বিশেষ প্রতিবেদন

আকাঙ্ক্ষা তীব্র হলেই সংশোধন হবে রাজনীতি

আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ওপর আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাব নিয়ে লেখালেখি করেন। ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ভারতমুখী’- এমন বিষয়বস্তু নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র।

Advertisement

তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এ দেশের মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণে ভারতের কর্তৃত্ব এড়িয়ে চলতে চান। ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামো দুর্বল বলেই ভারতের দ্বারস্থ হতে হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন দলকে।’

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সায়েম সাবু। দুই পর্বের শেষটি থাকছে আজ।

জাগো নিউজ : চলমান সম্পর্কের জেরে ভারত-বাংলাদেশ নিজেদের মধ্যকার ভুলগুলো বুঝতে পারবে বলে আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৈন্যতায় ভারতের কি ভুল হতে পারে?

Advertisement

আরও পড়ুন >> ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ‘সাময়িক’

আলতাফ পারভেজ : নেপালে ভারত অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছে। নেপালি কংগ্রেসকে ভারত নগ্ন সমর্থন দিয়েছে। এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস তৃতীয় হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় ভারত তামিলদের সমর্থন দিয়েছিল। এতে ডানপন্থী সিংহলিরা লাভবান হয়। এ কারণে চরমপন্থী সিংহলিদের উত্থান ঘটে, যারা চরমভাবে ভারতবিরোধী। রাজাপাকসে মধ্যপন্থী নেতা নন। তিনি চরমপন্থী নেতা এবং সেটা ভারতের কারণেই। মধ্যপন্থী সিংহলিরাও আর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক চান না। এজন্য ৩০ বছর সময় লেগেছে শ্রীলঙ্কায়। খুব ব্যথাতুর সময়। নেপালে আরও সময় লেগেছে।

মালদ্বীপে সামরিক অভ্যুত্থান ঠেকানোর জন্য ভারত সেখানে সামরিক সহায়তা দেয়। শ্রীলঙ্কার লোক ভাড়া করে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল। রাজীব গান্ধী সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সে অভ্যুত্থান ঠেকান। অর্থাৎ মালদ্বীপের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারত বড় ভূমিকা রেখেছিল। সেই মালদ্বীপ ভারতীয়দের ভিসা দিচ্ছে না। তার মানে ভারত বড় ধরনের খেসারত দিচ্ছে, তাদের নীতির কারণে।

জাগো নিউজ : ভারতের ঘের থেকে অন্যরা বেরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পারছে না কেন?

Advertisement

আলতাফ পারভেজ : চাইলেই প্রতিবেশী বদলানো যায় না। বেরিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে আমি বলছি না।

জাগো নিউজ : প্রতিবেশী অন্যরাও ছিল?

আলতাফ পারভেজ : ওই দেশগুলো নীতির পরিবর্তন আনছে। আমরা পরিবর্তন আনতে পারিনি।

ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আমরা আমাদের অবস্থান শক্ত করতে পারিনি। ভারতের কী চেষ্টা, সেটা ভারতের ব্যাপার। আমরা আমাদের চেষ্টা রাখতে পারিনি।

জাগো নিউজ : কেন পারছি না?

আলতাফ পারভেজ : জনগণের আবেগ নীতিনির্ধারকরা ধারণ করতে পারেন না। স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক যে স্বাভাবিক কাঠামো, তা আর নেই। এ দুটি সংকটের কারণে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে সংকট দুটি কাটিয়ে উঠবে বাংলাদেশ।

জাগো নিউজ : কিসের ভিত্তিতে ভরসা পাচ্ছেন?

আরও পড়ুন >> আমরা পেছনে ফিরতে চাই না

আলতাফ পারভেজ : জনমতামত গঠনের খানিক সুযোগ পেলেই সংকট কাটানোর পথ বের হবে এবং সেটা আওয়ামী লীগ, বিএনপির মধ্য থেকেও হতে পারে। আকাঙ্ক্ষা তীব্র হলেই রাজনীতির সংশোধন হবে।

আমি মনে করি, ভারতও এক সময় বুঝতে পারবে, অন্য দেশের ক্ষেত্রে যে নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বহাল রাখা ঠিক হয়নি। সংশোধন ছাড়া এ সম্পর্কে বিকল্প আর কিছুই ভাবা যায় না।

জাগো নিউজ : এতগুলো বন্ধু হারালো ভারত! সংশোধন তো হয়ে যাওয়ার কথা…

আলতাফ পারভেজ : সংশোধন হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা ভারতকে আর অন্ধভাবে সমর্থন করে না। তারা বাস্তবতা বুঝতে পারছে। নেপালের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যদি চীনের সঙ্গে এখনকার মতো সম্পর্ক গড়তো, তাহলে ভারতে ভূমিকম্পের মতো ঘটনা ঘটতো। নেপাল-চীন সম্পর্কে ভারত কিন্তু সয়ে যাচ্ছে। মালদ্বীপের ক্ষেত্রেও তাই।

এমনকি মিয়ানমারে ভারত ঐতিহাসিকভাবে সুচির দল এনএলডিকে (ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি) সমর্থন দিয়ে এসেছে। এখন ভারত বুঝতে পারছে, মিয়ানমারে সামরিক শক্তির সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে অন্তত তাই প্রমাণ হচ্ছে। ভারতেরও নীতিনির্ধারণী দল আছে। প্রজ্ঞার দল আছে। আমলারা আছে। বুঝতে হবেই। ভারত ভুল সংশোধন করবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও।

জাগো নিউজ : তাহলে বলতে চাইছেন, বাংলাদেশে বিশেষ একটি দলের প্রতি সমর্থন ভারতের জন্যও অমঙ্গল এবং ওই দলটির জন্যও অমঙ্গল…

আলতাফ পারভেজ : বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ এ দেশে সবচেয়ে পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী দল। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমন একটি দলের রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই প্রজ্ঞাবান।

এ দেশের রাজনীতি, ইতিহাস ও সংস্কৃতি আওয়ামী লীগের অজানা নয়। নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যদি সমর্থক গোষ্ঠীর দূরত্ব হয়, তা কাটিয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। অন্তর্গত গতিশীলতা দিয়েই দলটি তার ভুল শুধরে নেবে। জনগণ কী চাইছে, তা আওয়ামী লীগ বুঝতে পারবে।

আরও পড়ুন >> ভারত প্রশ্নে বিএনপি নীতির পরিবর্তন করবে না

জাগো নিউজ : কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রশ্নে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দাবি থাকেই…

আলতাফ পারভেজ : এ কৃতজ্ঞতা শুধু আওয়ামী লীগের নয়। গোটা জাতিরই কৃতজ্ঞতাবোধ রয়েছে। ভারতের অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

মুক্তিযুদ্ধে ভারত তার নিজের স্বার্থে সহায়তা করলেও আমরাও তো লাভবান হয়েছি। ভারত আমাদের স্থায়ী প্রতিবেশী এবং কৃতজ্ঞতাটাও স্থায়ী বলে বিবেচিত।

কিন্তু এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি আমরাও তো স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের মর্যাদা নিয়ে থাকতে চাই। আঞ্চলিক পরিস্থিতির কারণেও আমাদের সে মর্যাদা রক্ষা হবে।

জাগো নিউজ : আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনি আশাবাদী। কিন্তু ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর চরমপন্থার জয়জয়কার। বাংলাদেশেও তার ঢেউ লাগতে পারে!

আলতাফ পারভেজ : দক্ষিণ এশিয়ার মাটির গন্ধে আপনি চরমপন্থার উত্থান পাবেন না।

জাগো নিউজ : বিজেপি তো ক্ষমতায়?

আলতাফ পারভেজ : বিজেপির উত্থান সাময়িক বলে মনে করি। ভারতের ধর্মনিরেপক্ষ দলগুলোর ভুল থেকে বিজেপির উত্থান। মধ্যপন্থী রাজনীতির ভুলের কারণেই উগ্রপন্থার উত্থান ঘটে।

তবে আমি মনে করি না যে, ভারত তার জাতীয় স্বার্থে ভুল করবে। তারা বিদেশ নীতিতেও ভুল করবে না।

বিজেপি একটি বর্ণবাদী হিন্দু নেতৃত্বের দল। সেই দল এবার দলিত মানুষকে রাষ্ট্রপতি বানালো। এটি কিন্তু একটি বার্তা। চীনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধও হলো। আবার সেই চীনের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে মরিয়া। মস্কোর পাশাপাশি ভারত এখন ওয়াশিংটনেও যাত্রা করছে। অথচ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মধুর সম্পর্ক ছিল। তার মানে সম্পর্কের কোনো স্থায়িত্ব থাকে না।

ভারত যেখানে তার স্বার্থ দেখছে, সেখানেই মুখ রাখছে। ভারতের নীতিতে দারুণ গতিশীলতা লক্ষ্য করছি। একই নীতি পাকিস্তান, নেপালের ক্ষেত্রেও। দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবর্তনের ঢেউ লেগে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি এ ঢেউ থেকে মুখ সরিয়ে রাখবে, তা হয় না।

জাগো নিউজ : সেউ ঢেউ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অতি ধীর কিনা?

আলতাফ পারভেজ : হ্যাঁ, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ধীর। তবে পরিবর্তন হবে না, এটি বলার কোনো সুযোগ নেই। পরিবর্তন আসন্ন। জনগণের সঙ্গে পার্টির নেতাদের যে দূরত্ব, তা যদি স্থায়ী হয়, তাহলে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটবে। এটি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন।

জাগো নিউজ : তৃতীয় শক্তির উত্থান তো নানাভাবেই দেখলাম…

আরও পড়ুন >> নির্বাচনে ফের সংঘাত হোক সরকারও চায় না

আলতাফ পারভেজ : আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে এখানে তৃতীয় শক্তি দেখিনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপির মধ্যকার ভাবনার মাঝেও এ শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মূল ধারার দলগুলোর মধ্যে নীতির পরিবর্তন আসলো। এখানেও আসবে।

জাগো নিউজ : সম্প্রতি বিএনপির ভারতযাত্রা কী এমন ইঙ্গিত বহন করে?

আলতাফ পারভেজ : রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়মিত ভারত যাওয়া দরকার। চীন, আমেরিকাতেও যাওয়া দরকার। তাদের অর্থনীতি, রাজনীতির পরিবর্তন বুঝতে হলে বারবার সেসব দেশগুলোতে যাওয়া দরকার। আমি এটি নেতিবাচকভাবে দেখি না।

জাগো নিউজ : চরমপন্থার উত্থান ঘটবে না বলছিলেন, কিসের ভিত্তিতে এমন ভরসা পান?

আলতাফ পারভেজ : ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস দেখেন, অনেকেই আন্দোলন করলো। কিন্তু সফল হলো মধ্যপন্থী কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ। পাকিস্তানের রাজনীতিতেও তাই। বার্মাতেও উগ্র বৌদ্ধরা আছেন। ক্ষমতায় আসছে মধ্যপন্থী এনএলডি। এটিই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ইতিহাস।

জাগো নিউজ : কিন্তু চরমপন্থার ঢেউ তো আছেই…

আলতাফ পারভেজ : মূল ধারার রাজনীতি বা মধ্যপন্থার ব্যর্থতার কারণে এ ঢেউ। তবে সেটি নিয়ন্ত্রিত। মধ্যপন্থীরা সংশোধন হলে চরমপন্থা নিষ্ক্রিয় হবে।

এ অঞ্চলে চরমপন্থার উত্থান বাইরের ইন্ধনেও হচ্ছে। সেটাও হয়তো থাকবে না।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের মধ্যপন্থী দলগুলো কিন্তু সংশোধনের নীতিতে নেই। বরং চরমপন্থাতে মিলছে নানাভাবে…

আলতাফ পারভেজ : বাইরের প্রভাবে ঘটছে। আমাদের শিকড় মধ্যপন্থায়। স্বাধীনতার পর এমন কোনো চরমপন্থী নেতার নাম বলতে পারবেন, যিনি খুবই জনপ্রিয়? সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতিতে মধ্যপন্থারই জয় হয়।

জাগো নিউজ : কিন্তু অস্থিরতা তো আছেই?

আলতাফ পারভেজ : এতটুকু অস্থিরতাই এ অঞ্চলের অভিশাপ। দলগুলো সবল না হওয়ার কারণে চরমপন্থার এ অস্থিরতা।

তবে আমি মনে করি, এ অস্থিরতা টেকসই হবে না। কোনো তরুণই আর এমন শক্তিতে ভরসা রাখে না। সবাই এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায়। আমেরিকা, চীনের অগ্রযাত্রা তারা মোবাইলে এক নিমিষেই দেখছে। কেন আটকে থাকবে তরুণরা?

আরও পড়ুন >> সাধারণরা এগোতে চায়, রাজনীতিকরা পিছিয়ে দেয়

বৈষম্যের কারণে তরুণদের মাঝে ক্ষোভ আছে। কিন্তু বিধ্বংসী নীতিতে বিশ্বাস রাখবে, তা মনে করার কারণ নেই। ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে, এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য খারাপ একটি উদাহরণ। কিন্তু বিজেপি নিজেও এখন বুঝতে পারছে সংশোধন না করে এগোনোর কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা সম্ভব নয়।

অর্থনীতি হবে রাজনীতির মূল জায়গা। এটি এখন সবাই বোঝেন। চীনের উত্থান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি গভীরভাবে পাল্টে দেবে। শুধু কথার ওপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি হবে না। সমতা বণ্টনের রাজনীতি করেই বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।

জাগো নিউজ : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ আছে?

আলতাফ পারভেজ : সাময়িক কোনো পরিস্থিতি নিয়ে আসলে বিশ্লেষণ করতে চাই না। অস্বস্তিকর। তবে ১৬ কোটি মানুষের এ দেশ পথ হারাবে না। একটি নির্বাচনেই সব ঘটবে বলে আমি মনে করি না। তবে ভালো কিছু একটা ঘটতে হবে, তা জোর দিয়ে বলতে পারি।

এএসএস/এমএআর/আরআইপি