জাতীয়

‘ওরা আমার আরিয়ানরে মাইরা ফেলছে’

‘আমার আরিয়ানের অবস্থা যখন খুব খারাপ তখন ডিউটি ডাক্তার ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। আর যে ডাক্তারের অধীনে আরিয়ানকে ভর্তি করা হয় সেই ডাক্তার সুজিত কুমার রায়কেও বারবার ডেকে পাওয়া যায়নি। ওরা আমাদের আরিয়ানের কষ্ট বোঝেনি। ওরা চিকিৎসক না খুনি, ওরা কসাই।’

Advertisement

একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে এভাবেই বিলাপ করছিলেন বাবা সাহাদাত হোসেন।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত ১৯ মাস বয়সী আরিয়ানকে রাজধানীর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক ইউনিটের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল ক থেকে জানানো হয়- আরিয়ানের ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। ওই জ্বরের সব ধরণের চিকিৎসাই চলছিল। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার বিকেল সাড়ে ৫টায় মারা যায় শিশুটি।

শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, মাত্র ১৯ মাসের শিশু আরিয়ানের মৃত্যুর কারণ চিকিৎসা কর্তব্যে অবহেলা ও অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগ। তবে কর্তব্যে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার বিষয়টি যথারীতি অস্বীকার করেছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

Advertisement

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আরিয়ানের বাবা সাহাদাত হোসেনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী সদরে। ব্যবসার কারণে রাজধানীর ধানমন্ডি থানাধীন ২৯/৩২ হাতিরপুলে স্ব-পরিবারে থাকেন তিনি। সাহাদাত হোসেন-আছিয়া খাতুন শিমু দম্পতির একমাত্র সন্তান আরিয়ানের জন্ম ২০১৬ সালের ২ ডিসেম্বর।

আরিয়ানের বাবা সাহাদাতের ছোটভাই শহীদ এলাহী জানান, গত বুধবার থেকে জ্বর ছিল আরিয়ানের। জ্বর না কমায় পরদিন বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শিশু বিশেষজ্ঞ সুজিত কুমার রায়ের অধীনে পেডিয়াট্রিক ইউনিটের শিশু ওয়ার্ডে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়।

তিনি বলেন, রাতে আরিয়ানকে ২৫০ মিলিগ্রামের সাপোজিটার দেয়া হয়। এরপর থেকে অস্বস্তি শুরু হয় আরিয়ানের। চোখমুখ কালো বর্ণ ধারণ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলে তার ডেঙ্গু হয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গুর জন্য যে ধরনের চিকিৎসা দরকার ছিল তা তাকে দেয়া হয়নি। অবস্থার অবনতির বিষয়টি বারবার জানানোর পরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয়নি। বরং মারা যাওয়ার পর আরিয়ানকে এনআইসিইউ বিভাগে নেয়া হয়।

থানা পুলিশকে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ করে শিশু আরিয়ানের মরদেহ নিয়ে রাতেই নোয়াখালীর উদ্দেশে রওনা দেয় পরিবার। সোমবার সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়।

Advertisement

সোমবার সকাল ১০টায় আরিয়ানের বাবা সাহাদাত হোসেন মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওরা (সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক) বলেছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু হলে প্রচণ্ড জ্বর আসে। তাপমাত্রা বেড়ে যায়। রক্তের প্লাটিলেট কমতে থাকবে। কিন্তু ভর্তির পর আরিয়ানের রক্তের প্লাটিলেট ছিল ৭৬ হাজার। পরে চিকিৎসা চলাকালীন ছিল ১ লাখ ২২ হাজার। শনিবার সকাল থেকে আরিয়ানের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। রোববার দুপুরে খুব খারাপ অবস্থা হয়। ওই সময় চিকিৎসকদের ডাকাডাকি করেন। কিন্তু কেউ সাড়া দেননি।’

তিনি বলেন, ‘ডাক্তারকে বিকেলে অনেক ডাকাডাকি করেছি। তিনি আসেননি। ডিউটি ডাক্তাররা বসে বসে মোবাইল ব্যবহার ও ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। তাদেরও ডেকে পাওয়া যায়নি।’

সাহাদাত হোসেন বলেন, ‘রাতে আরিয়ানকে ২৫০ মিলিগ্রামের সাপজিটার দেয়া হয়। অল্প বয়সী শিশুকে কী করে ওরা ২৫০ এমজি ওষুধ দেয়! এরপর থেকে অস্বস্তি শুরু হয় আরিয়ানের। চোখমুখ কালো বর্ণ ধারণ করে। হাসপাতাল ডেঙ্গু বললেও যেভাবে ট্রিটমেন্ট দরকার ছিল তা হয়নি। অবস্থার অবনতির বিষয়টি বারবার জানানোর পরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয়নি। বিকেল ৪টার দিকে আমার বাবুসোনা মারা যায়। এরপর ওরা নিউন্যাটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এনআইসিইউ) ভর্তি করে। এরপর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মৃত্যু ঘোষণা করে তারা। ওরা আমাদের আরিয়ানের কষ্ট বোঝেনি। ওরা চিকিৎসক না খুনি, ওরা কসাই।’

তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র সন্তান। বংশের প্রদীপ। গত ১৯ মাসের জীবন ওকে নিয়েই ছিল টইটুম্বুর। এখন আমি কী করবো। ওর মাকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। ওর মা শুধু বলছে আমার বাবুরে আইনা দাও।’

এদিকে কর্তব্যে অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ অস্বীকার করেছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সেন্ট্রাল হাসপাতালের উপ-পরিচালক (এডমিন) ডাক্তার মোজাহের হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আরিয়ানের মৃত্যু কর্তব্য অবহেলা কিংবা ভুল চিকিৎসায় হয়নি। ডাক্তাররা দেখেছে, অবস্থার অবনতি হওয়ায় এনআইসিইউতে নেয়া হয়েছে। সেখানেই রোববার বিকেল সাড়ে ৫টায় মারা যায় আরিয়ান।

তিনি আরও বলেন, আরিয়ানের ডেঙ্গু জ্বর হয়েছিল। ক্লাসিকেল ডেঙ্গুর চিকিৎসায় যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার, চিকিৎসকরা তা নিয়েছিলেন। ডেঙ্গু শক্ট সিন্ড্রমের কারণে মারা যায় আরিয়ান।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪ জুন ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের হাতাহাতি ঘটনাও ঘটে হয়। জন্ডিস রোগে শিশুটির চিকিৎসা চললেও ডেথ সার্টিফিকেটে বলা হয়, সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিল। পাশাপাশি তার হার্টের একটি এক্সরে রিপোর্টও সংযুক্ত করা হয়।

এছাড়া গত বছরের ১৮ মে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মারা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী আফিয়া জাইন চৈতি। ওই ঘটনায় হাসপাতালে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভাঙচুর চালায়। পরে অভিযুক্ত তিন চিকিৎসককে আটক করে ধানমন্ডি থানা পুলিশ।

ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও চৈতিকে দেয়া হয় ক্যান্সারের চিকিৎসা। ডাক্তাররা বলেছিলেন, আফিয়ার লিউকেমিয়া (ব্লাড ক্যান্সার) হয়েছে। সেই অনুযায়ীই তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তবে মৃত্যুর আগে জানানো হয় ক্যান্সার নয়, ডেঙ্গু হয়েছিল।

পরে সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে চিকিৎসকসহ সেন্ট্রাল হাসপাতালের ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

জেইউ/এমবিআর/জেআইএম