কৃষি ও প্রকৃতি

যেভাবে চাষ করবেন বাটা মাছ

গ্রাম-গঞ্জ-শহরে সবার প্রিয় বাটা মাছ। একই পুকুরে বাটা মাছ মিশ্রচাষ করা হয়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরের খাবারের পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে এর উৎপাদন বাড়ানো যায়। আসুন উৎপাদন বাড়াতে জেনে নেই বাটা মাছ চাষ করার কৌশল সম্পর্কে-

Advertisement

বাটা মাছের প্রজননের পদ্ধতি পদ্ধতি-১

কৃত্রিম প্রজননের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে একটি মাত্র ডোজ দেওয়া হয়। প্রতি কেজি স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে যথাক্রমে ৫.০ মিগ্রা. ও ২.০ মিগ্রা. হরমোন ডোজ প্রয়োগ করতে হবে। ইনজেকশন দেওয়ার পর সাথে সাথে ট্যাংকে হাপা স্থাপন করে মাছগুলি একত্রে ছেড়ে দিলে ৭/৮ ঘন্টার মধ্যে ডিম দেয়। তারপর হাপা থেকে ডিমগুলো সার্কুলার ট্যাংকে রেখে পানির ফ্লো দিতে হবে। এ অবস্থায় ১৫/২০ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে রেণু বের হবে।

পদ্ধতি-২

প্রথম ডোজ প্রতি কেজি স্ত্রী মাছকে ১ মিগ্রা., ৬ ঘন্টা পর ২য় ডোজ ৪ মিগ্রা. হিসাবে ইনজেকশন দেওয়া হয়। প্রতি কেজি পুরুষ মাছকে ২ মিগ্রা. ইনজেকশন দিয়ে স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে একত্রে ট্যাংকে বা হাপায় দিলে ৬/৭ ঘন্টার মধ্যে ডিম দিয়ে দিবে। ১৫/২০ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে রেণু বের হয়। রেণু বের হওয়ার সময় পানির ফ্লো বেশি রাখতে হবে। পানির ফ্লো কম থাকলে রেণু মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডিমের খোসা সরানোর জন্য টুকরা জাল ব্যবহার করতে হবে। তারপর সাথে সাথে পানির ফ্লো দিয়ে দিতে হবে। রেণুর বয়স ৫০/৬০ ঘন্টা হলে রেণুকে খাবার দিতে হবে। মুরগীর ডিম সিদ্ধ করে ডিমের কুসুম ১ লিটার পানির মধ্যে মিশিয়ে ট্যাংকে বা ফানেলে দিতে হবে এবং ২০/২৫ মিনিট পর পুনরায় পানির ফ্লো অল্প করে দিতে হবে। এইভাবে খাবার দেওয়ার পর রেণুগুলোকে নার্সারি পুকুরে ছাড়তে হবে।

বাটা মাছের চাষ পদ্ধতি

পুকুর বাছাই: মিশ্রচাষের জন্য পুকুর বাছাই করা জরুরি। নিম্নোক্ত গুণাবলী সম্পন্ন পুকুর বাছার করে নিলে ভালো হয়-

Advertisement

১. কমপক্ষে ৮-১০ মাস পানি থাকে এ রকম অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির পুকুর হলে ভালো হয়। ২. পুকুরের আয়তন ২০ শতাংশের চেয়ে বড় এবং পানির গড় গভীরতা ৫-৬ ফুট থাকা দরকার। ৩. পুকুর পাড়ে বড় গাছপালা না থাকাই ভালো।

পুকুর প্রস্তুতি: মাছের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে। তাই পোনা মজুদের আগে ভালোভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে-

১. আপুকুরের পাড় ভাঙা থাকলে মেরামত করে বা বেঁধে মজবুত করতে হবে। ২. পুরাতন পুকুরের তলদেশে পচা কাদা থাকলে তা তুলে ফেলতে হবে। ৩. রাক্ষুসে মাছ বা মাছ খেকো প্রাণি থাকলে তা দূর করতে হবে। ৪. পুকুরের আগাছা ও পাড়ের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে। ৫. পুকুরের পানি শুকিয়ে ফেলতে হবে। না হলে প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম রোটেনন প্রয়োগ করতে হবে। ৬. প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি চুন পুরো পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। ৭. চুন প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর প্রতি শতাংশে ৬-৮ কেজি হারে কম্পোস্ট সার ছিটিয়ে দিতে হবে। ৮. সার প্রয়োগের ৩ দিন পর প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি দিতে হবে।

আরও পড়ুন- দেশি মাছ সংরক্ষণ করবেন যেভাবে

পোনা মজুদ: পুকুর প্রস্তুতির পর পোনা মজুদ করতে হবে। পোনা মজুদের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে-

১. ভালো উৎপাদনের জন্য সুস্থ-সবল পোনা নির্দিষ্ট হারে মজুদ করা উচিত। ২. প্রতি শতাংশে ১০-১২ সেমি আকারের ৪৫-৬০টি পোনা মজুদ করা যাবে। ৩. পোনা প্রাপ্তির ওপর মজুদের সময় নির্ভর করে। ৪. মার্চ-নভেম্বর পর্যন্ত মাছ দ্রুত বাড়ায় পোনা মার্চ মাসের মধ্যেই মজুদ করলে ভালো হয়। ৫. পোনা মজুদের এক সপ্তাহ পর থেকে পুকুরে সার প্রয়োগ করতে হবে। ৬. প্রতি শতাংশে প্রথম সপ্তাহে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি দিতে হবে। ৭. পরবর্তী সপ্তাহে প্রতি শতাংশে ৪-৬ কেজি কম্পোস্ট সার দিতে হবে। ৮. পর্যায়ক্রমে অজৈব ও জৈব সার পুকুরে প্রয়োগ করলে মাছের উৎপাদন ভালো হয়। ৯. পুকুরের পানি যদি বেশি সবুজ হয়, তাহলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

খাবার: পুকুরে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি খাবারের পাশাপাশি সম্পূরক খাবারও সরবরাহ করতে হবে-

Advertisement

১. চালের কূড়া (৮০%), সরিষার খৈল (১৫%) ও ফিশমিলের (০৫%) মিশ্রণ পুকুরে সরবরাহ করতে হবে। ২. মাছ ছাড়ার ১৫ দিন থেকে প্রতিদিন সকালে মাছের ওজনের শতকরা ২-৫ ভাগ খাবার দিতে হবে। ৩. সপ্তাহে ১ দিন এবং মেঘলা দিনে খাবার সরবরাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। ৪. প্রতি মাসে একবার জাল টেনে মাছের ওজন জেনে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে

আরও পড়ুন- পুকুরে পাঙ্গাসের সমন্বিত চাষ

পরিচর্যা: পুকুর বাছাই-প্রস্তুতির পর পোনা মজুদ করে বসে থাকলে চলবে না। নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে-

১. পুকুরের আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে। ২. পানি দ্রুত কমে গেলে অন্য কোনো উপায়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। ৩. পানির স্বচ্ছতা ৮ সেন্টিমিটারের নিচে নামলে সার ও খাবার দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। ৪. পানিতে অক্সিজেনের অভাব হলে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ বা অক্সিজেন বাড়ানোর ওষুধ দিতে হবে। ৫. মাঝে মাঝে হররা টেনে পুকুরের তলার বিষাক্ত গ্যাস দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে।

আহরণ: বাটা মাছের মিশ্রচাষের পর মাছ আহরণ করতে হবে-

১. বাটা মাছ ৬-৭ মাসে খাবার উপযোগী এবং বিক্রিয়যোগ্য হয়। ২. মাছ ধরার জন্য ঝাকি জাল বা টানা বেড়জাল ব্যবহার করা যায়। ৩. মাছের মিশ্রচাষ করে হেক্টর প্রতি এক ফসলে ৫.৫-৬.০ টন মাছ উৎপাদন করা যায়।

এসইউ/জেআইএম