দেশজুড়ে

‘হাতি ফিরেছে বনে, দাগ কেটেছে মনে’

টানা দুই সপ্তাহ নির্ঘুম রাত কাটানোর পর স্বস্তি ফিরেছে আনোয়ারার পাহাড়ি এলাকা দেয়াংয়ে। পথ ভুলে লোকালয়ে চলে আসা দুই হাতি নিয়ে মোটামুটি বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যেই ছিলেন এলাকাবাসী ও প্রশাসনের লোকজন। তবে আশার কথা হলো শনিবার হাতি দুটি তাদের পথ ফিরে পেয়েছে। বনের হাতি ফিরে গেছে বনে, তবে যেতে যেতে লোকালয়ের মানুষের মনে কেটে গেছে দাগ। সেই দাগ কারও স্বজন হারানোর, কারও আবার স্বজনদের কাছে পাওয়ার।

Advertisement

বন বিভাগের পটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুটো হাতি চুনতি অভয়ারণ্য থেকে পথ হারিয়ে বাঁশখালীর পাহাড়ি অঞ্চল হয়ে আনোয়ারার পাহাড়ি এলাকা দেয়াংয়ে চলে আসে। গত দু’সপ্তাহে হাতির হামলায় এক ব্যক্তি নিহতসহ এই এলাকায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে আনন্দের বিষয় হলো এলাকাবাসী ও প্রশাসন যখন হাতি তাড়ানোর জন্য বড়ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তার আগে হাতি দুটি তাদের পথ ফিরে পেয়েছে।’

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শনিবার বড় পরিসরে লোকজন জড়ো করে হাতি তাড়ানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগে প্রাণহানিসহ নানা দুর্ঘটনা অথবা হাতির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শনিবার সকালে উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর স্কুলমাঠে এলাকাবাসীর সঙ্গে নিয়ে বৈঠকও শুরু হয়। কিন্তু তার আগেই খবর আসে শনিবার ভোর রাতেই হাতি দু’টো নিজেরাই দেয়াং পাহাড় থেকে বের হয়ে শঙ্খনদ পারি দিয়ে বাঁশখালীর পথ ধরে চুনতির দিকে এগুচ্ছে। এ খবরে এলাকায় স্বস্তির বাতাস বইছে।’

স্থানীয়রা জানান, আনোয়ারা উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় পথ হারানো বন্যহাতি দুটি বেশ কিছুদিন ধরে লোকালয়ে চলে আসছিল। তাণ্ডব চালায় ঘরবাড়ি, ক্ষেত-খামার ও ফসলি জমিতে। এতে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন এলাকার সাধারণ মানুষ। গত শুক্রবার ভোরে হাতির আক্রমণে উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে আবদুর রহমান (৭০) নামে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন।

Advertisement

এর আগে গত ৬ জুলাই রাতে উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের ছিড়াবটতলী এলাকায় বন্যহাতি দুটি লোকালয়ে প্রবেশ করে স্থানীয় কৃষকদের ক্ষেত-খামার, গাছপালা, বাড়ির দেয়াল ভাঙচুর করে। এছাড়া পশ্চিমচাল এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুস সালামের বাড়িতেও বন্যহাতির আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এ সময় হাতির আক্রমণে আহত হন এক বৃদ্ধা।

স্থানীয় বাসিন্দা জামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এলাকা পাহাড়ের পাশে হওয়ায় বিভিন্ন সময় বন্যহাতি এসে তাণ্ডব চালায়, বাড়ির দেয়াল, গাছপালা ভাঙচুর করে। এ কয়দিন আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। তবে হাতিগুলোর জন্য করুণাও হচ্ছিল। তারাতো এমনিতে আসেনি, এসেছে পথ ভুলে। এ কয়দিনে পাড়ার সব লোক একসঙ্গে ছিলাম, একসঙ্গে হাতি পাহারা দিয়েছি। এমন কি চেয়ারম্যান সাহেবও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। হাতি চলে গেছে, কিন্তু গত পনেরো দিনে গ্রামের মানুষদের মধ্যে ঐক্য বাড়িয়ে দিয়ে গেছে হাতি দুটি।’

এদিকে বনের হাতি বনে চলে গেলেও এর আগের পনেরো দিনে কমকিছু ঘটেনি আনোয়ারার পাহাড়ি ওই জনপদে। হাতি ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে সবাই মিলে পাহারা দেয়া, ফটকা ফুটানো, আগুন জ্বালানো, ঢাকঢোল পিটানো, হৈ হৈ রব তোলা; কোনোকিছুরই কমতি রাখেননি গ্রামবাসী। হাতি তাড়াতে দফায় দফায় মিটিং করেছে থানা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, বন বিভাগ, হাতি গবেষকরা।

শনিবার সকালে যখন বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর স্কুলমাঠে এলাকাবাসীর সঙ্গে বৈঠকও শুরু হয়; তখনই খবর আসে হাতি দু’টো পারি দিচ্ছে শঙ্খনদ। এ খবরে বন্ধ হয়ে যায় বৈঠক। যদিও এর আগেই হাতি তাড়াতে পুরো এলাকায় মাইকিংও করা হয়। কীভাবে তাড়াতে হবে সেটার একটি মহড়াও সম্পন্ন করে পুলিশ, গ্রাম পুলিশ সদস্য ও এলাকাবাসী। কথা ছিল এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের তিনপাশ ঘেরাও হাতি দু’টিকে বাঁশখালীর পাহাড়ি পথ ধরিয়ে দেয়া হবে।

Advertisement

বৈরাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোলায়মান জাগো নিউজকে বলেন, গত দুই সপ্তাহে হাতি দুটি উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর, কুলালপাড়া ও ফকিরখিল, বারশত ইউনিয়নের পশ্চিমচাল, বারখাইন ইউনিয়নের বেলচূড়া, বটতলী ইউনিয়নের চাঁপাতলী, জয়নগরপাড়া, কালাগাজীপাড়া ও গুচ্ছগ্রাম এলাকার ১০-১২টি কাঁচাঘর গুঁড়িয়ে দেয়। দেয়াং পাহাড়ে হাতির অবস্থান সম্পর্কে বন বিভাগকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা।

তবে সেই অভিযোগ নাকচ করে পটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বৃহস্পতিবার সারারাত এলাকায় ছিলাম। এরপরও ভোররাতে এক ব্যক্তি হাতির হামলায় মারা গেছেন। হাতির আক্রমণে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে এক লাখ টাকা ও আহত মহিলাকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেয়া হবে।’

বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছরের শরৎ ও বসন্তে চালানো পৃথক দুটি ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ে চুনতি ও আশপাশের তিন বনাঞ্চলের ২১টি স্থানে হাতির চলাচলের পথ এবং আবাসস্থলও পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৩টি স্থান চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে, সাতটি ফাইস্যাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ও একটি মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কে। চুনতিতে ১৩টির মধ্যে নয়টিতে উভয় মৌসুমে হাতির আনাগোনা দেখা যায়। প্রায় সাত মাস পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এসব ক্যামেরা। পর্যবেক্ষণে এই বনাঞ্চলে সর্বোচ্চ ৪৭টি হাতি দেখা গিয়েছিল।

গবেষকদের মতে, ‘হাতিরা তাদের চলাচলের পথে কোনো ধরনের বাধা সহ্য করে না। প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লে তারা সেটা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে। নয়তো লোকালয়ে চড়াও হয়।’

চুনতি অভয়ারণ্য বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, চুনতি অভয়ারণ্যে রয়েছে ৪২টি হাতি। হাতিগুলোর মধ্যে ৩৬টি বয়স্ক ও ছয়টি বাচ্চা। এগুলো তিন থেকে চারটি দলে বিভক্ত হয়ে চলাচল করে থাকে। বেপরোয়া ধরনের একটি হাতিকে আলাদা চলাচল করতে দেখা যায়। কখনও কখনও সব হাতিকে একসঙ্গেও দেখা যায়। পথ হারিয়ে এসব হাতির মধ্য থেকে দু’টি হাটি বাঁশখালী হয়ে আনোয়ারায় ঢুকে পড়ে।

আবু আজাদ/বিএ/পিআর