বিশেষ প্রতিবেদন

‘রমজান-আশিক মেহেদি’ কোম্পানিতে বেতনভুক্ত ভাড়াটে কিলার!

ফুটপাত ও অটোস্ট্যান্ড থেকে তোলা দৈনিক চাঁদার ভাগবাটোয়ারা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব প্রকাশ হলেই হত্যার নীল নকশা সাজায় ‘রমজান-আশিক-মেহেদি’ কোম্পানি। এ কোম্পানির কাজ মূলত ভয়ভীতি প্রদর্শন করা। তাতে কাজ না হলে কিলিং মিশনে নামে ‘কোম্পানি’র সদস্যরা।

Advertisement

সর্বশেষ রাজধানীর বাড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলী খুন হন। ফরহাদ খুনে এ কোম্পানির ভাড়াটে কিলাররা অংশ নেয়। গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

এ কোম্পানিতে কাজ করছে অন্তত দুই ডজন যুবক। তাদের মাসিক খরচ দেয়া হয় আট থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। কোম্পানি পরিচালনা ও হত্যার নীল নকশার পরিকল্পনা হয় দেশের বাইরে থেকে। আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদ খুনের পরিকল্পনাও হয় দেশের বাইরে। শুধু ফরহাদ নয়, দ্বন্দ্বের জেরে ও চাঁদাবাজির টাকার ভাগবাটোয়ারা ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে আরও দুই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় এ কোম্পানির মাধ্যমে।

আরও পড়ুন>> বাড্ডায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত দু’জন ফরহাদ হত্যার সন্দেহভাজন

Advertisement

ফরহাদ খুনের পর এক ব্যবসায়ীকে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল। তবে ডিবি পুলিশের তৎপরতায় তা ভেস্তে যায়। এছাড়া আরও ৪/৫ জনকে হত্যার হুমকি দিয়ে রেখেছিল ‘রমজান-আশিক-মেহেদি’ কোম্পানি।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বাড্ডা, গুলশান, কারওয়ান বাজার ও মিরপুরের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে ‘রমজান-আশিক-মেহেদি’ কোম্পানির সন্ত্রাসী গ্রুপ। বিদেশে বসে রীতিমতো ‘কোম্পানি’ খুলে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও চুক্তিতে মানুষ হত্যার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী চক্রটি।

ফরহাদ খুনের পর গত ১০ জুলাই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি জহুরুল ইসলাম ওরফে সুজন গ্রেফতার হন। আদালতে ফরহাদ হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি।

তার দেয়া তথ্যে উঠে আসে ঘটনার নেপথ্যে জড়িতদের নাম। এরপরই গত শুক্রবার রাতে গুলশান ও শাহ আলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, গুলি ও ম্যাগজিনসহ জাকির হোসেন, আরিফ মিয়া, আবুল কালাম আজাদ ওরফে অনির, বদরুল হুদা ওরফে সৌরভ ও বিল্লাল হোসেন ওরফে রনিকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ।

Advertisement

আরও পড়ুন>> আ.লীগ নেতা ফরহাদ হত্যার চারদিন পর মামলা

গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে আধিপত্য বিস্তার, অটোরিকশা স্ট্যান্ড ও ডিস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের টাকা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিরোধে ফরহাদ আলী খুন হন। বাড্ডা এলাকার বিভিন্ন চাঁদাবাজ গ্রুপ থেকে ভাগ পেতেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদ হোসেন। কিন্তু নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা অটোস্ট্যান্ড থেকে দৈনিক ভিত্তিতে ওঠা লক্ষাধিক টাকার ভাগ কাউকে দিতেন না। চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন ফরহাদ।

গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, বাড্ডা এলাকার রমজানের আস্থাভাজন সহযোগী হচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদি ওরফে কলিন্স (আমেরিকায় পলাতক) ও অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিক (ভারতে পলাতক)।

ভাগবাটোয়ারায় সমঝোতা না হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদ আলীকে হত্যার পরিকল্পনা করে রমজান, মেহেদি ও আশিক। হত্যার কয়েকদিন পূর্বে রমজান ভারতে চলে যান। হত্যার দায়িত্ব দেয়া হয় রমজানের আপন ছোট ভাই সুজনকে। তার সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পান জাকির ও আরিফ।

শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদির বাংলাদেশে সামরিক কমান্ডার ছিলেন মাহবুবুর রহমান ওরফে অমিত। অমিতের মাধ্যমে ‘কোম্পানি’র বেতনভুক্ত শ্যুটার নুর ইসলাম, অনির, সৌরভ, সাদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৪ জুন সন্ধ্যায় হত্যাকাণ্ডের আগের দিন অমিতসহ শ্যুটাররা টার্গেট ফরহাদ আলীর বাড়ির আশপাশ এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন। পরবর্তীতে রমজান, আশিক ও মেহেদির সঙ্গে আলোচনাক্রমে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, ১৫ জুন জুমার নামাজের পর ফরহাদকে হত্যা করা হবে।

আরও পড়ুন>> বাড্ডায় গুলি করে আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা

সিদ্ধান্ত মোতাবেক শুক্রবার অমিতের নির্দেশনা অনুযায়ী নুর ইসলাম, অনির ও সৌরভ মূল কিলিং মিশনে অংশ নেন। ব্যাকআপ হিসেবে থাকেন সাদ ওরফে সাদমান। চারজনকেই অস্ত্র বুঝিয়ে দেন মেহেদির অন্যতম আস্থাভাজন পুলক ওরফে পলক। পরিকল্পনা মাফিক আরিফ শ্যুটারদের মসজিদের কাছে নিয়ে ফরহাদকে চিনিয়ে দেন। নামাজ শেষে ফরহাদ মসজিদ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্যুটাররা জনসম্মুখে ফরহাদকে লক্ষ্য করে উপর্যপুরি গুলি চালিয়ে পালিয়ে যান।

ফরহাদকে হত্যার পর শ্যুটাররা গুলশান গুদারাঘাট চেকপোস্টে পুলিশের ওপর গুলি বর্ষণ করে পালিয়ে যায়। গত ৪ জুলাই রাতে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ফরহাদ হত্যায় সরাসরি জড়িত নুর ইসলাম ও মাহবুবুর রহমান ওরফে অমিত মারা যায় বলে জানায় ডিবি পুলিশ।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, ‘রমজান-আশিক-মেহেদি’ কোম্পানি থেকে মাসিক ২০ হাজার টাকা পেতেন অমিত। কারওয়ান বাজারে আড়তের ব্যবসাও ছিল তার। সেখান থেকে দৈনিক ১৪শ’ টাকা করে পেতেন। অমিতের অধীনে কাজ করে এক ডজন ভাড়াটে কিলার। নিয়মিত কাজ না থাকলেও তাদের মাসিক বেতন দেয়া হতো।

আরও পড়ুন>> ‘আধিপত্য বিস্তারের’ জেরে ফরহাদ খুন, পরিকল্পনায় রমজান

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) এডিসি গোলাম সাকলায়েন সিথিল জাগো নিউজকে বলেন, এ কোম্পানির অন্যতম শ্যুটার নুর ইসলাম ও অমিত ফরহাদ হত্যায় জড়িত। ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান গামা হত্যায়ও অংশ নেন তারা। মতিঝিল এজিবি কলোনিতে রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবু খুনেও অংশ নেন অমিত।

অন্যদিকে বনানীর সিদ্দিক মুন্সি হত্যায় জড়িত নাহিদ ও জিসান। বাড্ডার ডিশ বাবু হত্যায় জড়িত ডালিম। স্বার্থের দ্বন্দ্বে আলাদা গ্রুপ থাকলেও স্বার্থের কারণে তাদের মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ। ডালিম কিংবা নাহিদ জিসানদের থেকে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই ‘রমজান-আশিক-মেহেদি’ কোম্পানির।

গোলাম সাকলায়েন বলেন, ‘রমজান-আশিক-মেহেদি’ কোম্পানির ভাড়াটে কিলারদের কাজ মূলত ভয়ভীতি প্রদর্শন করা। তাতেও কাজ না হলে কিলিং মিশন পরিচালনা হতো। বাড্ডা এলাকার বেশিরভাগ হত্যার নেপথ্যে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী রমজান, আশিক, মেহেদি, ডালিম, রবিন, মাহবুব ও জিসানের নাম রয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজান-আশিক-মেহেদি’ কোম্পানির সদস্যরা মহানগর ছাত্রলীগ কমিটির এক নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা বাদশাকে হত্যার হুমকি দেয়। এ বিষয়ে বাড্ডা থানায় হওয়া দুটি সাধারণ ডায়েরির ছায়া তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ফরহাদ হত্যাকাণ্ডের পর দেশত্যাগ করেন রমজানের ছোট ভাই সুজন। অস্ত্রের জোগানদাতা পুলক ওরফে পলক এবং কিলিং মিশনে ব্যাকআপ হিসেবে অংশগ্রহণকারী সাদ ওরফে সাদমান পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।

জেইউ/এমআরএম/এমএআর/এমএস