দেশজুড়ে

কুড়িগ্রামের সাংবাদিকদের আদর্শ শাহাবুদ্দিন স্যার

তিনি একজন বিবেকবান মানুষের প্রতিকৃতি। একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও সাংবাদিক। সর্বোপরি তিনি একজন সহজ-সরল ও সৎ মানুষ। তরুণ বয়সে ছিলেন শিক্ষকও। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশের টানে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতা তিন জায়গাতেই তিনি অনন্য এক দৃষ্টান্ত। শিক্ষার্থী, পরিচিত-অপরিচিত সবার কাছেই মো. শাহাবুদ্দিন পরিচিতি স্যার হিসেবে। যুবক বয়স থেকেই যে সামাজিক কাজ-কর্মের হাল ধরেছেন, এখনও ষাটোর্ধ্ব বয়সেও সেই কাজের নেতৃত্ব দিয়ে চলছেন অবিরাম।

Advertisement

তিনি ১৯৫১ সালের ১৫ মার্চ কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার টাঙ্গালিয়া পাড়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৃত এফাজ উদ্দিন ও মাতা মৃত সাহাতন নেছা। শিক্ষা জীবন শুরু হয় মরিচাকান্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ভর্তি হন নেওয়াজি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এরপর জাদুরচর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন।

পরবর্তীতে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলেও শারীরিক শিক্ষায় শিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসে। তাই উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঢাকা শারীরিক শিক্ষা কলেজে এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। সেখান থেকে নিজেরই পড়া প্রতিষ্ঠান জাদুরচর উচ্চ বিদ্যালয়ে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৬৯ সালে আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন মো. শাহাব উদ্দিন। বর্তমানে তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জনক তিনি। এরমধ্যে এক মেয়ে শৈশবে মারা গেছে। বাকি চার জন স্ব স্ব কর্মে নিয়োজিত।

Advertisement

সবেমাত্র শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছেন। এমন সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশ মাতৃকার টানে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তরুণ যুবক শাহাবুদ্দিন। ১১নং সেক্টরের সাব সেক্টর মাইনকার চর ইউনিটের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীকে উজ্জীবিত করতে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্ত এলাকা রৌমারি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘অগ্রদূত’ পত্রিকায় সাহিত্য, কবিতা ও তথ্য সমৃদ্ধ বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আবার জাদুরচর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন।

এমন সময় ১৯৭৩ সালে কুড়িগ্রাম শহরের রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষক পদে শূন্যতা সৃষ্টি হলে তিনি সেখানে যোগদান করেন। সেই থেকে কুড়িগ্রাম শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু। পাশাপাশি ডিগ্রি ও বিএড পাস করেন। দীর্ঘ ৪১ বছরের বর্ণিল শিক্ষকতা জীবনের পর ২০১১ সালের ১৪ মার্চ তিনি অবসর নেন।

শহরের রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকর্মী সাংবাদিক আব্দুল হামিদের সহযোগিতায় তিনি যুক্ত হন মহান পেশা সাংবাদিকতায়। তিনি ছিলেন দৈনিক বাংলা ও অবজারভার পত্রিকার সাংবাদিক। মূলত তার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় সাংবাদিকতায় তালিম নেন মো. শাহাবুদ্দিন। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকালীন লেখালেখি তাকে অনুপ্রাণিত করে।

এরপর ১৯৭৫ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার কুড়িগ্রাম মহকুমা প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে সেই সময়ের জনপ্রিয় বাংলার বাণীতে যোগ দেন। ১৯৯৩ সাল থেকে এখনও বাংলাদেশ বেতার, রংপুর উপকেন্দ্রের কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছেন।

Advertisement

এছাড়া ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বর্তমানে অধুনালুপ্ত কুড়িগ্রামের প্রথম দৈনিক আজকের কুড়িগ্রাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৩ সাল থেকে কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের টানা ৪ বার সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৩ দু’বার এবং ২০১৪ সালে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

বর্তমানে কুড়িগ্রামের সাংবাদিকতায় নেতৃত্ব দেয়া কয়েক জন সাংবাদিক বিশেষ করে সফি খান, রাজু মোস্তাফিজ, আব্দুল খালেক ফারুক, আহসান হাবীব নীলু ও শ্যামল ভৌমিক তার হাতেই তৈরি।

১৯৭০ সালের কথা। জাদুর চর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় আত্মমানবতার সেবায় কাজ করার প্রত্যয়ে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘সুখ-তারা যুব সংঘ’ সংগঠন। ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ কর্মটার হাতেখড়ি হয় সেখান থেকেই।

১৯৭৩ সালে কুড়িগ্রাম রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর শহরের নানা সামাজিক কাজ-কর্মে যুক্ত হন তিনি। বিশেষ করে ১৯৮৩ সালে মুক্তাগণ শিল্পী গোষ্ঠীতে কাজ করেন একাগ্রচিত্তে। ১৯৮৪ সালে কুড়িগ্রাম স্কাউট সমিতির সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং ১৯৮৭ সাল থেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে করেন দীর্ঘসময়।

১৯৮৪ সালে কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরির (পুরাতন) অবৈতনিক গ্রন্থাগারিক আব্দুল হামিদ মারা গেলে তাকে এ দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ৯০’ দশকের শেষার্ধে তিনি কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এছাড়া সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-এর সভাপতি হন।

কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু জানান, শাহাবুদ্দিন স্যার সত্যি একজন সৎ মানুষ। তিনি আমারসহ অনেকেরই সাংবাদিকতার গুরু। তারই হাত ধরে অনেকেই সাংবাদিকতার পেশায় প্রবেশ করেছেন। সাংবাদিকতা পেশা আর সামাজিক কাজ কর্মের জন্য স্যার তার জীবনের অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় করেছেন।

এমএএস/পিআর