আমাদের প্রজন্মতো বটেই আমাদের সন্তান বা তাদের সন্তানদের প্রজন্মও এখনও দেশটিকে কৃষিযুগের বাইলে পুরোপুরি চিহ্নিত করার অবস্থাতে নেই। এতো নগরায়ণ, ব্যবসা বাণিজ্যের ডিজিটাইজেসন কিংবা জীবনধারার রূপান্তরের পরও বাংলাদেশকে এখনও একটি বড় গ্রাম হিসেবে অনুভব করা যায়। তবে বিশ শতকের মাঝামাঝিতে আমাদের প্রজন্ম যখন কৃষি যুগ থেকে বের হবার লড়াই করে তখন প্রধানত আমাদের মা-বাবারাই আমাদের হাত-পায়ের শেকল খুলে দিয়েছিলেন।
Advertisement
আমি আমার নিজের বাবা-মা যারা আজ আর বেঁচে নেই তাদের বিষয়গুলো আলোচনা করে আমাদের প্রজন্মের লড়াইটাকে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করতে চাই। তবে আমি নিশ্চিতভাবেই এটি বলতে পারি যে আমার বাবা-মার ইতিহাসটা আমার প্রজন্মের সকলের বাবা-মারই ইতিহাস। গল্পের পাত্র-পাত্রী-প্রেক্ষিত বা ঘটনাপ্রবাহে বৈচিত্র্য থাকলেও আমরা সবাই প্রায় একই লড়াই করে এই পথ পাড়ি দিয়েছি। বাংলাদেশের সকল মা-বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার অভিজ্ঞতা এবং মূল্যায়ন তুলে ধরছি।
প্রেক্ষিত: একুশে জুলাই আমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮ জুলাই ছিলো বাবার মৃত্যু বার্ষিকী। বাবার মৃত্যুবার্ষিকীটা একটু ভিন্ন মাত্রা পায় তার জীবনকালের বহুমুখী কাজের জন্য। তিনি আমাদের চারপাশে পীর সাহেব নামে পরিচিত। নিজে আরবী হিসাবে সব করতেন তাই আমার বাবার উত্তরসূরী পীর আমার ছোট ভাই কিবরিয়া জব্বারসহ সকলেই চাঁদের মাসের হিসাবেই তার ওরস করে থাকে। তবে আমার মার মৃত্যুবার্ষিকী প্রধানত পালন করে তার স্কুলের ছাত্রীরা-ওরা ইংরেজি হিসাবেই পালন করে।
আমার মা: আমার মা এক অসম সাহসী রমনীর নাম- রাবেয়া খাতুন। আমার নানা তাপসী রাবেয়া বসরীর নামে তার বড় মেয়ের নাম রেখেছিলেন। তার পরের দুই মেয়ের নাম আছিয়া ও আয়েশা। তাদের কোন ছেলে ছিলোনা। ১৯৪৮ সালে ১৪/১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। বাবার সাথে মার বয়সের ব্যবধান হয়তো প্রায় ৩০ বছর। এটি ছিলো বাবার দ্বিতীয় বিয়ে। মায়ের বিয়ের এক বছর পরেই ১২ আগস্ট ৪৯ আমি জন্মাই। তখনও তিনি আমার নানার বাড়িতে থাকেন। কখনও শ্বশুর বাড়ি দেখেননি।
Advertisement
আমি আস্তে আস্তে নানার বাড়িতে বড় হই-হাঁটতে শিখি। তখনই শ্লোগান দিতে শিখি-নুরুল আমিনের কল্লা চাই। খালা ও নানার কাঁধে চড়ে স্কুলেও যাই। বয়স সম্ভবত ৪ বছর। তখনই এক সময়ে মা বেঁকে বসলেন। বাবার সাথে লড়াইতে নামলেন। তিনি তার বাবার বাড়িতে থাকবেন না, তাকে তার নিজের শ্বশুর বাড়িতে নিতে হবে। বাবার তখন আলাদা সংসার। দাদা-দাদীর মৃত্যুর পর তারা পাঁচ ভাই আমার দাদার সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
বাবার নিজের ভাগের জমিজমা প্রায় শ খানেক বিঘা। ১৬০ শতাংশের বাড়ি। সব পতিত। কেউ দেখার নেই। মা জোর করে গেলেন নেত্রকোণা জেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। হাল ধরলেন সংসারের। এখনকার আইনে শিশু বয়সী মা তার নতুন সংসারকে সাজাতে গিয়ে দেখলেন তিনি কিছুই জানেন না। গোবরের চট লেপা, গরুকে খাবার দেয়া, কামলাকে ভাত-তরকারি রেধে দেয়া, নদী থেকে পানি আনা, কামলা মেয়েদেরকে দিয়ে কাজ করানো সবই অজানা। গ্রামের কেউ তার পাশে নেই। বাবা বাইরে বাইরে থাকেন-রান্না ঘর থেকে হাওরের জমি এবং সন্তানের লেখাপড়া একাই সামাল দেন। মাঝে মাঝে হাতে টাকাও থাকেনা।
বাবা বৈশাখ মাসে বাড়ি ফিরে গোলার ধানটা বেচে টাকাটা পকেটে করে আবার দেশে দেশে ঘুরতে চলে যেতেন। মার হাতে কি থাকলো সেটি কোনদিন জানতেনওনা। মা তার সহযোগী ছিলেন আব্বাস আলী কাকু ও তার ভাই, আসমত আলী, আশরাফ আলী ও জনাব আলীসহ কামলা-গোমস্তারা। মা প্রথমেই যে কাজটি করলেন, সেটি অসাধারণ। আমাকে গরু রাখতে রাখাল বানিয়ে মাঠে না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠালেন।
আমার গ্রামে তখন ২/৩ জন শিশুও স্কুলে যেতোনা। মা যে কেবল স্কুলে পাঠালেন সেটিই নয়, তিনি সন্ধ্যায় পড়াতে বসতেন। এক সময়ে যখন দেখলেন নিজে পড়াতে সময় পাননা তখন বাড়িতে একজন মাস্টার রাখলেন। তারপর তিনি গ্রহণ করেন আরও একটি দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত। ছেলেকে হাইস্কুলে পড়ানোর দুঃসাহস করলেন। খুব সহজে ছেলেকে তার নানার বাড়িতে পাঠিয়ে হাই স্কুলে পড়াতে পারতেন।
Advertisement
কিন্তু বাবা রাজী না হওয়ায় গ্রাম থেকে ৪০ কিলোমিটারের ভেতরে যখন কোন হাই স্কুল পেলেন না তখন ৪০ কিলোমিটার দূরের হাইস্কুলে বোর্ডিং-এ রেখে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মাসে ২০ টাকা (দুই মণ ধান) এবং ২০ কেজি চাল দিতেন নিজের সংসার থেকে। এরপর পাঠিয়ে দিলেন ঢাকা কলেজে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তাকে আমার জন্য প্রতি মাসে ১৫ মন ধান বেচতে হতো। লোকজন মাকে নানা কথা বলতো। মা বলতেন, আমার ছেলের দাম সকলের হাজার বিঘা জমির চাইতে বেশি।
তখনকার দিনে সেই গ্রামে কে বোঝে সেই কথা। নিজের অন্য ছেলেমেয়েগুলোকেও একইভাবে শিক্ষায় জড়িয়ে নিলেন। মার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় বস্তু শিক্ষা। শিক্ষাই শক্তি। বাড়িতে হিন্দু মুসলমানে ভরে থাকতো। মা বলতেন, মানুষে মানুষে ধর্ম দিয়ে ফারাক করবানা। নিজে নামাজ রোজা করেছেন-কিন্তু কোনদিন কোন হিন্দুর সাথে একটুও খারাপ ব্যবহার করতেন না। তারা তাকে মা ডাকতো।
আমার বাবার পুরো জীবনটা ছিলো সাধারণ মানুষের জন্য। তিনি হাওরের প্রত্যন্ত, মানুষকে বিনে পয়সায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দেবার পাশাপাশি গ্রামে কবরস্থান, ঈদগা, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল সবই নিজের উদ্যোগে নিজের অর্থে প্রতিষ্ঠা করেন। তার জন্য আমার গ্রামটি এখন হাওরের শিক্ষা নগরী। বাবার পাশাপাশি মাও কৃষ্ণপুরকে শিক্ষা নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লড়াই করেন।
যখন একটু বেড়ে ওঠি মা তখন তার হাতিয়ার হিসেবে আমাকে ব্যবহার করা শুরু করেন। মায়ের উৎসাহেই ৬৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে নিজের গ্রামে একটি হাই স্কুল দাঁড় করালাম। ৭২ সালে বাবা সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করলেন। এরপর ৮৬ সালে আমি প্রতিষ্ঠা করলাম ভাটি অঞ্চলের প্রথম কলেজ। সেটি এখন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। যদিও সেই কলেজের সভাপতির পদ থেকে এক সময় বিএনপির লোকেরা আমাকে বিতাড়িতও করেছিলেন তথাপি এটি এখন হাওর এলাকার আলোকবর্তিকা।
নব্বুই দশকের শুরুতে বাড়িতে গিয়ে চারপাশ দেখে মাকে জিজ্ঞেস করতাম, মা স্কুল-কলেজ হলো, লোকজন লেখাপড়াও করছে কিন্তু গ্রামটাতো বদলাচ্ছেনা। মা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, বাবারে পুরুষ মানুষ ঘর সংসার তৈরিও করতে পারেনা, বদলাতেও পারেনা। আমার মাকে দেখলে সেই কথা সবাই বলতো। ততোদিনে পুরো গ্রামে মায়ের শত শত ভক্ত। আমার বাবার বাউন্ডুলে জীবনটাকে নিয়মে এনেছিলেন মা-ই। সবাই ডাকতো পীর মা। গ্রামের দুরাবস্থার কথা শুনে তিনি বললেন, পারলে একটি মেয়েদের স্কুল কর।
মা জানতেন, আমি পারব। মায়ের কথায় ৯৬ সালে দাদার সম্পত্তিতে নিজের খরচে মা-বাবার নামে মেয়েদের স্কুল করলাম। প্রথম বছরেই স্কুলটা ছাত্রীতে ভরে গেল। মা বললেন, বাবারে, স্কুলটা অনেক দূরে-আমি যেতে পারিনা-আমার বাড়ির সামনের জমিটাতে স্কুলটা নিয়ে আয়। তোরা জমি দিয়ে কি করবি-জমিগুলো স্কুলেই যাক।
মার কথায় আমরা ভাইবোনেরা বাড়ির সামনে ভাল জমিগুলো স্কুলেই দিয়ে দিলাম। সেই স্কুল আজ আমার মায়ের মতো শত শত মা তৈরি করছে। ২০১৪ সালের জুন মাসে আমি আমার গ্রামে গিয়ে একটু জরিপ করে দেখেছি-মাই ঠিক বলেছিলেন। যে গ্রামে একজন মানুষ পায়ে জুতা দিতোনা, একজন দাঁত ব্রাশ করতোনা বা একটি পাকা ল্যাট্রিন ছিলোনা বা কারও বাড়িতে যেখানে বসার একটি চেয়ার ছিলোনা সেই গ্রামে খালি পায়ের একটি শিশু দেখিনি এবং এমন কোন বাড়ি পাইনি যেখানে পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। মায়ের নামের স্কুলের মেয়েরা পুরো গ্রামটাকে বদলে দিয়েছে।
মা তোমাকে অনেক মনে পড়ে। তোমার জন্যে আমার গ্রামের মূর্খ মেয়েরা এখন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওরাই এখন তোমার মুখ। সুযোগ পেলেই আমি তার ছবি দেখি। প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি তোমার আদর। মাযে কতো বড় তার একটি বড় দৃষ্টান্ত আমার জীবনে আছে। আমি আমার মধ্য বয়সে একটি বড় ভুল করি। আমার পরিবারের সবাই আমার সেই ভুলটিকে ক্ষমা করলোনা। তখন আমার মা-ই একমাত্র বলেছিলেন-আমার ছেলে কোন ভুল করতে পারেনা। কোথাও কোন ভুল বোঝাবুঝি আছে। আমার ছেলে খুন করলেও আমি তার পাশে আছি। ওর জায়গা আমার বুকে। আমি জানিনা তুমি আমার মা না হলে আমি কী হতাম।
আমি জানিনা, তুমি সেই গ্রামে না গেলে ঐ গ্রামের ছেলেমেয়েদের কি হতো! আমার বাবার কথা, আমার জন্মের সময় তিনি মাঝ বয়সের। যদিও আমি তার প্রথম ছেলে তবুও প্রথম সন্তান নই। আমি তার দ্বিতীয় বিয়ের প্রথম সন্তান। ফলে আমিই তাকে পিতা হবার প্রথম আনন্দ দিইনি। যেমনি অন্য বাবার হয় তিনি তেমন ছিলেনওনা। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। সুফি মতবাদে বিশ্বাস করতেন। ছেলেকে কবে কতোবার কোলে নিয়েছেন বলা যাবেনা। আমি নিজে বাবার কোলের কথা মনেই করতে পারিনা। নানার বাড়িতে জন্ম।
নানা-নানী, খালা-বড়মার কোলে কোলে মানুষ আমি। শৈশবটাতো ওখানেই কেটেছে। যদিও জন্মেছি এক মায়ের কোলে তবে আমার মা ছিলেন অনেক। নানী আমার মায়ের চাইতেও বেশি ছিলেন। তার জন্য মা নিজেই আমাকে কোলে নিতে পারতেন না। ছিলেন দুই খালা। মাথায় রাখতেন না উকুনে খাবে বলে। মাটিতে রাখতেন না পিঁপড়ায় কামড়াবে বলে। ছিলেন বড় মা-নানীর মা। তিনি এলেতো কোন কথাই নাই। আর কেউ আমাকে ছুঁতেই পারতোনা।
শৈশবে, কৈশোরে বা তারুণ্যে সেই বাবার সাথে কদাচিৎ দেখা হতো। খুব ভাল কারণে দেখা হতোনা। মার খাবার জন্য তিনি যমদূতের মতো হাজির হতেন। প্রাইমারিতে পড়ার সময়ই বেশি মার খেয়েছি। ক্লাশে প্রথম হতাম তবুও আরও ভাল করার জন্য মার খেতাম।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে ৫ মিনিট দেরি হলে মার খেতাম-গ্রামের রাখালটার সাথে ডাংগুলি খেললে মার খেতাম। আমার মা অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখতেন। কেবল বড় ফুফু আমাকে বাবার মারের হাত থেকে বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু থাকতেন আমাদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে। তিনি খবর পেয়ে আসতে আসতে আমার মার খাওয়া শেষ হয়ে যেতো।
একবার আমার এক শিক্ষক ফসলের মাঠে বসিয়ে কবিতা আবৃত্তি করিয়েছিলেন। সেজন্য এমন মার খেলাম যে রাতে জ্বর এসে গেলে। রাতে জ্বরের ঘোরে টের পেলাম; মা মাথায় পানি পট্টি দিচ্ছে-আর বাবা ওষুধের বাক্স নিয়ে বসে আছেন। তার মুখে আমি কখনও আদরের হাসি দেখিনি। তবুও কেন জানি বাবার চারপাশেই ঘুরঘুর করতাম। বাবা মারছেন, আমি পালিয়েছি এমনটা মনে করতে পারিনা। বাবা আমার জন্য মুক্তচিন্তার আধার ছিলেন। বাবার সাথে দুনিয়ার সকল বিষয় নিয়ে তর্ক করেছি। বাবাকে কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি। বাবার সাথে মতের মিল না হবার জন্য কোনদিন মার খাইনি।
যখন কলেজে পড়ি, তখন বাবা গ্রামের মানুষকে গর্ব করে বলতেন, আমার ছেলে তোমাদেরকে কিছু একটা দেবে। কিন্তু সেই বাবাই ঢাকা কলেজে পড়ার সময় মুকাসিন জুতা দিয়ে পিটিয়েছেন। এখনও আমি বাবার হাতে মার খাবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাইনা। কিন্তু কেন জানি মনে হয় ঐ মারটাই আমাকে আজকের ব্যক্তিটি বানিয়েছে।
আমার গ্রামে লেখাপড়া নামক শব্দটা আমার পরিবারে ও এর বাইরের দুয়েকটি ব্যক্তিতে সীমিত ছিলো। আমার পরিবারের লোকজন ততোদিনে এসএসসি অবধি লেখাপড়া করেছেন। আমার জ্যাঠা প্রায়ই বাবাকে বলতেন, ছেলেকে পড়ালে তোর জমি বেচতে হবে। বাবা হাসতেন আর বলতেন, আমার ছেলের লেখাপড়ার দাম জমির দামের চাইতে বেশি। তিনি এমনটা না ভাবলে আমি গরুর রাখালই হতাম। বাবা এমন রাগি ছিলেন, এতো মেরেছেন কিন্তু কখনও আমাকে আমার ইচ্ছার বাইরে কাজ করতে বাধ্য করেননি।
আমার ইচ্ছায় আমি ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, বাংলা পড়েছি। নিজের মতে বিয়ে করেছি। নিজের মতো চাকরি ও ব্যবসা করেছি। নিজের মতো করে রাজনীতি করেছি। বাবা এক সময়ে রাজনীতি করতেন না। কিন্তু ৭০ সালে আমি বাবাকে আওয়ামী লীগে জড়িয়ে ফেললে সারাজীবন সেই রাজনীতিই করে গেছেন। তিনি শুধু হাইস্কুলে পড়ার জন্য নানীর বাড়িতে যেতে দেননি।
তার মতে নানার বাড়িতে আমার এতো আদর হতো যে পড়া লেখা হতোনা। সম্ভবত এই বিষয়ে তিনি পুরোই নিশ্চিত ছিলেন। তবে আমার মনে হয়, বাবা যাকে ভয় পেতেন আমার সেই নানী অনেক সচেতন ছিলেন। তিনি যখন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন তখনও তিনি আমাকে খবর দেননি, কারণ তখন আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ছিলো।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যখন যাই তখন বাবা চোখের পানি ফেলে দূর থেকে আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। সত্তুর দশকে এসে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকায় চিকিৎসা করাতে আনি। তখন তিনি চলতে পারেন না। আমার বাসায় থেকে সুস্থ হলেন। বললেন, গ্রাম থেকে আসি। ছোট ভাই রাব্বানীকে সাথে দিলাম। কদিন পর বাবা রাব্বানীকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিলেন। এরপর বাবাকে আর ঢাকা আনতে পারিনি।
বাবা সারাজীবন মানুষকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা করেছেন। দিনের পর দিন রাতের পর রাত তিনি বিনে পয়সায় না খেয়েও মানুষের পাশে সেবা করতেন। গ্রামের বাড়িতে ইদগাহ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, হাইস্কুল, প্রাইমারি স্কুল নিজের হাতে করেছেন। রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সৈনিক ছিলেন।
সেই বাবা যিনি সারা জীবনে কোনদিন মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি, সেই বাবা যিনি অস্ত্র ছাড়া বাংলার মাটিতে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সেই বাবা যে বাবা এখনও আমার আদর্শ-তিনি ১৭৭৯ সালের ১৮ জুলাই আমাদের ছেড়ে চলে যান।
বাবা তুমি আমার আদর্শ। আমার সারা শরীরে তোমার মারের দাগগুলোকে এখনও হাত বুলিয়ে দেখি। তুমি না হলে আমি এই দুনিয়াতে আমার হিরো কাউকে পেতাম না। এখন যখন বাবার ইদগাহ, কবরস্থান, মাদ্রাসা, প্রাইমারি ও হাই স্কুল দেখি তখন পদে পদে বাবাকে মনে পড়ে। আমার এলাকার প্রতি ইঞ্চি মাটি সেই মহামানবকে স্মরণ করে। ঐ এলাকার সবগুলো ছাত্র-ছাত্রীকে দেখলেই বাবার মুখ ভাসে।
আমার বাবা গ্রামে মারা যান বিধায় বলতে গেলে কোন চিকিৎসাই তার হয়নি। আমার গ্রামে তখন একজন এমবিবিএস ডাক্তারও ছিলোনা। তিনি নিজে হোমিওপ্যাথি জানতেন। তবে তিনি যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন সেটি হয়তো জানতেন না। আমি তখন ঢাকায় থেকে বাবা চিকিৎসা করানোর মতো অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু বাবা শহর পছন্দ করতেন না। বলতে গেলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। আর ফিরে আসেননি। আমার বাবার প্রজন্মের মানুষেরা শহরকে সহ্যই করতে পারতেন না।
মাও বাবার স্মৃতি বুকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। শহরে তার ছেলেদের বাসায় তিনি বেশিদিন থাকতে চাইতেন না। তবে মা চিকিৎসার সময় ঢাকায় ছিলেন। তার অপারেশন হয়েছিলো। তিনি সেরে ওঠছিলেন। হঠাৎ কোন এক অজ্ঞাত জীবাণুতে আক্রান্ত হন। কোন অ্যান্টিবায়োটিক সেই জীবাণুকে পরাস্ত করতে পারলোনা। আমরা মাকে লাইফসাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।
ডাক্তার বলেছিলো, কোন ওষুধ কাজ করেনা। আমি বলেছিলাম কুদরত হতে পারে। মার যতোক্ষণ শ্বাস থাকবে আমি তাকে জীবিত রাখতে চাই। কিন্তু অবশেষে পরাজিত হই। লাইফসাপোর্ট না দিলে হয়তো একই দিন বাবা-মার মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হতো। দুজনের মৃত্যুবার্ষিকীতে বছরের ব্যবধান অনেক হলেও দিনের ব্যবধান কম। বাবার মৃত্যুবার্ষিকী ১৮ জুলাই, মায়ের ২১ জুলাই। বাবার মৃত্যুবার্ষিকী অবশ্য চাদের হিসাবে হয়ে থাকে। ফলে ইংরেজি মাসের সাথে মিল থাকেনা।
তারা এখন যেখানে সেখানে আমাদের কিছুই করার নাই। এই দুনিয়াতে তাদের সন্তান হিসেবে যা যা করার ছিলো আমরা তার সব করতে পারিনি। বাবা মারা যাবার সময় আমার ভাইবোনেরা খুব ছোট ছিলো। পরে আমরা সবাই মিলে তাদের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা এসব করার পাশাপাশি বাবার পথ ধরে গ্রামের মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করা ও তাদের দুজনের পথ ধরে শিক্ষার বিস্তারে অবদান রাখাটাই হয়তো এখন বলতে পারবো। সন্তান হিসেবে আমাদের আরও কিছু করার আছে-সেটি করতে পারলে নিশ্চয়ই খুশি হবো।
প্রায়ই দেখি মানুষকে মিডিয়া প্রশ্ন করে আপনার প্রথম ভালোবাসা কে? এই প্রশ্নের জবাবে কি উত্তর দেয়া যায় সেটি আমিও ভেবেছি। লিখেছিও। স্কুলে পড়া এক মেয়ের নাম নিয়েছি তাতে। কিন্তু জীবনের এই প্রান্তে এসে মনে হচ্ছে, ঠিক বলিনি। দুনিয়ার সকল সন্তান নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন যে, সকলের প্রথম ভালোবাসার নাম প্রকৃতার্থে মা-বাবা।
দুনিয়ার আর কোন মানুষের ভালোবাসার সাথে এর কোন তুলনা হয় না। অন্যদিকে সব ভালোবাসাকে একই এককে মাপাও ঠিক না। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা আর বাবা-মার ভালোবাসা এক নয়।
লেখক : মন্ত্রী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক। mustafajabbar@gmail.com, www.bijoyekushe.net, www.bijoydigital.com
এইচআর/এমএস