বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) সহযোগিতায় চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শিল্পী সংগ্রহের কার্যক্রম ‘নতুন মুখের সন্ধানে-২০১৮’ শুরু হচ্ছে। এ উপলক্ষে শনিবার (১৪ জুলাই) রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর ও লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পরিচালক সমিতির সঙ্গে মিডিয়া পার্টনার এসিয়ান টিভি ও ইভেন্ট পার্টনার অফট্র্যাক ইভেন্ট অ্যান্ড অ্যাডভারটাইজিংয়ের চুক্তি সম্পন্ন হয়।
Advertisement
মান্না, সোহেল চৌধুরী, দিতি, অমিত হাসান, আমিন খান, মিশা সওদাগরসহ জনপ্রিয় অনেক শিল্পী চলচ্চিত্রে এসেছেন ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে এর আগে ১৯৮৪, ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালে মোট তিনবার ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল।
প্রত্যেকবারই শিল্পী সংকটে ভুগেছিলো চলচ্চিত্র শিল্পী। আবারও শুরু হতে যাচ্ছে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’। অনেকেই বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে সমালোচনা ও হতাশাই শোনা যাচ্ছে বেশি। বারবার উঠে আসছে এই প্রশ্ন, এত শিল্পী বেকার পড়ে আছে ইন্ডাস্ট্রিতে। তাদের হাতেই কোনো কাজ নেই, সাফল্য নেই। সেখানে নতুনরা কী করে সাফল্য পাবেন? কার সঙ্গে কাজ করে সাফল্য পাবেন?
‘নতুন মুখের সন্ধানে’ নায়ক, নায়িকা, পার্শ্ব-অভিনেতা, খলনায়ক, কমেডি ও শিশুশিল্পী- এই ছয়টি ক্যাটাগরিতে শিল্পী নেওয়া হবে। মজার ব্যাপার হলো, ছয়টি ক্যাটাগরিতেই প্রচুর শিল্পী মজুদ রয়েছে ঢাকাই সিনেমার শিল্পে। তাদের মেধা ও যোগ্যতাও রয়েছে। কিন্তু কেউই নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেকেই হতাশ হয়ে নানা রকম ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে মনযোগী হচ্ছেন। নতুন যারা আসবে, তারাও ভালো ছবির অভাবে হতাশাতেই আক্রান্ত হবে। তবে শুধু শুধু কেন হতাশাগ্রস্ত শিল্পীদের তালিকা বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে? কে দায় নেবে সেইসব শিল্পীদের? শাকিবকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছেন। তাকেই সুপার হিরো বানিয়ে ইন্ডাস্ট্রিকে একনায়কতন্ত্রের দিকে নিয়ে গেছেন। দিনে দিনে অবহেলায় মরেছে নতুন সম্ভাবনা, কমেছে গুণী শিল্পীদের কদর। অনেকেই মূল্যায়ণ না পেয়ে অভিমান নিয়ে সরে গেছেন সিনেমা থেকে।
Advertisement
ইন্ডাস্ট্রি কাজে লাগাতে পারছে না রিয়াজ, শাবনূর, পূর্ণিমা, পপি, ফেরদৌস, আমিন খান, অপু বিশ্বাস, বাপ্পারাজ, কেয়ার মতো শিল্পীদের। ভালো গল্পের সিনেমার অভাবে এইসব তারকারা সিনেমা থেকে বিরতিতে রয়েছেন। যেখানে পাশের দেশ শাহরুখ, সালমান, মাধুরী, কাজল, ঐশ্বরিয়া, অজয় দেবগণ, অক্ষয় কুমার, প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণারা এখনো বাজিমাত করে যাচ্ছেন রোমান্স, অ্যাকশন, কমেডি টাইপ গল্প-চরিত্রে সেখানে আমাদের পরীক্ষীত প্রমাণিত এইসব শিল্পীরা বেকার। দায় কী শুধু তাদের?
ক্রেজ নেই, দর্শক নেয়না, জনপ্রিয়তা নেই- এইসব অজুহাত ভাববার আগে একবার ভেবে দেখা উচিত, সিনেমায় গল্পের মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! কলেজ পড়ুয়া প্রেমের বাইরে গল্প নেই। টিনএজ সেজে নায়ক-নায়িকাদের লম্ফঝম্ফ ছাড়া কোনো চিত্রনাট্য নেই। জীবনবোধের কোনো বালাই নেই সিনেমাতে। পারিবারিক চেনা আবহ নেই, শিল্পীদের ভালো উপস্থাপনের চেষ্টা নেই।
অমিতাভ বচ্চন সুন্দর উপস্থাপন, গল্প আর ব্যতিক্রমী চরিত্রে ৭৫ ব্ছর পেরিয়েও বাজিমাত করতে পারেন। অথচ আমাদের এখানে এটিএম শামসুজ্জামান, প্রবীর মিত্র, আনোয়ারা, শর্মিলী আহমেদ, আলমগীর, ফারুক, কবরী, ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহেল রানা, ওয়াসিম, ববিতা, সুচন্দা, সুচরিতা, রোজিনাদের মতো জাঁদরেল শিল্পীরা বেকার! কেন? এইসব শিল্পীদের কী নিজেদের প্রমাণ করতে হবে নতুন করে? এমন কোনো দর্শক কী আছে বাংলাদেশি সিনেমার, যিনি গেল দশ বছরে এই নন্দিত অভিনয়শিল্পীদের কোনো চরিত্র দেখেছেন যা মনে দাগ কাটবে? তবে নতুন শিল্পী দিয়ে কী হবে? আমরা তো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের মেধারই দাম দিতে পারছি না। দিতে পারছি না নিয়মিত কাজের নিশ্চয়তা।
নানা সংকটের ভিড়ে ইন্ডাস্ট্রিতে আত্মপ্রকাশ করেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া। নানা প্রতিকূলতার মুখেও উপহার দিয়েছে বেশ কিছু সুপারহিট সিনেমা। তারচেয়েও বড় কথা, জাজের হাত ধরে এসেছে বাপ্পী, মাহি, নুসরাত ফারিয়া, সিয়াম, পূজা, রোশানের মতো বেশ কিছু জনপ্রিয় তারকা। আবার জাজের বাইরেও জায়েদ খান, সাইমন, পরীমনী, বিদ্যা সিনহা মিম, আরজু, নিরব, ইমন, আইরিন, আরেফিন শুভ, জয় চৌধুরী, শাহ রিয়াজ, শিরীন শিলা, নিঝুম রুবিনা, বিপাশা কবির, আসিফ ইমরোজ, মৌসুমী হামিদ, তানহা তাসনিয়া, মিষ্টি জান্নাত, মৌমিতাসহ আরও অনেকেই চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। আরও অনেক নায়ক-নায়িকা রয়েছেন ইন্ডাস্ট্রিতে যারা লড়াই করে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সবাই ছবিহীনতায় ভুগছেন। বাড়ছে বেকারত্ব। কোনো নায়ক-নায়িকাই গেল দুই বছরে কোনো সফল সিনেমায় কাজের সুযোগ পাননি। হাতে গোনা ক’জন নায়ক-নায়িকার ছবির মহরত হচ্ছে, শুটিং শুরু হচ্ছে কিন্তু সেগুলোর সুফল ঘরে তুলতে পারছে না ঢাকাই সিনেমা।
Advertisement
এর বাইরে নতুন প্রজন্মে শিমুল খান, টাইগার রবি, চিকন আলীসহ আরও অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রয়েছেন যারা ভিলেন, কমেডিয়ান, পার্শ্ব চরিত্রের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কিন্তু বছর শেষে দেখা যায় এইসব শিল্পীরা উল্লেখ করার মতো তিনটি ছবিতেও কাজ করতে পারছেন না। আর আহমেদ শরীফ, সাদেক বাচ্চু, টেলি সামাদ, আফজাল শরীফ, মিশা সওদাগরদের যোগ্যতারও দাম দিতে পারছে না ইন্ডাস্ট্রি। এইসব অভিনেতাদের আগে সিনেমায় দেখলে উপভোগ করতেন দর্শক। সেখানে বর্তমানে তাদের অনেকেই অনিয়মিত চলচ্চিত্রে। যারাও বা কাজ করছেন উল্লেখ করার মতো কোনো চরিত্র বা সংলাপ কিচ্ছু নেই। এত সফল ও অভিজ্ঞ ভিলেন-কমেডিয়ান রেখে ঘটা করে আরও নতুন বেকার শিল্পী যোগ করার ইচ্ছে বা ভাবনা কোথা থেকে আসে?
উঠে আসছে আলোচনায়, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নানা প্রজন্মে অনেক সমৃদ্ধ তারকা শিল্পীরা রয়েছেন। রিয়াজ-শাকিবদের অভাব পূরণ করার মতো নায়কও রয়েছেন, শাবনূর-পূর্ণিমার অভাব মেটাতে পারার মতো নায়িকারাও রয়েছেন। নেই তাদের জন্য যোগ্য পরিবেশ, সমর্থন, গ্রুমিং ও কাজ।
গেল ১৪ জুলাই ঢাকা ক্লাবে আয়োজন করা হয়েছিলো ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমের সাংবাদিক সম্মেলন। সেখানে এই ব্যাপারে প্রশ্নও করা হয়েছিলো, কেউই সদুত্তর দিতে পারেননি। পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘নতুন শিল্পীর প্রয়োজন সবসময়ই আছে। দর্শক যখন পুরনো মুখে ক্লান্ত হয় তখন নতুন কিছু তুলে আনতে হয়।’
চিত্রনায়ক ফারুক বলেন, ‘আগেও নতুন মুখের সন্ধান করা হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি যখন শিল্পী সংকটে ভুগে তখন নতুন শিল্পীর প্রয়োজন হয়। কিন্তু যে প্রশ্নটি এসেছে যে এখন নতুন প্রজন্মের অনেক শিল্পী বেকার, কাজ পাচ্ছে না সেখানে নতুন মুখের সন্ধান করার গুরুত্ব নিয়ে ভাবার দরকার আছে বৈকী। শুধু শুধু আরও কিছু বেকার শিল্পী জন্ম দিয়ে লাভ কী। যারা আছে তাদেরকে কাজে লাগাতে পারলে যদি ইন্ডাস্ট্রি বেগবান হয় তবে সেটা করা উচিত।’
তাই আলোচনায় বারবার উঠে আসছে, অভিনয়ের জন্য নতুন মুখের সন্ধান নয়, খুব শিগগিরই প্রয়োজন সুন্দর ভাবনার, সৃষ্টিশীলতায় নতুন মুখের সন্ধান করা। যিনি ভালো গল্প-চিত্রনাট্য-সংলাপের জন্য ভাববেন, যিনি ভালো নির্মাণের জন্য ভাববেন, যিনি ভালো কোরিওগ্রাফির জন্য ভাববেন, যিনি ভালো সিনেমাটোগ্রাফির জন্য ভাববেন, যিনি ভালো লাইটিং নিয়ে ভাববেন, যিনি ভালো মেকাপ নিয়ে ভাববেন, যিনি ভালো সেট ডিজাইন, তারকাদের স্টাইল, ফ্যাশন, উপস্থাপনার জন্য ভাববেন। আমাদের টেকনিক্যালি দক্ষ, পরিশ্রমী ও সততায় সমৃদ্ধ মুখ দরকার।
দরকার সিনেমা বান্ধব গানের মানুষ। যারা শেখ সাদী খান, আলাউদ্দিন আলী, ইমন সাহাদের মতো সুর-সংগীতে ঝড় তুলবেন। যারা মাজহারুল আনোয়ার, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো কথা লিখবেন। যারা সৈয়দ আব্দুল হাদী, সুবীর নন্দী, খোরশেদ আলম, এন্ড্রু কিশোর, খালিদ হাসান মিলু, মনির খান, আসিফ আকবর, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, কনকচাঁপা, বেবী নাজনীনদের মতো গাইবেন।
যুগের পরিবর্তনের ‘অযৌক্তিক’ দাবি তুলে এইসব মানুষগুলোকে সিনেমা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সিনেমার খুব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ গান চলে গেছে পুঁজিবাদ দ্বারা প্রভাবিতদের হাতে। যারা সিনেমাকে শিল্প নয়, বাড়ি-গাড়ি-ব্যাংক বানানোর মেশিন ভাবেন। সিনেমায় গান এখন আলাদা বাণিজ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গৎবাঁধা আমি-তুমি আর ভালোবাসিতে ইউটিউব ভিউকে টার্গেট করে তৈরি হচ্ছে গান। সিনেমার সঙ্গে খুব একটা সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে গানগুলো দর্শকের মনে জায়গা পাচ্ছে না।
দরকার দর্শকবান্ধব সিনেমা হল। সেইসঙ্গে হল দখলের রাজনীতি থেকেও সিনেমাকে রক্ষা করা নিয়ে ভাবতে হবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র করপোরেশনকে। বাড়াতে হবে সিনেপ্লেক্স।
আর সবচেয়ে বেশি দরকার সিনেমাবান্ধব প্রযোজক। একটা সময় ছিলো যখন প্রযোজকরা আসতেন সিনেমাকে ভালোবেসে। ব্যক্তি জীবনে তিনি যেমনই ছিলেন, কখনো নিজেকে প্রচারে রাখতেন না। আর এখন যুগ পাল্টে একেবারে ডাইনোসর টিকটিকি হওয়ার মতো ব্যাপার হয়েছে। প্রযোজক ব্যস্ত থাকেন নিজের নাম ও প্রতিষ্ঠানের নাম আলোচনায় রাখতে। নিজের চেহারা দেখাতে খুব বেশি মনযোগী তিনি। কেউ কেউ অভিনয় করতেও পরিচালককে চাপ দেন। কেউ আবার সিনেমার ‘সি’ না জেনেও পরিচালক বনে যাচ্ছেন টাকার জোরে।
এইসব প্রযোজক থেকে ইন্ডাস্ট্রিকে রক্ষা করতে হবে। প্রযোজকের প্রথম থেকে আট পর্যন্ত ধ্যান-জ্ঞান হবে সিনেমা। বাকী দুই-য়ে থাকবে তার অন্যকিছু। এমন প্রযোজক আসার পথ তৈরি করতে হবে। আর এসবই হবে তখন, সিনেমার প্রস্তুতিটা যখন হবে উন্নত ভাবনা ও রুচির। যখন আভাস মিলবে লগ্নি করা টাকা প্রযোজকের ঘরে ফিরবে।
বর্তমান শিল্পীদের দিয়ে হচ্ছে না, এমন অপমান শিল্পীদের চাপিয়ে শত শত বেকার-সুযোগ বঞ্চিত শিল্পীদের তালিকা নতুন শিল্পী দিয়ে বড় না করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
এলএ/পিআর