মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত ১৬ই জুলাই ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে এক ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হন। এর আগে জর্জ ডব্লিউ বুশ ও বারাক ওবামাও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন কিন্তু সেগুলো এরকম আলোচিত হয়নি।
Advertisement
একেতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই প্রতিদিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে ভালোবাসেন এবং একের পর এক টুইট বার্তায় তিনি সেসব সগর্বে বলেও থাকেন। অপরদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট কি আজীবন ক্ষমতায় থাকার পাঁয়তারা করছেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেতরে ও বাইরে দুর্বল হতে শুরু করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে ন্যাটো-কে কেন্দ্র করে। ব্রিটেনে একটি দুর্বল সরকার ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে বেরুনোর জন্য ‘নেগোসিয়েশন’-এর নামে ধুঁকছে। এমন সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভ্লাদিমির পুতিনের এই শীর্ষ বৈঠককে ঘিরে সর্বত্র আলোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিকত্বকে পশ্চিমা গণমাধ্যম ও বেশিরভাগ বিশ্লেষক এক রুচিহীন সমালোচনার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন বলে লক্ষ্য করা যায়।
হতে পারে যে, তাদের মুখে ঝামা ঘঁষে দিয়ে ট্রাম্প এই বৈঠকের আগেই বলেছেন যে, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার খারাপ সম্পর্কের জন্য এককভাবে দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বুদ্ধিতা। সন্দেহ নেই যে, তিনি নির্বুদ্ধিতার উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ বিষয়ে সর্বব্যাপী প্রচারকেও আমলে নিয়ে থাকবেন।
Advertisement
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ যে কোনো ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান বৃদ্ধি করে না সেটা ট্রাম্প বুঝতে পারলেও বাকিরা এতে যারপরনাই তাল দিয়ে চলেছেন, যদিও ট্রাম্পকে সকলেই একবাক্যে মাথা খারাপ বা পাগল হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।
সদ্য শেষ হওয়া ফুটবল বিশ্বকাপ রাশিয়াকে তথা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ভিন্ন এক অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এই বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা গণমাধ্যম এতো নির্দয় ও নিষ্ঠুর ভাবে নেমেছিল যে, প্রতিদিন এই দেশটি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। যেমনটি তারা করেছিল বেইজিং অলিম্পিক-এর সময়ে।
সবকিছু বাদ দিয়ে বেইজিং-এর কলুষিত আবহাওয়াই হয়ে উঠেছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রধান আলোচনার বিষয়। কিন্তু এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে তারা তেমন কোনো ছিদ্র খুঁজে পায়নি। সবকিছু ভালো ও নিরাপদেই সম্পন্ন হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার যে অজুহাত দেখিয়ে স্বঘোষিত বিশ্বমোড়লগণ এই বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চেয়েছিল তাদের মুখে ছাই পড়েছে।
আর বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পরদিনই যখন মার্কিন প্রেসিডেন্টেরই একক আগ্রহে হেলসিংকিতে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট শীর্ষ সম্মেলনে বসেন তখন রাশিয়ার সমালোচকদের জন্য সেটা সহ্য করা সত্যিই মুস্কিল এবং সেটিই আজকে বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমে উদগ্র হয়ে ফুটে উঠছে।
Advertisement
বৈঠকে দুই নেতা কী নিয়ে কথা বলেছেন তার চেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, এই বৈঠক থেকে আমেরিকা কী পেলো সেটাই। কিন্তু রাশিয়া এই বৈঠক থেকে কী পেলো? এই প্রশ্ন কিন্তু কোথাও মুখ্য নয়। অথচ বিষয়টি দ্বি-পাক্ষিক এবং দু’পক্ষেরই এই বৈঠক থেকে পাওয়া আছে অনেক কিছুই এবং সর্বোপরি এই বৈঠক থেকে গোটা পৃথিবীরই পাওয়ার আছে কিছু, হারানোর কিছুই নেই। স্নায়ু যুদ্ধের অবসানের পর একক মেরুকরণের পৃথিবী এক মহা বিপজ্জনক অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো। কোথাও থেকে শান্তির সুবাতাসের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো না।
মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয় যে, পৃথিবী কতোটা অসহায় হয়ে একের পর এক জাতীয়তাবাদী নেতাদের বেঘোরে পতন এবং একদা সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রসমূহ কী ভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো। এই পতনের সূত্র ধরেই লক্ষ লক্ষ মানুষ বাড়িঘর-স্বজন হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে ইউরোপের দিকে যাত্রা করে এবং ইউরোপ তাদেরকে আশ্রয় দিতে এক প্রকার বাধ্য হয়। এই উদ্বাস্তুদের কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন আজ ভাঙনের কবলে পড়েছে এবং নড়বড়ে এক অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। যদিও সেটা কতোদিন সম্ভব হবে তা নিয়ে পশ্চিমা পণ্ডিতরাই তর্ক করে চলেছেন। এর মধ্যে উত্তর আটলান্টিক চুক্তিভ’ক্ত দেশগুলির সংগঠন ন্যাটো’র বিশাল ব্যয় নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বার বার কটূক্তি ইউরোপের ভেতরে এক ধরনের ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল যে, এই বুঝি এই সংগঠনের মৃত্যু হয়। আর মৃত্যু হলে ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি ইউরোপেরই হবে। সেক্ষেত্রে ইউরোপের নিরাপত্তার কী হবে?
এরকম পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্ব মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওপর মোটামুটি আগে থেকেই খেপে আছেন। আর তার ভেতরই যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে বসেন তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখটি যে আর থাকে না তা বলাই বাহুল্য। কারণ, রাশিয়ার ওপর স্যাঙ্কশন বা অবরোধ আরোপ করার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় নেতারাই সবচেয়ে আগ্রহী ছিলেন এবং ধনী দেশগুলির ক্লাব থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা রেখেছিলেন বিরাট ভূমিকা।
এখন রাশিয়াকে সেখানে পুনরায় নেওয়ার ব্যাপারে তারা যে মোটেও আগ্রহী নয় সেটাও তারা মাত্র কিছুদিন আগেই বলেছেন। সুতরাং, তারা অত্যন্ত নাখোশ হয়েছেন ট্রাম্প-পুতিনের এই বৈঠকে।
কথায় বলে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’- বিশ্বময় সর্বত্র এই উদাহরণ ছড়ানো। ঠাণ্ডা যুদ্ধের আগে এবং পরে পৃথিবীর তাবত ক্ষুদে রাষ্ট্রসমূহ কেমন আছে তার বহুবিধ গবেষণা থেকে জানা যায় যে, স্নায়ুযুদ্ধের আগে পৃথিবীতে যুদ্ধাশঙ্কা যদি থেকে থাকে শতকরা পঞ্চাশ শতাংশ তাহলে শীতল যুদ্ধোত্তর এই আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে শতকরা সত্তরভাগ ক্ষেত্রে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গবেষকগণ ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের উদাহরণ দিয়ে একথাই মূলতঃ বলতে চেয়েছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে একা এভাবে পৃথিবীময় ছড়ি ঘোরানো সম্ভবপর হতো না। অপরদিকে, যে মুহূর্ত থেকে চীন ও রাশিয়া একত্রিত হয়ে একটি বিরোধ-দেয়াল তৈরি চেষ্টা চালিয়েছে ঠিক তখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাশঙ্কা কমতে শুরু করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে গড়ে ওঠা উগ্র ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন আইসিস দুর্বল হতে শুরু করেছে।
সিরিয়া প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্য মোটামুটি শান্তির পথে হাঁটছে। চাইলেই একজন রাষ্ট্র প্রধানকে (তিনি যতো স্বৈরাচারী বা ক্ষতিকারক হোন না কেন) আরেকটি শক্তিশালী রাষ্ট্র মহাসাগর পার হয়ে এসে উৎখাত করা ও নির্মম ভাবে হত্যা করার মতো দৃশ্য পৃথিবী এই সেদিনও প্রত্যক্ষ করেছে। পৃথিবীর ক্ষমতাবলয়ের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান্তরাল রাষ্ট্রশক্তির উত্থান প্রয়োজন, নচেৎ যে কোনো সময় সভ্যতাবিধ্বংসী পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি বৃহৎ রাষ্ট্রের দাদাগিরি সইতে সইতে এক সময় বিদ্রোহী হবেই এবং দুর্বলের আঘাত হবে ভয়ঙ্কর।
আমার মতো যারা ট্রাম্প-পুতিনের এই শীর্ষ বৈঠককে আমাদের সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার একটি বলে মনে করছেন তারা মোটামুটি এটা ভেবে খুশি যে, এতে পৃথিবীর বিশেষ করে শক্তিহীন দেশসমূহের লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। মার্কিন ‘ডীপ স্টেট’ বা অদেখা রাষ্ট্রযন্ত্র হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এ জন্য রাজনৈতিক শূল-এ চড়াতে দ্বিধা করবে না। এখনও কেউ কেউ একথা আড়ে-ঠেড়ে বলেও থাকেন যে, জন এফ কেনেডিকে হত্যা করা হয়েছিল কিউবা মিসাইল ক্রাইসিস-এর সময় রাশিয়াকে আক্রমণ না করার কারণেই।
কেন তিনি নিকিতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে আপোস করেছিলেন তার খেসারতই তাকে দিতে হয়েছে। যেমনটি প্রেসিডেন্ট রেগানকে দিতে হয়েছিল গর্বাচেভ-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার কারণে। এতোদিন ধরে রাশিয়া-বিরোধী যে অপপ্রচার তারা পৃথিবীময় চালিয়েছে তাকে বৈধ করতে হলে এবং তা থেকে ফায়দা নিতে হলে ট্রাম্প-পুতিনের এই বৈঠক যে কতোবড় বাঁধা তা নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী, তিনি রাজনীতিবিদ নন, সেটা তিনি বার বার প্রমাণ দিচ্ছেন। পুতিন একজন হিসেবি গোয়েন্দা কর্মকর্তা, তিনিও রাজনীতিবিদন নন, রাশিয়ার জনগণের জন্য তিনি একজন ঝানু ‘সিইও’।
ব্যবসায়ী ও সিইও যখন কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করেন তখন তা লোকসান নয়, লাভই বয়ে আনে। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, লাভটি কার হবে? লাভটি হবে পৃথিবীময় সাধারণ মানুষের। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে যদি উলুখাগড়া বা সাধারণ মানুষের প্রাণ যায় তাহলে রাজায় রাজায় মিত্র হলে নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের প্রাণটি বাঁচে? ঢাকা ১৭ই জুলাই, মঙ্গলবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর