তাদের মধ্যে একটা মিল আছে। তিন বছর বয়সে দৃষ্টি হারান দুজনেই। তবে থেমে থাকেননি। দুজনই গ্রহণ করেছেন উচ্চশিক্ষা। একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, অপরজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ করেন অনার্স-মাস্টার্স। বন্ধুর মাধ্যমে তাদের পরিচয়, প্রেম-ভালোবাসা, অতঃপর বিয়ে।
Advertisement
অন্ধকার জীবনের আলো ফেরাতে পৃথিবীতে এনেছেন ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান। চার বছর বয়সী সেই সন্তানই এখন দৃষ্টিহীন বাবা-মায়ের ‘অন্ধের যষ্টি ’। তবে তাকে নিয়েই এখন তাদের যত চিন্তা। সন্তানকে যে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু কীভাবে? দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করতে গিয়েই তো হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও চাকরি নামের সোনার হরিণের দেখা যে এখনও মেলেনি।
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ পরীক্ষা দিয়েছেন অনেক ব্যাংকে। ফলাফল শূন্য। চাকরি পাননি। কোনোটাতে লিখিত পরীক্ষা টপকাতে পারেননি আবার কোনোটাতে মৌখিকে গিয়ে হোঁচট। ঢাকার কোনো দফতরে নেই তাদের কোনো ‘মামা-চাচা’। তাই নাকি চাকরি হচ্ছে না। একগাদা চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড আর বুকভরা আক্ষেপ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় দৃষ্টি হারানো রফিকুল ইসলাম ও শাহিদা আফরোজ মীম দম্পতির।
জাগো নিউজ : কীভাবে দৃষ্টি হারালেন, পড়াশোনা কতটুকু করেছেন?
Advertisement
রফিকুল : তিন বছর বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দিনদিন চোখের দৃষ্টি কমতে থাকে। একসময় সবকিছুই অন্ধকার হয়ে গেল। তবে হার মেনে নেইনি। গাজীপুরের নীলের পাড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এ মাইনাস-গ্রেড নিয়ে এসএসসি, শহীদ এম মনসুর আলী কলেজ থেকে এ-গ্রেড নিয়ে এইচএসসি পাস করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সাইন্সে অনার্স করেছি। ২০১১ সালে ঢাকায় এসে বিয়ে করি।
মীম : জন্ম চাঁদপুরের হাইমচরে। শৈশব কাটে ঢাকার মিরপুরে। তিন বছর বয়সে হাম হয়েছিল। এরপর থেকেই চোখে দেখি না। শুধু লাইট জ্বললে-বন্ধ করলে বুঝতে পারি। মিরপুরের আইডিয়াল গার্লস কলেজ থেকে এ-মাইনাস নিয়ে এসএসসি আর বেগম বদরুন্নেসা কলেজ থেকে বি-গ্রেড নিয়ে এইচএসসি পাস করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স। খুব কষ্ট করে পড়াশোনার গণ্ডি পার করেছি, কিন্তু এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি।
জাগো নিউজ : দুজনের পরিচয় কীভাবে? পৃথিবীর আলো দেখতে পারেন, সঙ্গী হিসেবে এমন কাউকে বেছে নিলেন না কেন?
রফিকুল : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক সিনিয়র ভাই ছিলেন, উনিও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, মীম তার পূর্বপরিচিত। ভাবির কাছ থেকেই মীমের নম্বর নিয়ে কথা বলে দেখা করা, এরপর প্রেম, বিয়ে।
Advertisement
মীম : জীবনটা তো আমার, চিন্তা তো আমাকেই করতে হবে। তাই আমি সবদিক চিন্তা করে রফিকুলকে বিয়ে করি। আমার অতীত যাই ছিল, আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেছি। আমি আমার ভবিষ্যৎকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আমি ভেবে দেখেছি, এখন অনেকেই আমার বন্ধু হবে কিন্তু ভবিষ্যতে কোন বন্ধু স্থায়ী হবে- এটা আমাকেই নির্বাচন করতে হবে। তখন আমার মন রায় দেয়, আমার মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীই একমাত্র আমার মনের দুঃখ বুঝবে। অন্যরা হয়ত-বা ক্ষণিকের জন্য বুঝলেও পরবর্তীতে নাও বুঝতে পারে। এজন্য আমার সিলেকশন ওই (রফিকুল) ছিল।
জাগো নিউজ : সন্তান, সংসার জীবন কেমন চলছে?
রফিকুল : ২০১১ সালে অনার্স শেষ করার পর চাকরির জন্য ঢাকায় আসি। সে বছরই বিয়ে করি।
মীম : ঘরের রান্নাবান্না আমার মা করেন, আমি একটু হেল্প করি। সংসার জীবনে আমাদের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। তার নাম শামিউল ইসলাম সিয়াম। ওর বয়স চার। আমাদের জীবন মোটেও ভালো কাটছে না। মাসে সংসার চালাতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগে। আমাদের কোনো আয় নেই। আমার ও রফিকের আত্মীয়-স্বজনরা আমাদের আর্থিক সাহায্য করছেন। অনেক চাকরিতে আবেদন করেছি, করছি। কিন্তু কোথাও চাকরি হচ্ছে না।
জাগো নিউজ : চাকরি খুঁজছেন কখন থেকে?
মীম : ২০১৪ সাল থেকে আমরা দুজন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করতে থাকি। আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি চাকরি পাওয়ার। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিয়েছি। লিখিত পরীক্ষায় পাস করলেও মৌখিক পরীক্ষায় টিকতে পারিনি। চাকরি নামক দরিয়াটি এমন এক দরিয়া সেখানে সাঁতার কাটতে কাটতে আমরা এখন ক্লান্ত। কোন দিকে যাব, কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না! কোনোভাবেই চাকরি নামক সোনার হরিণের দেখা পাচ্ছি না। এই হরিণ ধরার জন্য হয় লাগে অনেক উঁচু লেভেলের মামা-খালা, নয় লাগে মোটা অঙ্কের টাকা। আমাদের কোনোটিই নেই।
জাগো নিউজ : চাকরির জন্য কোথায় কোথায় চেষ্টা করেছেন?
রফিক : ২০১৪ সালে প্রথম সোনালী ব্যাংকে পরীক্ষা দেই। প্রিলিমিনারি পাস করি। দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে বাদ পড়ি। এরপর শিক্ষা অধিদফতরের উপজেলা শিক্ষা সুপারভাইজার, সমাজসেবা অধিদফতরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে, ইসলামী ব্যাংক, প্রাইমারি স্কুলে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা শিক্ষা সুপারভাইজার পদে লিখিত পরীক্ষায় পাস করে মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এছাড়া সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদেও দিয়েছিলাম মৌখিক পরীক্ষা।
মৌখিকে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কীভাবে দৃষ্টি হারালাম, পড়াশোনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কাল, স্বাধীন রাষ্ট্রের উপাদান ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। ঠিকঠাক উত্তর দিয়েছিলাম। কিন্তু নাম ওঠেনি।
মীম : শিক্ষা, সমাজকল্যাণ অধিদফতর, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ নানা সরকারি দফতরে পরীক্ষা দিয়েছি। ফলাফল শূন্য।
জাগো নিউজ : কেন চাকরি পাচ্ছেন না, কী মনে হচ্ছে?
মীম : (আবেগপ্রবণ হয়ে) চাকরি না পাওয়ার কারণ আমার ঠিকই জানা আছে। কিন্তু এগুলো কি আর বলা যায়?
রফিক : আমাদের মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তাদের অনেকের চাকরি হয়েছে, হচ্ছে। দুই থেকে তিন মাস আগেও ১০ জনের চাকরি হয় সমাজসেবা অধিদফতরে। সেখানে আমরাও ইন্টারভিউ দেই। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, লিখিত পরীক্ষার আগেই তারা বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা-পয়সার লেনদেন করেন। কিন্তু আমাদের কোনো পরিচিত কর্মকর্তাও নেই, লেনদেনও করিনি; তাই হয়তো পাচ্ছি না।
জাগো নিউজ : প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করেননি?
মীম : আমি করিনি।
রফিক : ‘নিজেরা করি’ নামের এক এনজিওতে কয়েকদিন চাকরি করেছিলাম। সেখানে অনেক সমস্যা হয়েছিল, তাই চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য হই।
জাগো নিউজ : যদি চাকরি না হয়, তাহলে কী করবেন? কোনো বিকল্প পরিকল্পনা ভেবে রেখেছেন?
মীম : এমন যদি কেউ থাকতো যে আমাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করতো, তাহলে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে চিন্তা করতাম। আর তা না হলে মরতে হবে। কী করব বলেন? খাওয়া না পেলে মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে? ছেলেটা বড় হচ্ছে, টাকা ছাড়া ওকে কীভাবে মানুষ করব?
রফিক : এখন পিঠ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে, পারছি না। কোনোভাবেই পারছি না। কেউ যদি আমাদের আর্থিক সাহায্য করে তাহলে যে ব্যবসাগুলো বসে করা যায় সেগুলোর কোনো একটি বেছে নেব আমরা। যেমন- মুদি দোকান, লাইব্রেরি। যেসব কাজ হেঁটে করতে হবে না সেগুলোর কোনো একটা করব।
মীম : একটা অনুরোধ করে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু কোনোভাবেই চিঠিটা তার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। একজনের পরামর্শে স্থানীয় সংসদ সদস্যের স্বাক্ষর নিয়েও পৌঁছানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কাজ হয়নি। গণভবনে যাই, এরপরও দিতে পারিনি। চিঠিটা যদি ওনার কাছে পৌঁছানো যেত…
মীমের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তার লেখা চিঠিটি হুবহু প্রকাশ করা হলো-
এআর/জেডএ/আরআইপি