দেশজুড়ে

ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিকদের মশাল আব্দুল লতিফ

দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ‘বাড়িতে খাতা নিয়ে যাওয়া খারাপ দেখায়, তাই হলেই বই দেখে পরীক্ষা’ শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশের পর ঠাকুরগাঁওয়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল বাকীর চোখে পড়ে। খবরটি পড়ার পর তো সেই রাগ।

Advertisement

ক্ষেপে গিয়ে তিনি ১৩টি কেন্দ্র প্রধানকে দিয়ে খবরের প্রতিবাদতো পাঠালেনই, সেই সঙ্গে আমার ক্ষতি করার জন্যও উঠেপড়ে লাগলেন। ওই সময় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ব্যাপক নকল হওয়ায় সংবাদটি পাঠানো হয়েছিল। যা হোক, সাংবাদিকরা সবাই চেষ্টা করে আমাকে সেই যাত্রায় রক্ষা করে। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে এমন অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার শেষ নেই আমার জীবনে।

সম্প্রতি এভাবেই জাগো নিউজের সঙ্গে সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও বাস্তবতা শেয়ার করছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের প্রবীণ সাংবাদিক মো. আব্দুল লতিফ।

কখনও ভাবেননি তিনি সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়বেন। তার এক সাংবাদিক বন্ধু এমদাদুল হক স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়া থেকে বের করেন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। তেঁতুলিয়া ডেটলাইনে পত্রিকাটি ছাপা হতো ভারতের শিলিগুড়িতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পত্রিকাটি ঠাকুরগাঁও সুলেখা প্রেস থেকে বের করতেন। বন্ধু হওয়ার সুবাদে তিনি এই পত্রিকার কাজে জড়িয়ে পড়েন।

Advertisement

এমদাদুল হকের সহযোগিতায় তিনি ১৯৭২ সালে খবর পাঠানো শুরু করেন প্রাচীনতম কাগজ দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। একই সঙ্গে দৈনিক জনপদে। পরে দেশের সবচেয়ে বড় কাগজ ও প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে থাকা দৈনিক ইত্তেফাকে।

তখন ইত্তেফাকে ৫ম পৃষ্ঠার মাত্র এক চতুর্থাংশ জায়গায় ছাপা হতো ‘শহর বন্দর গ্রাম’ শিরোনামে দেশের সব খবর। ইত্তেফাকে তখন বার্তা সম্পাদক ছিলেন গোলাম সারোয়ার (বর্তমানে সম্পাদক, সমকাল) আর মফস্বল সম্পাদক ছিলেন ইয়াসীন আহম্মেদ।

১৯৭৪ সালে আব্দুল লতিফ ইত্তেফাক পত্রিকায় নিয়োগ পেলেন ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি হিসেবে। ঠাকুরগাঁও শহরে যখন মাত্র ২ থেকে ৩ জন সাংবাদিক, তখন আব্দুল লতিফ ছিলেন তখনকার সময়ের শক্তিশালী দৈনিক ইত্তেফাকের ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি। ইত্তেফাকে ওই সময় রিটেইনার অ্যালাউন্স মাসিক ১৫ টাকা, প্রকাশিত প্রতি লাইন ৬ পয়সা আর প্রতি ছবি ৫ টাকা হারে দেয়া হতো।

এরপর ১৯৯০ সালে তিনি ইত্তেফাকের পাশাপাশি সংবাদ সংস্থা ইউএনবিতে ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ইউএনবি ছাড়াও ঠাকুরগাঁও থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংগ্রামী বাংলা নামে এক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক।

Advertisement

দীর্ঘ ৪৭ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে অনেক অম্ল-মধুর স্মৃতি রয়েছে মো. আব্দুল লতিফের। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে আসার পর সম্ভবত ১৯৭৪ সালে তিনি আসেন ঠাকুরগাঁওয়ে। তখন সার্কিট হাউস ছিল না। তিনি উঠেন বড় মাঠের পাশে জেলা পরিষদ ডাক বাংলোতে। সেখান থেকে বড় মাঠে তিনি জনসভায় ভাষণ দেন।

সেদিন জীবনের প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সংবাদটি টেলিফোনে পাঠাতে হবে। এনালগ টেলিফোন। ডাক বাংলোর হলরুমে অপারেটরকে ইত্তেফাকের নম্বর দিলাম। বঙ্গবন্ধু আছেন এখানে, তার ওপর ইত্তেফাকে খবর যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সৈয়দপুর হয়ে লাইন পাওয়া গেল ঢাকায়। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সংবাদ পাঠাচ্ছিলাম। আমার চিৎকারে সবার কথা বলা বন্ধ। যা হোক যা বুঝেছি তাই ফোনে পাঠালাম। পরদিন প্রথম পাতায় আমার পাঠানো সংবাদটি ছাপা হওয়ায় ভীষণ ভালো লাগলো। একটি সংবাদ খুব সাদা মাটা, কিন্তু এখনও মনের স্মৃতিতে জমা রয়েছে। সংবাদটি একটি পরিবারকে বাঁচতে শিখিয়েছিল। সদর উপজেলার দৌলৎপুর গ্রামে একটি পরিবারের ৪ বোনই ছিল প্রতিবন্ধী।

তাদের নিয়ে ইত্তেফাকে সংবাদ প্রকাশের পর হোপ বাংলাদেশ নামে একটি এনজিও সাহায্য করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে। আমি কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে সেই পরিবারটিকে একটি পাকা ঘর নির্মাণ করে দিতে অনুরোধ করলাম হোপ বাংলাদেশকে। ওই সময় দারুণ সহযোগিতা করেছিলেন তৎকালীন ইউএনও সুলতানা পারভীন।

শেষ পর্যন্ত ইত্তেফাকের ওই সংবাদের ওপর ভিত্তি করে অসহায় প্রতিবন্ধী পরিবারের পাকা বাড়ি হলো, হলো আরও অনেক কিছু। একটি খবর ছাপা হওয়ায় যে সাড়া পাওয়া গেল ও একটি পরিবারের মানুষগুলোর মুখে যে হাসি দেখলাম তাতে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি।

তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে অনেক। তার মধ্যে একটি হলো, ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় এক কলামে বক্স করে আমার পাঠানো একটি সংবাদ ছাপা হলো ‘বিড়ালের পোস্ট মর্টেম’ শিরোনামে।

সারা দেশে সাড়া পড়ে গেল। সংবাদের বিষয়বস্তু ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের এসডিও (মহকুমা প্রশাসক) আখতার হোসেনের বাসার বিড়ালটি মারা গেছে। কীভাবে মারা গেল তা বের করার জন্য এসডিও সাহেব পশু চিকিৎসক একেজি মহীউদ্দিন সাহেবকে বাসায় ডেকে বিড়ালটির পরীক্ষা করান। মানে পোস্ট মোর্টেম করেন।

এসডিও সাহেব ইত্তেফাকে আমার বিরুদ্ধে বিরাট এক অভিযোগপত্র পাঠিয়ে আমাকে বাদ দেয়ার কথা বললেন। তৎকালীন এসডিপি আরও গোপনে আমাকে খবরটি দিলেন। আমি আমার কথা সম্পাদককে জানালাম। লিখলাম এসডিও সাহেব সঠিক কথা বলেননি। কয়েকদিন পর আমি ঢাকা গেলাম। বার্তা সম্পাদক বললেন, অনেক ডিসি ও এসডিও সাহেবদের এরকম চিঠি আসে। শিরোনামে অভিযোগের বিষয় দেখে চিঠি ফেলে দেই, পড়ি না।

প্রবীণ এই সাংবাদিক সাংবাদিকতা জীবনে যেমন সফল, তেমনি সফল পারিবারিকভাবেও। তার ২ সন্তান। একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ইমতিয়াজ মোর্শেদ ইমন ও অন্যজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ইশতিয়াক মোর্শেদ কল্যাণ। স্ত্রী পিটিআই-এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আঞ্জুমান আরা বেবী। স্ত্রী আঞ্জুমান আরা বেবীও এক সময় সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি ছিলেন।

প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল লতিফের বড় ছেলে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ইমতিয়াজ মোর্শেদ ইমনের সঙ্গে মুঠোফোনে তার বাবার সাংবাদিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এসএসসির পর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের বাইরে থাকতাম। তার আগে যখন বাবাকে দেখতাম এই সাংবাদিকতার জন্য প্রচুর কাজ করতে হতো ও কষ্ট হতো বাবার তখন। এজন্য বাবাকে খুব বকতাম। বাদ দিতে বলতাম সাংবাদিকতা। কি দরকার, আয় তো হয় না এই পেশায়, তাহলে কেন ধরে রেখেছ? বাবা তখন শুধু বলতো টাকা কি বড় বিষয়, এই সাংবাদিকতা পেশায় সম্মান আছে।

সহধর্মীনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আঞ্জুমান আরা বেবী বলেন, তার সাংবাদিকতা পেশাটি করার পেছনে আমি সবসময় উৎসাহ দিতাম। আমি নিজেও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে বিভিন্ন সময় তাকে অনেক নিউজের বিষয়ে পরামর্শ দিতাম। ভালো মন্দ নিউজ প্রায়ই সে আমার সঙ্গে আগে কথা বলে। এরপর দু’জনে ঠিক করে তারপরে পাঠানো হতো। আমি তাকে নিয়ে গর্ব করি।

নিয়মিত পত্রিকা পাঠক ও ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মনোতোষ কুমার দে সাংবাদিক আব্দুল লতিফের প্রশংসা করে বলেন, খুব ভালো ও গুছিয়ে লেখেন আব্দুল লতিফ। আমি দীর্ঘদিন থেকে ইত্তেফাক পত্রিকা নিয়মিত পাঠ করছি আর লতিফের মানবিক যে নিউজগুলো দেখেছি সেগুলোতে আবেগটা সুন্দর ফুটে উঠে। তার মধ্য লোভ লালসা কখনও দেখিনি আমি। খুব সাধারণভাবে চলাফেরা করেন লতিফ।

ঠাকুরগাঁও প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনসুর আলীর প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল লতিফ সম্পর্কে বলেন, একজন সাদামাটা ও ভালো মানুষ তিনি। কর্মব্যস্ত এই জীবনে লতিফ ভাইসহ আমি অনেক জায়গায় নিউজ এর জন্য গিয়েছি। কম কথায় তিনি খুব ভালো নিউজ লেখেন। সাংবাদিকতা পেশায় কোনোদিন তার নামে চাঁদাবাজি বা কোনো প্রকার খারাপ কাউকে বলতে শুনিনি। এবার প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে সকলের ভোটে আব্দুল লতিফ নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

আব্দুল লতিফের সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে শিশু সাংবাদিক রহিম শুভ জানায়, তিনি আমাদের জেলার সাংবাদিকতার মশাল। সর্বজন স্বীকৃত একজন ভালো মানুষ তিনি। জেলার সবাই উনাকে মূল্যায়ন করেন। এ কারণে সব সাংবাদিকরা উনাকে অভিভাবক মনে করেন।

এমএএস/পিআর