ধর্ম

লেনদেনে সাক্ষী-প্রমাণে কুরআনের বিধান

লেনদেন তথা ঋণ দেয়া-নেয়ায় স্বচ্ছতা না থাকলে মানুষের মাঝে দ্বন্দ্ব কলহ সৃষ্টি হয়। সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি পরম বন্ধুও শত্রুতে পরিণত হয়।

Advertisement

আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে সুদের লেনদেনকে হারাম ঘোষণা করেছেন। আবার বিনা লাভে উত্তম ঋণ তথা করজে হাসানা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেছেন। যে ঋণে সাদকার সাওয়াবও রয়েছে।

আবার করজে হাসানা তথা উত্তম ঋণ দেয়ার আগে আল্লাহ তাআলা লেনদেনে সাক্ষী ও লিখিত দলিল সম্পাদনের কথা উল্লেখ করে দীর্ঘ এক আয়াত নাজিল করেছেন।

যারা শুধু আয়াতের অনুবাদ পড়বে; তারা বুঝতে পারবে লেনদেনে স্বচ্ছতার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কতটা গুরুত্ব প্রদান করেছেন। স্বাভাবিকভাবে এ আয়াতের গুরুত্ব অনুধাবন করতে তাফসিরের সহায়তাও লাগবে না।

Advertisement

লেনদেন তথা ঋণ দেয়া-নেয়ায় স্বচ্ছতার লক্ষ্যে সাক্ষী ও দলিল সম্পাদনের বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন-

يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنوا إِذا تَدايَنتُم بِدَينٍ إِلىٰ أَجَلٍ مُسَمًّى فَاكتُبوهُ ۚ وَليَكتُب بَينَكُم كاتِبٌ بِالعَدلِ ۚ وَلا يَأبَ كاتِبٌ أَن يَكتُبَ كَما عَلَّمَهُ اللَّهُ ۚ فَليَكتُب وَليُملِلِ الَّذي عَلَيهِ الحَقُّ وَليَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ وَلا يَبخَس مِنهُ شَيئًا ۚ فَإِن كانَ الَّذي عَلَيهِ الحَقُّ سَفيهًا أَو ضَعيفًا أَو لا يَستَطيعُ أَن يُمِلَّ هُوَ فَليُملِل وَلِيُّهُ بِالعَدلِ ۚ وَاستَشهِدوا شَهيدَينِ مِن رِجالِكُم ۖ فَإِن لَم يَكونا رَجُلَينِ فَرَجُلٌ وَامرَأَتانِ مِمَّن تَرضَونَ مِنَ الشُّهَداءِ أَن تَضِلَّ إِحداهُما فَتُذَكِّرَ إِحداهُمَا الأُخرىٰ ۚ وَلا يَأبَ الشُّهَداءُ إِذا ما دُعوا ۚ وَلا تَسأَموا أَن تَكتُبوهُ صَغيرًا أَو كَبيرًا إِلىٰ أَجَلِهِ ۚ ذٰلِكُم أَقسَطُ عِندَ اللَّهِ وَأَقوَمُ لِلشَّهادَةِ وَأَدنىٰ أَلّا تَرتابوا ۖ إِلّا أَن تَكونَ تِجارَةً حاضِرَةً تُديرونَها بَينَكُم فَلَيسَ عَلَيكُم جُناحٌ أَلّا تَكتُبوها ۗ وَأَشهِدوا إِذا تَبايَعتُم ۚ وَلا يُضارَّ كاتِبٌ وَلا شَهيدٌ ۚ وَإِن تَفعَلوا فَإِنَّهُ فُسوقٌ بِكُم ۗ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ وَيُعَلِّمُكُمُ اللَّهُ ۗ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيءٍ عَليمٌ

আয়াতের অনুবাদ

‘হে ঈমানদারগণ! যখন কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য তোমরা পরস্পরের মধ্যে ঋণের লেনদেন কর; তখন তা লিখে রাখ।উভয় পক্ষের মধ্যে ইনসাফের ভিত্তিতে এক ব্যক্তি (ঋণের লেনদেন সম্পর্কিত) দলিল লিখে দেবে। আল্লাহ যাকে লেখাপড়ার যোগ্যতা দান করেছেন তার (দলিল) লিখতে অস্বীকার করা উচিত নয়।

Advertisement

সে (লেখক) লিখবে এবং লেখার বিষয়বস্তু ঋণ গ্রহীতা বলে দেবে। তার রব আল্লাহকে তার ভয় করা উচিত। যে বিষয় স্থির হয়েছে তার থেকে যেন কোনো কিছুর কম-বেশি না করা হয়।

কিন্তু ঋণ গ্রহীতা যদি বুদ্ধিহীন কিংবা দুর্বল হয় অথবা লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে না পারে, তবে তার অভিভাবক ইনসাফ সহকারে লেখার বিষয়বস্তু বলে দেবে। তারপর নিজেদের পুরুষদের মধ্য থেকে দুই ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখ।

আর যদি দুই জন পুরুষ পাওয়া না যায় তাহলে একজন পুরুষ ও দুই জন নারী সাক্ষী রাখ। যাতে একজন নারী ভুলে গেলে অন্য জন তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে।

এসব সাক্ষী এমন লোকদের মধ্য থেকে হবে, যাদের সাক্ষী তোমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। (প্রয়োজন হলে) সাক্ষীদেরকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ডাকলে বা বললে তারা যেন সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার না করে।

আর ঋণ কম হোক কিংবা বেশি হোক (ফেরত দেয়ার) সময়সীমা নির্ধারণ সহকারে দলিল সম্পাদনের ব্যাপারে তোমরা গড়িমসি/অবহেলা/অলসতা/শৈথিল্য করো না।

আল্লাহর কাছে তোমাদের এ দলিল সম্পাদন অধিকতর ন্যায়সঙ্গত। এর মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা বেশি সহজ হয় এবং তোমাদের সন্দেহ-সংশয়ে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

তবে তোমরা পরস্পরে ব্যবসায় যে নগদ দেয়া-নেয়া করে থাক তা না লিখলে কোনো দোষ নেই। তোমরা যখন পরস্পর বেচা-কেনা কর, তখন সাক্ষী রাখ।

(ঋণের লেনদেন, আদান-প্রদানে জড়িত) সাক্ষী ও (দলিল) লেখকদের কষ্ট দিও না। যদি তোমরা তাদের কষ্ট দাও তবে এমনটি হবে গোনাহের কাজ।

তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তোমাদের শিক্ষা দেন। আর আল্লাহ সব বিষয়ে মহাজ্ঞানী।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৮২)

আগের আয়াতগুলোতে দান-খয়রাতের ফজিলত, নিয়ম-কানুন; সুদের শোচনীয় পরিণাম ঘোষিত হয়েছে। আর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা লেনদেনে স্বচ্ছতার বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছেন। ঋণ গ্রহণ বা ব্যবসায়িক কাজে যাতে সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট না হয়। দ্বন্দ্ব-কলহ সৃষ্টি না হয়।

আরও পড়ুন- মৃত্যুর দিনকে ভয় করতে হবে কেন? (সুরা বাকারা : আয়াত ২৮১)

উল্লেখিত সুদীর্ঘ আয়াতের মাধ্যমে মানুষকে তাদের অর্থ-সম্পদ সংরক্ষণের বিশেষ পন্থা অবলম্বনের নীতিমালা ও তাগিদ দেয়া হয়েছে। আর এ বিষয়ে ঈমানদারদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে।

এ সব লেনদেনে ঋণ গ্রহীত, লেখক, সাক্ষী সবাইকেই সঠিক পথে থেকে আল্লাহকে ভয় করার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। কেউ যাতে ইনসাফের বাইরে চলে না যায়।

আবার ঋণের পরিমাণ যত ছোট হোক কিংবা বড়ই হোক না কেন; ঋণ ফেরতের সময়টিও যেন সুস্পষ্ট করা হয় তাও দলিলে সম্পাদনের বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যাতে অলসতা করতে নিষেধ করা হয়েছে।

আবার সাধান ব্যবসা-বাণিজ্য বা দোকানদারিতে বকেয়ার বিষয়েও লিখে রাখতে বলা হয়েছে। আর নগদ লেনদেনের ব্যাপারে না লিখলে কোনো ক্ষতি নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সর্বোপরি...

যে কোনো লেনদেন, ঋণ আদান-প্রদানে দলিল সম্পাদন ও সাক্ষ্য রাখা একান্ত জরুরি। যা আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ওহি নাজিল করে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন।

বর্তমান সময়ে এর প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। সাক্ষী ও দলিল সম্পাদনের পরও লেনদেন ও ঋণ কার্যক্রমে অনেক অস্বচ্ছতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। যা সমাজে অশান্তি থেকে শুরু করে রক্তপাত পর্যন্ত গড়ায়।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ‍ঋণ গ্রহণ বা দেয়া-নেয়া তথা লেনেদেনের প্রতিটি বিষয়ে কুরআনের বিধান যথাযথ পালন করার তাওফিক দান করুন। এ বিধানের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/পিআর