মতামত

তিন সিটি নির্বাচন : বিক্ষিপ্ত ভাবনা

 

আবার স্থানীয় সরকার নির্বাচন। রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণ হতে যাচ্ছে। খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর বেশ আলোচিত আসন্ন নির্বাচন। দুটিতেই মেয়র পদটি পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী।

Advertisement

কোন বড় গোলযোগ নেই, বিপুল কারচুপির ঢালাও অভিযোগ না থাকলেও নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে সমালোচনা আছে। আওয়ামী লীগ একাই নির্বাচন করছে। তবে বিএনপি জামায়াতের ভেতরকার অংক কেমন হবে সে আরেক আলোচনা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দৃশ্যমান হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কের ফাটল।

অনেক গণমাধ্যমই বলছে সিলেট সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বিএনপি ছাড়তে পারে জামায়াত। রাজনীতিতে অনেক সময় পাটিগণিত অপ্রযোজ্য। এই ময়দানে হামেশাই দুই আর দুইয়ে সাড়ে পাঁচ হচ্ছে, এমনকী বাইশও হচ্ছে কখনও কখনও। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় নির্বাচনে জোটের হিসেব বড় গোলমেলে।

যেহেতু পাটিগণিতের হিসেব নয়, তাই ভোট ভাগের হিসাব আসন্ন নির্বাচনে অপরিবর্তিত থাকবে, ধরে নেওয়া যাচ্ছেনা। বিশেষত, বরাবর যা বলা হয় যে জামায়াতের ভোট ব্যাংক বিএনপি’র জন্য বরাদ্দ স্থায়ীভাবে তা আর হয়তো নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দাপট বেড়েছে ঠিকই, তবে জামায়াতি ঝড়ের প্রাবল্য প্রায় উবে গিয়েছে।

Advertisement

যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরুর পর জামায়াতের ভোট ব্যাংকে কিছুটা হলেও আঘাত লেগেছে। রাজনীতির জমিতে ঠিক কী চলছে, সেটাই স্থির করে দেবে জোটের ভাগ্য। মহাজোট হোক আর ২০ দলীয় জোট হোক, যদি একেবারে নিচু স্তরের কর্মীরা উজ্জীবিত না থাকে তবে জোট করেও সফল হওয়া যায় না।

জোটের ধরন কি হবে সে এক তর্ক, তবে নির্বাচন নিয়ে বেশি যে তর্ক তা হলো এর সুষ্ঠুতা নিয়ে। নির্বাচন কমিশন সম্ভাব্য অনিয়ম প্রতিরোধে কতটা কার্যকর থাকবে– সেই নিশ্চয়তা চায় নাগরিক মন।

স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে দলীয় প্রতীকে মেয়র নির্বাচন হওয়ায় এর গুরুত্ব বেড়েছে। স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা যাচাই হয়ে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এসব নির্বাচন শুরু থেকেই রাজনৈতিক রূপ লাভ করে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বরাবরই এটি হয়ে এসেছে। সবাই আশা করে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। কিন্তু এদেশে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার রেকর্ড বিরল। বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হলেও নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক চলছেই। বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অনেকেরই আক্রমণের শিকার হচ্ছে কমিশন।

Advertisement

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাজনীতির ধরন কী হবে তা নিয়ে ভাবনা জরুরি। আগেও যা বলেছি, তা এখনও আবার বলতে হচ্ছে যে, শুধু চেয়ারম্যানকে বা মেয়রকে দলীয়ভাবে এনে তাকে স্থানীয় পর্যায়ে স্বৈরশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এক নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে। আমাদের দেশে বরাবরই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কাঠামোয়। অর্থাৎ দলীয় হোক বা না হোক চেয়ারম্যান/মেয়রই সকাল ক্ষমতার উৎস।

বর্তমান পদ্ধতি বিদ্যমান রেখে দলীয়ভাবে এ নির্বাচন হলে বাস্তবে তৃণমূলের রাজনীতি যেমন খুব একটা বদলাবে না, তেমনি স্থানীয় জনগণও শুধু কিছু নতুন রাজনৈতিক মুখ ছাড়া কিছু দেখবে না। তাই সরকারকে আইন পরিবর্তন করে এ কাঠামো বদলে সংসদীয় কাঠামো করতে হবে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সংসদীয় পদ্ধতিতে চলছে প্রতিটি স্তরের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। যখন সংসদীয় পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করবে, তাদের অংশগ্রহণ বাড়বে। কোনও নির্বাচন দলীয়ভাবে করতে হলে তা পুরোপুরি দলীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সংশোধিত যে আইনটি করেছে, তার অনেক সংশোধনী প্রয়োজন। মেয়র বা চেয়ারম্যানরা দলীয়, অথচ কাউন্সিলররা নির্দলীয়। এমন এক ব্যবস্থায় যিনি ক্ষমতাসীন দল থেকে মেয়র/চেয়ারম্যান হবেন, তিনি আসলে কাউকে ভূমিকা রাখার কোনও সুযোগ দেবেন কিনা, সেই সংশয় থেকে যাচ্ছে।

দলীয়ভাবে কাউন্সিলর হলে কে কোন দলের তা বোঝা সহজ হতো জনগণের জন্য। যদি মেয়র/চেয়ারম্যানের কোনও সিদ্ধান্ত পছন্দ না হয়, তাহলে তারা কি অনাস্থা আনতে পারবেন তার বিরুদ্ধে? না, তেমন প্রথা রাখা হয়নি। রাখা হলে সেটাই হতো ক্ষমতার ভারসাম্যের সবচেয়ে বড় সুযোগ।

এখন পদ্ধতিটা এমন যে তাতে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাজ পছন্দ না হলে তাকে কিছু করাও যাবে না। একই অবস্থা পৌরসভার ক্ষেত্রে, উপজেলার ক্ষেত্রে। স্থানীয় নির্বাচন অনেক দেশে দলীয়ভাবে হচ্ছে এবং হয়তো এক সময় বাংলাদেশেও এর সুফল আসবে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি পরিবর্তন না করা যায়, তাহলে কোনও নির্বাচনই উৎসবমুখর হবে না।

স্থানীয় পর্যায়ের উপযুক্ত লোক যদি নির্বাচনে কোনও কারণে অংশ নিতে না পারেন, তাহলে এসব নির্বাচনে শুধু দল করে, পেশী আর অর্থ শক্তি আছে এমন বাস্তবতায় দলেরও অনেক যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করতে পারে না।

দলীয় প্রতীকের পাশাপাশি আশা করতে চাই অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই স্থানীয় সরকারের উপর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দাপটও কমবে অনেকখানি। অন্যথায় সুশাসনের চেয়ে পথ প্রশস্ত হবে অপশাসনের।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস