মীর আব্দুল আলীম
Advertisement
প্রকৃতি এমন আচরণ করছে কেন? আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে কেন? বৈশাখে আষাঢ়ের আচরণ, যথা সময়ে শীত আসছে না, গরমে শীত-শীতভাব; বর্ষায় বৃষ্টি কম, এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহভাবে হাজির হয়েছে বাংলাদেশের সামনে। জলবায়ু পরিবর্তেনের প্রভাব যতই চরম রূপ লাভ করছে এবং দৃশ্যমান হচ্ছে ততই তার বিরূপ প্রভাবে পানি ও বাতাসবাহিত রোগ-ব্যাধি, অপুষ্টি, দুর্যোগকালীন মৃত্যু ও আঘাতের হার বাড়ছে। গড় তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকায় ঋতুর আচরণ বদলে গেছে, এতে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার কৃষির ওপর ইতোমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের নিচু ও উপকূলীয় এলাকা বেশি বন্যা ও ঘূণির্ঝড়ের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণা বলছে, আগামীতে এ ধরনের দুযোর্গ আরও শক্তি নিয়ে আসবে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার প্রয়াস দ্রুততার সঙ্গে জোরদার করার বিকল্প থাকা সঙ্গত নয়। জলবায়ু পরিবতর্নজনিত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। কেন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়লো বাংলাদেশ?
Advertisement
আমরা মোটেও পরিবেশ সচতন নই। যারা দেশের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে আছেন তারাও আশানুরুপ কিছু করছেন তা দৃশ্যমান নয়। তাই বাংলাদেশের পরিবেশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দিন দিন যেভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে তাতে আমরা সত্যিই শংকিত ও হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ুও ভয়ঙ্করভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।
ভৌগোলিক কারণেই পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিছুতেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সৌরশক্তি ও কৃষি গবেষণায় আরও বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিদেশী বিনিয়োগ ছাড়াও পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) উপর বিশেষ জোর দিতে হবে।
সবমিলিয়ে আরও বড় পরিসরে সমন্বিত আঞ্চলিক উদ্যোগ প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ দরকার। ক্ষতি ঠেকানোর জন্য বাঁধ সংস্কারসহ আমরা নানা ধরণের উদ্যোগ নিচ্ছি। দেশে পরিবেশ বান্ধব বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও বাড়াতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি ও দেশীয় শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক দেশে বন্যা হলে তার প্রভাব গিয়ে পড়ছে অন্য দেশে। তবে ক্ষরার ক্ষেত্রে দেখা যায় উল্টোচিত্র। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আঞ্চলিক সমন্বিত উদ্যোগ আরও বাড়ানো দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের এ্যাকশন প্ল্যান দরকার।
Advertisement
জলবায়ু পরিবতের্নর বতর্মান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ঝুঁকির মধ্যে থাকা বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলোর ১৩ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের মাথাপিছু জিডিপি ১৪.৪ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে মনে করছে বিশ্ব ব্যাংক। সংস্থাটি মনে করছে, এতে আথির্ক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭১ বিলিয়ন ডলার। তথ্য অনুযায়ী, ঝুঁকির শীষের্ থাকা ১০ জেলা হলো- কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। এর মধ্যে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষ।
পরিবেশ নিয়ে ভাবনাটা আমাদের দেশে হয় না বললেই চলে। অন্য দেশের কার্বনের ভারে আমরা নতজানু। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। এখানে কার্বন নিঃসরণের যে মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে কম পরিমাণে কার্বন নির্গত হয়।
আবার আমাদের দেশে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সুন্দর বনের গাছ, লতাগুল্ম, বনের মাটির প্রকৃতি, গাছপালার পরিমাণ প্রভৃতি হিসাব করে দেখা যায়, এই বনের কার্বন শোষণের ক্ষমতা রয়েছে অত্যধিক। এরপরও আমরা উন্নত বিশ্বের নির্গত কার্বনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
কার্বনের প্রভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন বৃদ্ধির কারণে ভূপৃষ্ঠের বরফ গলে আশঙ্কাজনক হারে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে না যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোও। যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে মিয়ামি বিচ, লুইজিয়ানা ও টেক্সাস উপকূল।
বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের বরফগলা পানিসহ উজানের নেপাল ও ভারতের বৃষ্টিপাতের পানি, বাংলাদেশের প্রধান নদনদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। এভাবে দেখা যায়, প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১০৯৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ১৫ লাখ হেক্টর চাষের জমি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন এদেশের কৃষিখাতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার কারণে এদেশের প্রধান অর্থকারী ফসল হলো ধান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবে দিনে দিনে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধানচাষ। অসময়ে বন্যা, বৃষ্টি এবং প্রবল শিলাবৃষ্টির কারণেও ধানচাষ ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশের সোনালি আঁশ, পাটের উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাষিরা পাট চাষে বিমুখ হয়ে পড়ছেন। পাট চাষের ক্রমাবনতির জন্য বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। শীতকালের স্থায়িত্ব কমে যাওয়ায় রবিশস্যের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার শৈত্যপ্রবাহের ফলে সরিষা, মসুর, ছোলাসহ বিভিন্ন ফসলের উত্পাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসবের ফলে সারাবিশ্বে যে জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত দেখা দিয়েছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই।
জলবায়ু যে এতটা ভয়ঙ্কর, কী করছি আমরা? অশুভ কিছু ঘটার আগেই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বেঁচে থাকার উপযোগী বিশ্ব গঠনে গাফিলতির অবকাশ নেই। আর সময়ক্ষেপণ নয়, এবার কিছু একটা করতে হবে। কারণ, দ্বিতীয় কোনো বিশ্ব নেই, যাকে আমরা নিরাপদ ভাবতে পারি।
জলবায়ু পরিবর্তেনে জন্য বাংলাদেশ বা তার মতো দেশগুলো দায়ী নয়, দায়ী ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো। কিন্তু এর খেসারত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই বেশি দিতে হচ্ছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ক্ষতি মোকাবেলায় ধনী ও উন্নত দেশগুলো তেমন সহযোগিতা না করা অত্যন্ত হতাশার। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনেন প্রভাবজনিত সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ সমস্যা দূর করতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ- পদক্ষেপ অত্যাবশ্যক।
এ ব্যাপারে ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোরই অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে অনেক সজাগ নয়। বিশ্ব যেভাবে চলছে, তাতে উষ্ণতা বৃদ্ধি এড়ানো বড়ই কঠিন। তাতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম