বাংলা সাহিত্যের অপরাজিত রাজপুত্র নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে পরপারে পাড়ি জমান। তার স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন তরুণ কবি ও কথাশিল্পী সানাউল্লাহ সাগর-
Advertisement
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে সম্ভবত ২০০১ সালের দিকে। আমার এক পড়ুয়া বন্ধুর টেবিলে। হুমায়ূন আহমেদের একটি ঢাউস সংকলনের মাধ্যমে। সেই ঢাউস সংকলনের নাম ছিলো ‘হুমায়ূন ৫০’। সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ায় সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংকলন পেয়ে আমার স্ফূর্তির শেষ নেই! একসঙ্গে এতো লেখা! অনেক দিন ধরে পড়া যাবে। যদিও তার আগেই শরৎ, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ গেলা হয়ে গেছে।
বন্ধুর কাছ থেকে অনেকটা জোর করেই ‘হুমায়ূন ৫০’ বইটি নিয়েছিলাম। তারপর একটানা পড়তে থাকা। ভালো-মন্দ হিসেব করে যারা বই পড়ে তাদের মতো বোধ তখনও সম্ভবত তৈরি হয়নি। মনে হচ্ছে- এখনো সে ভাবনায় পিছিয়েই আছি কিছুটা। সে কারণে পাওয়া মাত্রই অনেক বই পড়ে শেষ করি। যদিও এখন আর সেই আমি নেই, যে কিনা একসময় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে প্রতিদিন লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসতাম।
> আরও পড়ুন- সানাউল্লাহ সাগরের তিনটি কবিতা
Advertisement
এখন এই ব্যস্ত ঢাকায় জীবনের পিছু পিছু দৌড়াচ্ছি। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। ‘হুমায়ূন ৫০’ পুরোটাই পড়েছিলাম। একটানা। কতো দিন লেগেছিল মনে নেই। একসঙ্গে অনেক লেখা পড়ার যে সুবিধা, সেটা আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। কিছুদিন পরই এতো লেখা, এতো ভিন্ন ভিন্ন গল্প ভুলে গেছি! কিন্তু আসলে সব তো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সে জন্যই এখনো মনে আছে, ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’ এরকম নামের একটি উপন্যাসের কথা। খুব ভালো লেগেছিল।
আমার উপন্যাস পড়া শুরু হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ দিয়ে। এক বড় ভাই বইটি পড়তে দিয়ে বলেছিল, ‘এটা পড়ো। অনেক ভালো বই।’ আমি দু’দিনে পড়ে শেষ করেছিলাম। তারপর থেকে মেঝ বৌ চরিত্রটি আমার মনে গেঁথে থাকে। এখনো আছে। আমি মৃত্যুক্ষুধাকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উপন্যাস মনে করি। পড়ার পর মনে হয়েছিল, মানুষ এতো সুন্দর করে লিখতে পারে!
হুমায়ূন আহমেদ এসে মনের মধ্যে আর সেই অলৌকিকতা থাকেনি। মনে হয়েছে, এই তো আমার পাশের মানুষের চরিত্র এটি। আমার চেনা-জানা গল্প! কিন্তু আমি জানি না কিংবা আমি এর সবই জানি।
পরবর্তী সময়ে লিটলম্যাগ আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে হুমায়ূন আহমেদের অনেক গুণ (!) জানতে পেরেছি। তারা বোঝাতো হুমায়ূন আহমেদ আসলে সস্তা শ্রেণির লেখক। আমারও মাঝেমধ্যে মনে হতো, হুমায়ূন আহমেদ তার সাধ্যের সবটুকু না দিয়ে বাংলাদেশের পাঠকের চাওয়া পূরণ করতে তার স্তর থেকে নিজেকে নামিয়ে নিয়েছিলেন।
Advertisement
তার প্রতিভা ও পরিশ্রমের প্রমাণ তিনি ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে রেখেছেন। আর ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসের মধ্যে তার কিছু একটা করার চেষ্টা প্রতিফলিত হয়েছে। পুরোপুরি সফল হয়েছেন সেটা বলতে পারছি না। কারণ এরকম একজন হুমায়ূন আহমেদের কাছে দেশ, জাতির অনেক প্রত্যাশা থাকে।
> আরও পড়ুন- বাংলা নাটক ও সেলিম আল দীন
তারপরও মাঝেমধ্যে হুমায়ূন আহমেদ পড়া হতো। কখনো কখনো নিজের ক্লান্তি দূর করতে হুমায়ূনকেই বেছে নিতাম। কখনো মুগ্ধ হতাম। আবার কখনো হিমুর মতো পাগলা, খাপছাড়া চরিত্র পড়ে বিরক্তও হতাম। কিন্তু প্রকৃত সত্য তো এই যে, আমাদের প্রত্যকের মধ্যে একজন মিসির আলি ও একজন হিমু বাস করে। কিন্তু নানা কারণে আমরা সেই চরিত্রদের সামনে আনতে পারি না। হিমু পড়তে গিয়ে কখনো কখনো নিজেকেই হিমু মনে হয়েছে। হারিয়ে গেছি হিমুর মধ্যে।
একজন হুমায়ূন আহমেদকে অনেক কিছুই করতে হয়। তিনি সেটাই করেছেন। বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে বাকের ভাই একটি ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের জনক হুমায়ূন আহমেদ। তার দরদে বাংলা সিনেমা সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি তৈরি করেছেন ‘দুই দুয়ারী’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘চন্দ্রকথা’সহ আরো বিখ্যাত সব সিনেমা।
হুমায়ূন আহমেদ নাটক বা সিনেমার প্রয়োজনে গান রচনা করতেন। তার গানের মধ্যেও থাকতো গল্প। সেই গল্পের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে নিজেকে খুঁজে পাওয়া।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে আমাদের একজন হুমায়ূন আহমেদ আছে। এরকম একজন জাদুকরকে আমরা পেয়েছি। এর থেকে গর্বের আর কী হতে পারে? প্রিয় হিমু, দূর দেশে ভালো থাকুন। অনেক ভালো। আর…‘যদি মন কাঁদেতুমি চলে এসো, চলে এসোএক বরষায়…’
এসইউ/আরআইপি