সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে মফস্বল সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম। মফস্বল সাংবাদিকদের উপেক্ষা করে কোনো সংবাদপত্রই সফল অবস্থানে পৌঁছতে পারে না। মফস্বলের সাংবাদিকরা দেশের ৮৫ ভাগ মানুষের লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও অভাব অভিযোগের খবর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে পত্রিকা অফিসে পাঠান। বলা যায়, গণমানুষের সঙ্গে মিশে একজন ভুক্তভোগীর হাঁড়ির ভেতরের খবর পর্যন্ত বের করে নিয়ে আসেন মফস্বলের সাংবাদিকরা।
Advertisement
এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনও কখনও স্থানীয় প্রশাসনের পরোক্ষ হুমকি, প্রভাবশালীদের চোখ রাঙানি, এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও পান তারা। তবুও হাল ছাড়েন না। সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করা গ্রামীণ মানুষের গান গেয়ে যান তারা।
গ্রামীণ মানুষের গান গেয়ে যাওয়া এমনি একজন মানুষ তাহমিন হক ববি। রংপুর বিভাগের সাংবাদিকতার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তার নাম। সবার পরিচিত মুখ। তবে অন্য দশজন সাংবাদিকের চেয়ে আলাদা তিনি। সাংবাদিকতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব, সততা ও সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা অন্যদের চেয়ে তাকে আলাদা করেছে। দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েও বস্তুনিষ্ট সংবাদ প্রকাশে এখনও অঙ্গীকারবদ্ধ তিনি।
সাংবাদিক তাহমিন হক ববি বিশ্বাস করেন- পৃথিবীর কল্যাণকামী সব পেশা মহৎ হলেও সাংবাদিকতা পেশা সবার ঊর্ধ্বে। এটাকে পেশা বলা চলে না; মানবসেবা বলাই শ্রেয়। এই সেবায় সততা, বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা মূল হাতিয়ার। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় নির্যাতিত-শোষিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের কথা। সৎ সাংবাদিকতা সমাজকে কলুষমুক্ত করে আর সভ্যতাকে করে আলোকিত।
Advertisement
এমন আদর্শকে ধারণ করে প্রায় গত ৪০ বছর ধরে মফস্বলে সাংবাদিকতা করছেন তাহমিন হক ববি। নীলফামারীর সমস্যা-সম্ভাবনা ও গণমানুষের কথাগুলোকে অবিরাম বলে যাচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি স্থানীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রয়েছে তার পদচারণা।
কাগজে-কলমে নাম তাহমিনুল হক ববি হলেও সবার কাছে তিনি ‘সাংবাদিক তাহমিন হক ববি’ নামেই পরিচিত। ১৯৬৪ সালে নীলফামারী সদরে তার জন্ম। স্ত্রী আফরোজা হক স্কুল শিক্ষিকা। দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে মেয়ে আফসানা তারান্নুম হক নিকিতা অনার্স শেষ করে নীলফামারী সরকারি কলেজে মাস্টার্সে পড়ছেন। ছেলে ইনজামাম উল হক নির্নয় এবার কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে।
সাংবাদিক ববির বাবা তোজাম্মেল হক ছিলেন ভেটেরিনারি সার্জন। মা তাহমিনা বেগম ছিলেন নারী উন্নয়নকর্মী এবং সদর উপজেলা পরিষদের নারী সদস্য ও জেলা মহিলা সমিতির সভাপতি। ১৯৮৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাবাকে আর ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল মাকে হারান সাংবাদিক ববি। সাত ভাই-বোনদের মধ্যে ববি ৬ষ্ঠ।
সাংবাদিকতার একাল-সেকাল ও মফস্বলে দীর্ঘ পথচলার অভিজ্ঞতা ও প্রতিবন্ধতার বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। কথার ফাঁকে ফাঁকে বললেন জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথাও।
Advertisement
তাহমিন হক ববি বলেন, শৈশব থেকেই আমার ভেতরে অজানাকে জানার কৌতূহল কাজ করত। বাবা বরাবরই উৎসাহ দিতেন। বাবা ছিলেন দৈনিক বাংলা, সংবাদ ও ইত্তেফাকের একনিষ্ঠ পাঠক। আমৃত্যু তিনি এই তিনটি পত্রিকা পাঠ করেছেন। তিনি আমাকে দিয়ে ইত্তেফাকের খবর ও শিশুতোষ লেখা পাঠ করাতেন। নিজে চোখ বন্ধ করে সেগুলো শুনতেন। ভুল হলে শুধরে দিতেন।
নীলফামারীর স্থায়ী বাসিন্দা হলেও বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন স্থানে আমাকে থাকতে হয়েছে। দিনাজপুরের ঈদগাঁ বস্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে আমার শিক্ষাজীবন শুরু। পর্যায়ক্রমে পঞ্চগড় ও নীলফামারীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করি। নীলফামারী কলেজ থেকে বিএ পাস করি।
সাংবাদিকতা পেশার শুরুটা উল্লেখ করে ববি বলেন, ১৯৭৬ সালে আমার মেজ ভাই তানভীর হক বুলবুলকে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ছুরিকাঘাত করেছিল। আমার ভাই তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির পরিচ্ছন্নতা এবং ভাইয়ের জনপ্রিয়তা সহ্য করতে না পেরে বিরোধীরা এ ঘটনা ঘটায়। ওই আঘাতে আমার ভাই পঙ্গু হয়ে যায়। অচল দুটি পা নিয়ে পঙ্গুত্ব অবস্থায় সমাজকর্ম বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করে। পরে নীলফামারীর বাড়িতে ফিরে তৎকালীন মহকুমা শহরে সর্বপ্রথম ব্লু কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করে পরিচালনা করে। ১৯৮৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর আমার ভাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। ভাইয়ের ওই ঘটনার বিচার আজো হয়নি। অবস্থা ছিল অসহায়। প্রতিবাদের ভাষা ছিল না। পরিবারের এই অসহায়ত্ব আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই একজন অসহায় কণ্ঠহীন মানুষের কণ্ঠস্বর হওয়ার স্বপ্ন আমার মধ্যে জেগে ওঠে। সেই স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৯ সালে সাংবাদিকতা শুরু করি।
দিনাজপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক তিস্তা পত্রিকার নীলফামারী প্রতিনিধি হই। সাংবাদিকতার পেশাকে বেছে নিতে সহযোগিতা পেয়েছি পরিবারের সবার। সেই সঙ্গে সাংবাদিকতার বিষয়ে সহযোগিতা করেছেন নীলফামারীর দুই প্রবীণ সাংবাদিক প্রয়াত ফজলার রহমান ও মোশাররফ হোসেন। এই দুই সাংবাদিক পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তাদের অবদানের কথা আজও ভুলতে পারিনি।
আমার সাংবাদিকতা দৈনিক তিস্তা দিয়ে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে কাজ করি তারকা লোক, চিত্রবাংলা, দৈনিক খবর, দৈনিক লাল সবুজ পত্রিকায়। দৈনিক জনকণ্ঠের শুরু থেকে নীলফামারী জেলার নিজস্ব সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করি। সংবাদ লিখনের দক্ষতায় দৈনিক জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষ আমাকে স্টাফ রিপোর্টারের মর্যাদা দিয়েছে। নীলফামারী থেকে স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে জনকণ্ঠে কর্মরত আছি।
সাংবাদিক জীবনে ববি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তার নাম আজ জেলার গণ্ডি পেরিয়ে দেশ-বিদেশেও স্থান পেয়েছে। সাংবাদিক ববি হিসেবে সবাই তাকে এক নামে চেনেন।
সাংবাদিক ববি বলেন, এদেশে শুধু কর্মস্থলের ভিন্নতার কারণে সাংবাদিকদের দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। শহরে সাংবাদিক ও মফস্বল সাংবাদিক। মফস্বল সাংবাদিকরা একে তো প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত, তার ওপর শহরে সাংবাদিকদের তুলনায় তাদের জীবনের ঝুঁকিটাও অনেক বেশি। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার অপরাধে দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে লাঞ্ছিতও হয়েছি।
সাংবাদিক হিসেবে নিজের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ববি বলেন, অসহায় মানুষের পক্ষে সংবাদ লিখতে গিয়ে লাঠিপেটা ও কিলঘুষি খেয়েছি। তবে ঠান্ডা মাথায় আঘাতকারীদের বুঝিয়ে দিয়েছি মারপিট করে লাভ নেই। সত্যকে ধামাচাপা দেয়া যায় না। আমার লিখনির ওপর অনেক অসহায় পরিবার আইনি সহায়তাসহ সঠিক বিচার পেয়েছেন।
ববি বলেন, স্বপ্ন মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় সুন্দর আগামীর পথে। অজানাকে জানার কৌতূহল, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ, সামাজিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি মানুষকে অলঙ্কিত করে। আর পেশাদারিত্বের প্রশ্নে আমি অবিচল।
আমি স্বপ্ন দেখি- তরুণ সমাজকে নিয়ে। তরুণদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই একটি কলুষমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব। কেননা তরুণরা একদিন সমাজের দায়িত্ব নেবে। তরুণরা ঐক্যবদ্ধ হলে অসাধ্য কাজও সাধন হয়। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তরুণদেরকে প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে হবে।
এ ছাড়া সাংবাদিক ববি তরুণদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন। স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে ভালবাসেন। এ পর্যন্ত ১০ জনকে রক্তদান করেছেন তিনি। সুবিধাবঞ্চিত ও নির্যাতিত একজন মফস্বল সাংবাদিক হওয়ার পাশাপশি জেলা রেড ক্রিসেন্ট ও ডায়াবেটিস সমিতির আজীবন সদস্য সাংবাদিক ববি। তিনি নীলফামারী প্রেস ক্লাবের সভাপতি। সব সময় অসহায় ও অসুস্থ সাংবাদিকদের সেবা ও সহায়তা করে যাচ্ছেন ববি।
সাংবাদিক ববি বলেন, একজন সংবাদকর্মী কতটা কষ্ট করে তা আপনি জানেন না। কখনও যদি জানতেন তাহলে তাদের সম্মানে মাথা নিচু করতেন। তাদের নিয়ে মশকরা করতেন না। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, কি রাত কি দিন ২৪টি ঘণ্টা গাধার মতো খেটে যান। কখনও প্রতিদান চান না। সমাজ-রাষ্ট্র ও মানুষের উন্নয়নে নিরসল কাজ করে যাচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে তারা হামলা-মামলা নির্যাতনের শিকার হন। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ববি বলেন, সাংবাদিকতা মহান পেশা। এটাকে কেউ কেউ আবার নেশা হিসেবে মানতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে এটাও ঠিক যে সঠিক প্রশিক্ষণ, পেশাদারিত্বের অভাব, অধিক টাকার লোভ ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সাংবাদিকদের মাঝে বিভক্তি বাড়ছে। অনেক সময় সাংবাদিকদের কাউকে কাউকে সাংঘাতিক, হলুদ সাংবাদিক, চাঁদাবাজ সাংবাদিক, সিন্ডিকেট সাংবাদিক, বিজ্ঞাপন সাংবাদিক, রাজনৈতিক সাংবাদিক, গলাবাজ সাংবাদিক, এমনি এমনি সাংবাদিক, ক্রেডিট পরিবর্তন সাংবাদিক, দালাল সাংবাদিক ইত্যাদি অসুন্দর অভিধায় অভিহিত করা হয়। এর অবসান হওয়া জরুরি।
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা ও মিডিয়াগুলোর কর্তৃপক্ষের স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা পরিত্যাগ করতে হবে। কর্মদক্ষতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। পাশি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে সাংবাদিকতার আড়ালে তথ্য বাণিজ্যের বদলে তা তথ্যসেবায় যেন নিবেদিত হয়। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে; তা হলো মফস্বল সাংবাদিকদের সাংবাদিকতার বুনিয়াদী প্রশিক্ষণসহ বেশি বেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করা।
অপসাংবাদিক গোত্রের সদস্য খুবই কম- বিশ্বাস করতে ভালো লাগে। আমরা চাই, ভালো সাংবাদিকদের সাহায্যে হলুদ সাংবাদিকদের অবসান হোক। একটি সংবাদপত্র নিজেই দেশের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে- সাংবাদিক আর্থার মিলারের এ কথা আমরা বিশ্বাস করতে চাই। আমরা চাই, সাংবাদিকদের লেখনি সমাজের আয়নায় পরিণত হোক। যা দেখে মানুষ সচেতন হবে। তাদের লেখা পড়ে মানুষ ভালো কিছু শিখবেন। উৎসাহিত হবেন। ভালো কাজ করতে অনুপ্রেরণা পাবেন। আমরা চাই, এলাকার অন্যায়, অত্যাচার, বঞ্চনা, শোষণের বিপক্ষে সাংবাদিকের কলম ও ক্যামেরা যথাযথ কাজ করুক ও ভালো কাজের প্রশংসার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠুক। মফস্বল সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজ উপকৃত হোক। গ্রাম-বাংলার কল্যাণে মফস্বল সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম এটা আমরা সবাই বিশ্বাস করি।
এএম/পিআর