শিরোনামের সঙ্গে যোগ হতে পারতো ‘ভিজিয়ে গেলো বিশ্বকাপ।’ শব্দ কমাতে তা দেয়া হয়নি। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপের সঙ্গে একেবারে শেষ মুহূর্তে যে জড়িয়ে গেলো ‘ভিজিয়ে’ শব্দটি।
Advertisement
রোববার মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালের ফাইনাল বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই হাসি-কান্নার অভিনব মিলন দেখেছে বিশ্ব। একটি বল নিয়ে ২২ ফুটবল সেনানীর ৯০ মিনিটের যুদ্ধটা ছিল আসলে প্রতীকী। পৃথিবীর সব চোখ যে ছিল মস্কোর অলিম্পিক কমপ্লেক্সে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসে।
বিশ্বকাপ ফাইনাল শুরুর আগের কয়েক ঘণ্টার উন্মাদনা দেখেছেন সবাই। দেখেছেন মাঠে ২২ ফুটবলারের সর্বশক্তি দিয়ে দেশের মাথা উঁচু করানোর লড়াই। দেখেছেন প্রায় ৮০ হাজার দর্শকের উম্মাদনা। দেখেছেন ফাইনাল শেষে হাজার হাজার মানুষের অশ্রু-কারো খুশির, কারো বেদনার।
বিশ্বকাপ ফুটবল মানে পুরো পৃথিবীকে এক সূতোয় গেঁথে দেয়ার উপলক্ষ। বিশ্বকাপ মানে জাত-গোষ্ঠির ভেদাভেদ ভোলানোর মহান তীর্থক্ষেত্র। বিশ্বকাপ মানে সবার এক সুরে গান গাওয়া। যেখানে সব দেশ, সব জাতির একই ভাষা ‘ফুটবল।’
Advertisement
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দেশ রাশিয়ার ১১ শহরে সেই বিশ্বকাপ ঘিরে পুরো একমাস ছিল হাসি-কান্নার ফুয়ারা। একটি চামড়ার গোলক যে একই সাথে কত মানুষকে হাসাতে এবং কাঁদাতে পারে সেটা বোঝা যায় বিশ্বকাপে। ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বলা হয় তার বিজ্ঞাপন বিশ্ব দেখে চার বছর পরপর।
মস্কোর লুঝনিকিতে হাসি-কান্না দেখেছি, দেখেছি স্পার্টাকে। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর সেন্ট পিটার্সবাগ, ক্রীড়া রাজধানীখ্যাত কাজান, গা পোড়ানো গরমের শহর সামারা, নিঝনি নভগোরদ আর সারানা-সব জায়গায় ছিল একই দৃশ্য। ম্যাচের আগে সবাই হাসছে, পরে এক ভাগের চোখে আনন্দ অশ্রু, আরেক ভাগের বেদনার।
আগামী চার বছর বিশ্বের সেরা দলের মুকুট থাকবে ফরাসিদের মাথায়। আপসোসে পুড়বে ক্রোয়াটরা-তীরে এসে তরী ডোবায়। এই বিশ্বকাপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষা নেবে ব্রাজিল, আর্জেন্টনা, জার্মানি, স্পেন, উরুগুয়ে, ইংল্যান্ড, পর্তুগালসহ জায়ান্ট দলগুলো। আগামীতে আরো চমক দেখানোর অনুপ্রেরণার সন্ধান করবে বেলজিয়াম, জাপান, কোরিয়াসহ অনেক দল।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাশিয়া বিশ্বকাপ ছাপিয়ে সামনে চলে আসবে কাতার। তবে লেলিন-পুুতিনদের দেশের বিশ্বকাপ মানুষকে অনেক দিনই মনে রাখতে হবে। ফাইনালের দুই দিন আগে ফিফা প্রেসিডন্টে জিয়ান্নি ইনফান্তিনো সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন বিশ্বকাপের স্বেচ্ছাসেবকদের হাসির কথা। লাল পোষাকের হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর হাসিকে ফিফা প্রেসিডেন্ট বলেন ‘বিশ্বকাপের প্রাণ।’
Advertisement
বিশ্ব ফুটবলের অভিভাবক সংস্থার প্রধান দ্বিতীয়বার বললেন বিশ্বকাপের পর্দা নামার পর। রোববার পুরস্কার বিতরণ শেষে আরেকবার লুঝনিকি স্টেডিয়ামে বক্তব্য দিলেন ইনফান্তিনো। মাঠে লড়াই করে যারা দীর্ঘ এক মাস মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন, যারা ছিলেন বিশ্বকাপের আসল নায়ক-সেই ফুটবলারদের অনন্য শৈলীর সঙ্গে তিনি স্বেচ্ছাসেবকদেরও প্রশংসায় ভাসিয়েছেন।
ফ্রান্স ও ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলাররা লুঝনিকির মাঠ ত্যাগের পরপরই সেখানে জড়ো হয়েছিলেন লুঝনিকি আর স্পার্টাকের দায়িত্ব পালন করা স্বেচ্ছাসেবকরা। ইনফান্তিনো আসলেন, তাদের আবার ধন্যবাদ দিলেন। কয়েকবার উচ্চারণ করলে ‘পাসিবা’ মানে ধন্যবাদ।
স্বেচ্ছাসেবকরা গাইলেন ‘আমি বাকরুদ্ধ, কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি। মনে রেখো চিরদিন।’ সঙ্গে নাচলেনও। ওই সময় মাঠে প্রবেশের সুযোগ হওয়া হাতেগোনা কিছু মানুষও নাচলেন তাদের সঙ্গে। গ্যালারিতে লাল ঢেউ উঠলো। এক সময় সমস্বরে আওয়াজ উঠলো ‘গুডবাই ওয়ার্ল্ড কাপ।’ হাসির সঙ্গে কারো চোখে বিদায়ের কান্নাও।
তার আগে অঝোরে বেশ সময়ে কেঁদেছিল মস্কোর আকাশ। শরীরের পানি ছেড়ে আনন্দে বাড়তি সংযোজন ছিল প্রকৃতির। বৃষ্টির ফোটা কারো গাল বেয়ে পড়া বেদনার অশ্রু মুছে দিয়েছে, কারো আনন্দ অশ্রুতে সম্পৃক্ত হয়েছে।
রাশিয়া বিশ্বকাপকে গুডবাই বলা হয়েছে রোববার রাতে লুঝনিকিতে স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েই। কিন্তু রাশিয়াকে গুডবাই জানাতে আরো দিন চারেক অপেক্ষা। চলে যাওয়া বিশ্বকাপ আর ফিরবে না। কিন্তু বিশ্বকাপের অনেক স্মৃতি কখনো মুছবেও না। ফুটবল কাউকে হাসালো, কাউকে কাঁদালো। আর ফাইনালের পর বৃষ্টি ভেজালো সবাইকে। বিশ্বকাপ যেমন হাসিয়ে-কাঁদিয়ে গেলো, তেমন ভিজিয়ে গেলো। লিভ ইট আপ।
আরআই/এসএএস/পিআর