পনার কোথাও হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এছাড়া যারা জীবিত গ্রেফতার হয়েছেন তাদের কথায়ও হাসনাত করিমের নাম আসেনি। সুতরাং হাসনাত করিমের দেয়া ব্যাখ্যার চাইতেও অন্যান্য যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাদের জবানবন্দির ওপর নির্ভর করেছি এবং চার্জশিটে আদালতকে সেভাবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।’

হামলার পর সেদিনের প্রকাশিত একটি ছবিতে জঙ্গিদের সঙ্গে হাসনাত করিমের আচরণ স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। ওই ছবি বিশ্লেষণ করে কি পাওয়া গেল- এ প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সেই ছবিগুলো আমরা বিশ্লেষণ করেছি। সেই বিশ্লেষণের ফলাফলও আদালতে ব্যাখ্যা করেছি।’

আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর (আইএস, আল-কায়েদা) সম্পৃক্ততা নেই

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ওই ঘটনায় তামিম, সারওয়ার, মারজানের মতো নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের কাউকেই জীবিত গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তারা বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। তাদের জীবিত গ্রেফতার করতে পারলে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হতে পারতাম। তবে তামিম যেহেতু নেতা, আন্তর্জাতিক কারও সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারই করার কথা ছিল। কিন্তু তাকে ধরতে আমরা যখন অভিযান চালাই এর আগেই ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলো সে পুড়িয়ে ফেলে। এছাড়া আমরা বাকি যে ছয়জনকে জীবিত গ্রেফতার করি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং আমাদের টেকনোলজিক্যাল এভিডেন্সে বিদেশি কোনো সংগঠন, আইএস, আল-কায়েদা, হিজবুত তাহরির কিংবা অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য আমরা পাইনি।

চার্জশিটে উঠে এসেছে যাদের নাম

চার্জশিটে ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আটজন বিভিন্ন অভিযানে এবং পাঁচজন হলি আর্টিসানেই নিহত হন। এছাড়া জীবিত আটজনের মধ্যে ছয়জন কারাগারে এবং বাকি দুজন পলাতক রয়েছেন।

গুলশানে হলি আর্টিসানে সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ নিহত পাঁচজন হলেন- রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।

বিভিন্ন ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযানে নিহত আটজন হলেন- তামীম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ান জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।

কারাগারে থাকা ছয় আসামি হলেন- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র‌্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান এবং হাদিসুর রহমান সাগর।

এছাড়া পলাতক দুই আসামি হলেন- শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে গ্রেফতারি পরোয়ানা চাওয়া হয়েছে।

জেইউ/এআর/জেএইচ/এমএআর/আরআইপি