অভিজাত শ্রেণির ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এসেছিলেন বিশ্বসেরা হয়েই। এক মৌসুম আগেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ইউরোপসেরা বানিয়ে নিজে বিশ্বসেরা হয়েছিলেন, এরপর রিয়াল মাদ্রিদে এসেছিলেন এ পর্তুগিজ যুবরাজ। ২০০৮ সালে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা এবং তাতে অসামান্য অবদান রাখার কারণে দ্বিতীয় পর্তুগিজ ফুটবলার হিসেবে একই সাথে বগলদবা করে নেন ব্যালন ডিঅ’র ও বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার।
Advertisement
এরপরই রোনালদোর ওপর চোখ পড়ে বিংশ শতাব্দীর সেরা ক্লাব নির্বাচিত হওয়া রিয়াল মাদ্রিদের। অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাসের অধিকারী হলেও সময়টা তখন ভালো যাচ্ছিলো না রিয়ালের। গ্যালাক্টিকোসদের দল ছেড়ে যাওয়া, চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে বাদ পড়া, চিরপ্রতিদ্বিন্দ্বী বার্সেলোনাকে সব জায়গায় ছড়ি ঘোরাতে দেখা ছিলো তখন রিয়াল মাদ্রিদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এমনই এক ঘোর অমানিসায় রিয়াল প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ ৯৪ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ম্যানচেস্টারের রাজপুত্র রোনালদোকে নিজেদের ডেরায় ভিড়িয়ে আনেন। সে সময়ে এটিই ছিলো কোন দলবদলের জন্য নির্ধারিত হওয়া সর্বোচ্চ ফি। বিশ্বের সবচেয়ে দামি তারকা হয়েই এসেছিলেন রিয়ালে।
দলের নতুন তারকাকে বরণ করে নিতে মাদ্রিদ ভক্তরাও কোন কমতি রাখলেন না। রোনালদোর প্রেজেন্টেশনে মাদ্রিদের হোম ভেন্যু সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রায় ৮০ হাজার দর্শক। সবাই একসাথে নিজেদের ঘর বার্নাব্যুতে রোনালদোর সাথে সমস্বরে চিৎকার করে বলেছিলেন ‘আলা মাদ্রিদ’।
Advertisement
রোনালদো আর রিয়াল তো এক হলেন। তবে কি এবারে রিয়ালের দুঃসময় কাটবে? কিন্তু তাঁর কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। বরং রোনালদো রিয়ালে আসার প্রথম চার বছরের মাঝে রিয়াল কেবল একটি লা লিগা আর কোপা দেল রেই মাত্র ঘরে তুলতে পারলো। চ্যাম্পিয়নস লিগে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত রিয়াল যেতে লাগলো বটে; কিন্তু অধরা শিরোপাটা তখনো পাচ্ছিলো না রিয়াল।
অন্যদিকে চিরপ্রতিদ্বিন্দ্বী বার্সেলোনা তখন একের পর এক শিরোপা উল্লাস করেই যাচ্ছে। রোনালদো তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসিকে টানা চারবার বর্ষসেরা হতে দেখলেন একদম সামনে থেকেই। এমন না যে, রোনালদো খারাপ খেলছিলেন। একের পর এক গোল করে যাওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দেখা পাচ্ছিলেন না তিনি এবং তার দল রিয়াল মাদ্রিদ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা আর লিওনেল মেসি এতোটাই ভালো খেলছিলেন যে রোনালদোর ওই ‘ভালো’ খেলাও কাজে আসেনি রিয়ালের।
তবে কি এখানেই শেষ রোনালদো অধ্যায়? রিয়াল মাদ্রিদও কি তাদের কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাবে না? নিয়তি তো আর সবসময় মুখ ফিরিয়ে রাখে না। ২০১৩ সালের পর রোনালদোর হাত ধরে রিয়াল মাদ্রিদের যে ইতিহাস রচিত হলো তা কেবল রূপকথাতেই পাওয়া সম্ভব। একের পর এক ব্যক্তিগত শিরোপা জিততে থাকলেন এ পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড। এর পেছনে অবশ্যই ছিলো দলগত সাফল্য!
২০১৩ তে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কাছে হারার পর রোনালদো মাদ্রিদিস্তাদের একটি হলেও চ্যাম্পিয়নস লিগ এনে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রোনালদো তার কথা রেখেছিলেন। একটি নয়, চার চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়েই তবে রিয়াল ছাড়লেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এ ফুটবলার।
Advertisement
২০১৪ সালে রিয়ালের হয়ে মূলতঃ তার সফলতার শুরু। নিজের দেশ পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ফাইনালে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে হারানো ম্যাচে তার গোল ছিলো একটি। রোনালদোর হাত ধরেই দীর্ঘ ১২ বছর পর পুনরায় ইউরোপসেরা হয় রিয়াল মাদ্রিদ। সেবার পুরো টুর্ণামেন্টে রোনালদো করেছিলেন রেকর্ড ১৭ গোল, যা চ্যাম্পিয়নস লিগের এক আসরে আর কোন খেলোয়াড়ই কখনও করতে পারেননি। পরের মৌসুমে আবারো ছন্দপতন। সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এক মৌসুমে নিজের ক্যারিয়ারসেরা ৬৯ গোল করার পরও রিয়ালকে কোন শিরোপা এনে দিতে পারেননি রোনালদো।
তারপরই শুরু মূল রূপকথার। ফুটবল কিংবদন্তি এবং রিয়ালের সাবেক খেলোয়াড় জিনেদিন জিদান এলেন রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হয়ে। এক কিংবদন্তির ছোঁয়া পেয়েই যেন আরেক কিংবদন্তি নতুন করে জেগে উঠলেন। জিদানের অধীনে যেন আরো শাণিত হয়ে উঠলেন রোনালদো। রিয়ালকে টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতালেন তিনি, চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন সংস্করণ আসার পর যা আর কোন দলই করে দেখাতে পারেনি। এ তিনটি শিরোপা জয়েই মুখ্য অবদান রোনালদোরই ছিলো। বায়ার্ন মিউনিখ, জুভেন্টাস, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, পিএসজি, নাপোলি কোন দলের বিপক্ষেই গোল করতে বাকি রাখেননি তিনি।
দীর্ঘ নয় বছর পর অবশেষে রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ১০ই জুলাই ১০৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ইতালিয়ান পরাশক্তি জুভেন্টাসে পাড়ি জমালেন এ পর্তুগিজ তারকা। তবে স্পেন ছেড়ে যাওয়ার আগে রেখে যাচ্ছেন অবিস্মরণীয় কিছু স্মৃতি।
এ ৯ বছরে কি জেতেননি তিনি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে! ভেঙে গিয়েছেন একের পর এক ব্যক্তিগত রেকর্ড। এ ৯ বছরেই সাদা জার্সি গায়ে ৪৩৮ ম্যাচে ৪৫০টি গোল করে হয়েছেন ক্লাবটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। হয়েছেন ক্লাবটির সর্বকালের সেরাদের একজন। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জিতেছেন ২টি লা লিগা, ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ২টি কোপা দেল রে, ২টি স্প্যানিশ সুপারকাপ, ৩টি উয়েফা সুপার কাপ এবং ৩টি ক্লাব বিশ্বকাপ। রিয়ালে এসে ব্যক্তিগত পুরস্কার হিসেবে জিতেছেন ৪টি ব্যালন ডিঅ’র (মোট ৫টি), ২ বার ফিফা দ্য বেস্ট, ৩ বার উয়েফার বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার এবং তিনবার গোল্ডেন বুট।
এর আগে অনেকবার দল ছাড়ার গুজব উঠলেও প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদেই থেকে গিয়েছেন রোনালদো; কিন্তু এবারে সত্যি সত্যিই সব রিয়াল ভক্তকে কাঁদিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন জুভেন্টাসে। এসেছিলেন অনেক কিছু প্রমাণের প্রত্যয় নিয়ে, কিংবদন্তি হতে। আর বিদায় নিলেন ইতিহাস রচনা করে, রাজার মতো।
নয় বছরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া রিয়াল মাদ্রিদকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় টেনে তুলে সেরা বানিয়েই তবে চলে গেলেন রোনালদো। ভক্তদের কাঁদিয়ে চলে যাবার সময় কি তাঁর নিজেরও একটি মূহুর্তের জন্যে কষ্ট লাগেনি? হয়তো লেগেছে। কিন্তু পেশাদারিত্বকে সবসময় ওপরে রাখা রোনালদো তাতে টলবেন কেন? সামনে যে নতুন রাজ্য জয়ের হাতছানি!
লিখেছেন : দারুল কারার তৌশিক
ডিকেটি/আইএইচএস/এমএস