মতামত

হাত-হাতুড়িতে শাবলের ভয়!

একপক্ষের হাতেই ক্ষমতা-খবরদারির যতো লাটাই। এরপরও লাঠি-লাথি, হাত- হাতুড়ি। এতে আপাতত বাকি থাকছে শুধু শাবল। এর আগে, লগি-বৈঠার পরবর্তী অ্যাপিসোড মানুষ দেখেছে, হজম করেছে। বড় দু’দলের রাজনীতিকরা এর ঠেলা সামলিয়েছেন।

Advertisement

এখনও বাংলাদেশের রাজনীতি সেই ক্ষত সইছে। শিক্ষাঙ্গনসহ বিভিন্ন সেক্টরে সাম্প্রতিক কাণ্ড-কারখানায় বুঝবানদের মধ্যে শঙ্কা ভর করেছে। চলমান অবস্থা-ব্যবস্থার জেরে এরপর কোন আজাব ভর করে, কে বা কারা পড়তে পারেন সেই আজাবের মূল টার্গেটে- এসব আলোচনার বাজার বেশ গরম। পথে-ঘাটে, টি-স্টলে, স্টেশন-টার্মিনালে গত ক’দিন এ নিয়ে এন্তার আলোচনা-গবেষণা, মূল্যায়ন, ভবিষ্যতদ্বাণীর ছড়াছড়ি।

শিক্ষিকাকে ধর্ষণ, প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে শিক্ষককে মারধর, প্রতিপক্ষকে হাতুড়িপেটা থেকে কবরস্থান দখল, টয়লেট থেকেও চাঁদা তোলা, কিছুই বাদ নেই। এসবের শিরোমনি ক্ষমতাসীন কোনো না লীগের কব্জায়। ছাত্র, যুব, শ্রমিকসহ বিভিন্ন লীগে ভাসছে দেশ। চারদিকে আওয়ামী লীগে কিলবিল। অন্যান্য দলের অস্তিত্ব বায়োনিকুলার দিয়ে দেখার অবস্থার দিকে যাচ্ছে।

রাস্তায়, হাটে-বাজারে সবাই আওয়ামী লীগ। কোথাও কোনো বিরোধী বা প্রতিপক্ষ নেই। এই বাতিকে অন্যদলের লোকেরাও হাল বুঝে আওয়ামী লীগের জিকির করে। যিনি বিএনপি-জামায়াত তিনিই আওয়ামী লীগের। জিন্দাবাদ-মারহাবার বদলে এখন জয় বাংলা। ভাগেযোগে উন্নয়নের কোরাস। জাতীয়তাবাদী, জামায়াতি, বামাতি আওয়ামী লীগের সার্কাসটা জমেছে বেশ। আর চান্স পেলেই শুরু হয় সরকার ও আওয়ামী লীগের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার। লক্ষণটা বড় খারাপ। বিপজ্জনক।

Advertisement

প্রতিপক্ষকে কাট টু সাইজ, সকল সেক্টরে একচ্ছত্র কর্তৃত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরার সেরা আসনে বর্তমান সরকার- এ নিয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই কারো। চারদিকের আবহাওয়া, আলো-বাতাস এমন কি পারলে গাছের পাতাও বলছে, আগামীতেও ক্ষমতা থাকছে তাদেরই কব্জায়। ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআইয়ের রিপোর্টেও সেই তথ্য দেয়া হয়েছে। বিএমআইয়ের গবেষণা রিপোর্টে অনেকটা সোজা-সাপ্টা বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আগামীদিনের ক্ষমতায়ও আওয়ামী লীগই থাকছে।

প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রীরাও প্রতিদিন কনফিডেন্সের সঙ্গে এ জানান দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের আচরণ, পদক্ষেপ এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের তৎপরতায় কনফিডেন্সের বদলে অন্যকিছু ইঙ্গিত করছে। যেন শিগগিরই তারা কোনো শাবলের কবলে পড়ে ক্ষমতাহীন হয়ে যাচ্ছেন।

কনফিডেন্স থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে হাত-হাতুড়ি, ঠেঙ্গানির বদলে রাজনীতিতে একটু স্বস্তির বাতাস দিয়ে নিজেদের নির্ভার শো করতে পারতেন। কিন্তু ভাবনমুনায় মনে হয় বিএমআইয়ের রিপোর্টকে তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না। নইলে কেন এখনো এতো ধরপাকড় ?

জনসমর্থন বাড়তেই থাকেলেতো সরকারের অনেক রিলাক্স থাকার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। কোন দলের সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয় মানে এই নয় যে প্রতিপক্ষের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল। ভয় পেয়ে কেউ চুপ করে গেলো, তার মানে এই নয় যে ভয় প্রদর্শনকারী জিতে গেলেন। অস্ত্রধারীদের মানুষ ভয় পায়। তার মানে কি সে খুব জনপ্রিয়?

Advertisement

বাংলাদেশের মতো দেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন হলে সেখানে বিরোধী পক্ষ কখনো জয়ী হয় না। কারণ, তখন প্রশাসন, আইন-আদালত সবই মানসিকভাবে সরকারের পক্ষে কাজ করে। এই অবস্থায় বিরোধী পক্ষ যতো শক্তিশালী হোক না তার বিজয়ী হবার সম্ভাবনা থাকে না। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তাই-ই বলে। কেবল যদি প্রবল গণআন্দোলন হয় সেটা ভিন্ন কথা। এটা হলেতো সংঘাত অনিবার্য। সেটা কম্য নয়। দেশের বয়সটা অনেক হয়েছে। আন্দোলন করে আর কতো গণতন্ত্রসম্মত নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করতে হবে?

সংসদ নির্বাচনের আগেই সিটি নির্বাচনগুলোতেও ব্যাপক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে। সিটি নির্বাচনগুলো বিতর্কিত হয়ে পড়লে সংসদ নির্বাচন কেমন হবে- সেই প্রশ্ন তো থেকেই যায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তার দলের নেতাকর্মীদের হাইব্রিড, কাউয়া, মুরগা ইত্যাদি নামে সম্বোধন করে মিডিয়ায় চমকপ্রদ শিরোনাম হয়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী দলীয় ফোরামে দলে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। দলের হোমড়াচোমড়া নেতাদেরও বকা দিয়েছেন আচ্ছা মতো।

তাচ্ছিল্যমূলক নাম হলেও ধারে-ভারে এ হাইব্রিড, কাউয়া, অনুপ্রবেশকারীরা কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের পুরনোদের সাইজ করে ফেলেছে। অনেকে রসিকতা করে বলেন, এটাই এখন শান্তির একমাত্র পথ। বিএনপিসহ সব দল তাদের সাইনবোর্ড গুটিয়ে আওয়ামী লীগ করে ফেললে দেশটা কত শান্তিপূর্ণ হতো। এতে আওয়ামী লীগ একেবারে নির্ভার হয়ে যেত। তাদের আর বিএনপিকে নিয়ে খিস্তি করতে হতো না। মারামারি-কাটাকাটি একান্তে নিজেরাই করতে পারতো। অন্য কারো শরীকানাই থাকতো না। তা না হওয়ায় হাত-হাতুড়ি, লাঠি-লাথি জরুরি হয়েই থাকছে। বাকি থাকছে শুধু শাবলটা।

এর পরিণতিতে প্রতিপক্ষের পাশাপাশি নিজেদের রক্তে নিজেরাই লাল হচ্ছে মাঝেমধ্যে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপিং তুঙ্গে। কর্মীরাও বিভক্ত। বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দল থেকে ঢুকে পড়ারা জেলায় মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের গ্রুপিংয়ে বড় ফ্যাক্টর। অন্তর্কোন্দলের হোতাদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ শ্রেণি আগামীতে নমিনেশন পাবে না।

সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আবৃতি আরো কড়া। তিনি বলেছেন, এদের বরাতে আগামীতে নৌকার টিকিট জুটবে না। এরা নৌকায় চড়তে পারবে না। কিন্তু যাদের লক্ষ করে এসব হুমকি-ধমকি, তারা নিশ্চিত তাদের ছাড়া নৌকা চলবে না। প্রয়োজনে নৌকার তলা ফুটা করার হিম্মত রাখেন তারা। দীর্ঘদিনের পোঁড় খাওয়া নেতা-কর্মীরা পড়ে যাচ্ছে সাইড লাইনে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এত আওয়ামী লীগার কোথাও দেখা যায়নি। কী দুঃসময় উত্তাল স্রোতের উজানে নৌকা টেনেছেন নেতাকর্মীরা। তারা বুঝে উঠতে পারছে না এ হিম্মতঅলারা কোথায় ছিলেন এতোদিন? এখন এতো ফুয়েল কোথায় পান তারা? মন্ত্রী-এমপিরা এলাকায় ক্ষমতার দাপট ধরে রাখতে হরহামেশা চিহ্নিত ভেজাল মালদের দলে টানছেন। এ চান্সে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরাও আওয়ামী লীগে ভিড়ছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করছে জয় বাংলায়। নাশকতার মামলায় চার্জভুক্ত আসামিরাও ফুল নিয়ে দুলহা সাজে যোগ দিচ্ছেন।

ট্র্যাজেডি এখানেই শেষ নয়। দলে এবং স্থানীয়ভাবে সমঝদার, নির্মোহ হিসেবে পরিচিত পুরনো আওয়ামী লীগার মন্ত্রী, এমপি, নেতাদের অনেককেও এ বিমারিতে পেয়েছে। অতীত ত্যাগ-সংগ্রামের রেশ ধুয়েমুছে তারাও এখন কামাই-রোজগারের নেশায় আসক্ত। নইলে না-কি ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তৃণমূলে কমিটি-মনোনয়ন বাণিজ্য ছাড়াও দখল, চাঁদা, টেন্ডারে পাকা হয়ে উঠছেন তারা। পাল্টে গেছে সাদামাটা জীবনাচারও। কাঙালের মতো ঘোরা এসব ব্যক্তিই এখন নানান ছুতায় কাঙালি ভোজ দেন। নতুন-পুরনো মিলিয়ে তাই দেশে এখন আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। চারদিকে শুধুই আওয়ামী লীগ।

দলের উন্নয়ন, দেশের সাফল্যের জয়গানে বাংলাদেশে এখন সবাই আওয়ামী লীগ। কোথায়ও কোনো সমস্যা দেখে না তারা। চারদিকে নিজেদেরই দেখে। মাঝখানে ফেলে রাখতে চায় একটুরা দেশকে। এরপরও কাউকে সমস্যা মনে করলে জামায়াত, স্বাধীনতাবিরোধী এমন কি জঙ্গি বানিয়ে খেল খতম করে দিচ্ছে ওয়ান-টুর মধ্যে।

কাউয়া, মুরগা, হাইব্রিড, নবাগত ইত্যাদি সম্বোধন করলেও এর মাঝে আসল আর ভেজাল আওয়ামী লীগ যাচাই করার অবস্থা নেই। ব্যাধিটার সংক্রমণ দলের বাইরেও। শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পুলিশসহ প্রশাসনেও। এই দলীয়পনা ভালো কিছুর বার্তা দেয় না। মিথ্যাচার, ধামাচাপা, আড়াল করা বা এড়িয়ে যাওয়ার সাফল্যে সাময়িক লাভবান হওয়া যায়। চাঁদাবাজি, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনোখুনি ইত্যাদিতে দলের লোক জড়িত থাকলে নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা কি সব কথা বলেন তা সবারই প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে।

টেলিভিশনে সে সব গৎবাঁধা কথার সঙ্গে মিলিয়ে কথা বলতে পারেন দর্শকেরা। অনেক দর্শক আগেই বলতে পারেন। এমন কি বোঝেন ঘটনার ঘনঘটাও। সেই লক্ষণ কিছুটা আমজনতাও মালুম করছে সাম্প্রতিক কিছু হালনমুনায়।

রহস্যজনক ঘটনা আড়াল করতে, দলকে বাঁচাতে পুলিশ বলছে, দুষ্কর্মের জন্য কারা দায়ী জানা যায়নি। মামলা হচ্ছে, আসামিদের অজ্ঞাত উল্লেখ করে। ফরেনসিক ডাক্তার বলে দেন, হত্যা নয় আত্মহত্যা। মন্ত্রীরা বলেন, ওরা আমাদের দলের নয় ওরা। অনুপ্রবেশকারী। নাশকতাবাদী।

নব্য-পুরনো লীগদের বেপরোয়া দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থার কারণে প্রতিদিনই বেড়ে চলে সরকারের বিপুল সুখ্যাতি। অস্থির উত্তেজনা ক্রমে-ক্রমে গ্রাস করেছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। রাজনৈতিক বিবাদ বিরোধ ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ায়-পাড়ায় ঘরে-ঘরে। মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠেছে দেশ। ক্ষমতার লড়াইয়ে মরিয়ার মধ্যেও চলছে আনন্দ উল্লাস। অভাবনীয় এ পরিস্থিতিপালটে দিয়েছে গণতন্ত্র-উন্নয়ন, মানবতা-দেশপ্রেমের অর্থ-সংজ্ঞা সব কিছু। বেতার- টিভি ও অন্যান্য প্রচার- প্রকাশ প্রতিষ্ঠানে দলের লোকজন দু’হাত খুলে লেখে, গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, দিন-রাত বক-বক করে- কেউ শোনে না, দেখে না, পড়ে না ও সব, বিশ্বাসও করে না।

আওয়ামী লীগের হিতাকাঙ্খীদের কেউ কেউ আফসোস করে বলে থাকেন- সরকার ও আওয়ামী লীগকে গত দশ বছরে এক ছাত্রলীগ যতো ক্ষতি করেছে তার প্রবল প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াত মিলেও মনে হয় এতটা সর্বনাশ করতে সক্ষম হয়নি। তারা প্রশ্নবিদ্ধ- বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই ছাত্রলীগ এখন কোন ঐতিহ্য ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে? যে সংগঠনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পতাকা উড়ায়, ইশতেহার পাঠ করে সেই সংগঠনের উত্তরাধিকারদের কেউ কেউ এখন সাধারণ ছাত্রদের কাছে মূর্তমান আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। গোটা ক্যাম্পাসে কায়েম করেছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। এখানে সেখানে যখন তখন ছাত্র ছাত্রীরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। রেহাই পাচ্ছেন না শিক্ষকরাও।

তাদের এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে সরকার ও দল কি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা নিরুপণের কোন ব্যবস্থা থাকলে বোঝা যেত কোন শাবল ও তলানির কোন স্তরে ঘুরপাক খাচ্ছে তারা। এর পরিমাপের যন্ত্র হচ্ছে দুটি। একটি,দলের ভিতরে মুক্ত গণতান্ত্রিক আলোচনা। দ্বিতীয়টি, নির্বাচন। দুর্ভাগ্যবশতঃ দুটির একটিও এখন আর বেঁচে নেই।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/আরআইপি