খেলাধুলা

হঠাৎ তলানিতে ক্রিকেট, আলোয় ফিরতে দরকার কার্যকর পদক্ষেপ

বাংলাদেশের ক্রিকেটার ও বিসিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা ফিফা এবং ‘বিশ্বকাপ ফুটবলকে’ ধন্যবাদ জানাতে পারেন। বিশ্বকাপ ফুটবলের আকর্ষণ, উত্তেজনা, ডামাডোলে বিশ্বের তাবৎ খেলাধুলার মত বাংলাদেশের ক্রিকেটও আপাততঃ সাময়িকভাবে ম্লান। কিছুটা ফিকে হয়ে রয়েছে।

Advertisement

এতে করে বাংলাদেশের ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের চরম ভরাডুবি ও ন্যাক্কারজনক ব্যর্থতার খবর তুলনামূলক কম চাউর হয়েছে। খেলাপ্রেমিদের দৃষ্টি ও মন বিশ্বকাপ ফুটবলে স্থির থাকায় সাকিব, তামিম, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের নজিরবিহীন ব্যর্থতার কথাও সেভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। ক্রিকেট দলের ব্যর্থতার খবর সে অর্থে চাউরই হয়নি। সবাই ব্যস্ত বিশ্বকাপ নিয়ে।

শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেট সিরিজই নয়, বিশ্বকাপ ফুটবলের আকর্ষণ, ঐতিহ্য, আকার-আয়তন ও দর্শকপ্রিয়তার কাছে সব সময়ই বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন ঢাকা পড়ে যায়। সব আকর্ষণ, উত্তেজনা থিতু হয়ে যায়। মর্ত্যেরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বৃহত্তম যজ্ঞর আকর্ষণ-উত্তেজনা ও ডামাঢোলের কাছে টেনিসের অভিজাততম ও অন্যতম প্রাচীন আসর উইম্বল্ডনও আকর্ষণহীন হয়ে পড়েছে।

টেনিস অন্তঃপ্রাণ দর্শকও প্রিয় তারকার টেনিস ম্যাচ বাদ দিয়ে টিভির সামনে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখায় ব্যস্ত। ক্রিকেটে সময়ের দুই অন্যতম সেরা শক্তি ভারত আর ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি সিরিজও মোটেই সাড়া জাগাতে পারেনি। শেষ হয়েছে নিরুত্তাপে। আর জিম্বাবুয়ের হারারেতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে পাকিস্তানের তিন জাতি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট জয়ের খবর খোদ সে দেশেও বোধকরি সাড়া জাগায়নি। কারণ সবাই রাত জেগে বিশ্বকাপ দেখায় ব্যস্ত।

Advertisement

একই অবস্থা বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেরও। অ্যান্টিগায় প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে লাঞ্চের আগে ৪৩ রানে অলআউট হওয়া আর ইনিংস ও ২১৯ রানের লজ্জাজনক হারের খবরটি অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে দেশে কম নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

কারণ এক ও অভিন্ন। সবার চোখ রাশিয়ায়। মনোযোগ-আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ ফুটবলের আকর্ষণ ও উত্তেজনার কাছে যতই ঢাকা পড়ুক, খেলাপ্রেমিরা যতই এখন ক্রিকেট ছেড়ে ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত থাকুন না কেন, টাইগারদের ব্যর্থতার ইতিহাস-পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত তো আর হারিয়ে যাবে না। সেটা ঠিকই থাকবে।

আর সবচেয়ে বড় কথা- বিশ্বকাপ ফুটবলও প্রায় শেষের পথে। সেমির যুদ্ধ শেষ। আর মাত্র ৭২ ঘন্টা পর ফাইনাল। ১৫ জুলাই মধ্য রাতেই পর্দা নামবে বিশ্বকাপ ফুটবলের জমজমাট ২১তম আসরের। এরপর আবার চার বছরের মত বিশ্ব ফুটবলের উত্তেজনা-আকর্ষণ অনেকটাই কমে আসবে। তখন কিন্তু আবার নিজের নীড়ে ফেরা। আবার সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বেন যে যার প্রিয় খেলা নিয়ে।

তখন ঠিকই জানা হয়ে যাবে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ক্যারিবীয়দের কাছে নাকাল টাইগাররা। ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার কেমার রোচ, গ্যাব্রিয়েলদের বোলিং তোড়ে খড়-কুটোর মত উড়ে যাচ্ছেন তামিম, লিটন, মুমিনুল, মুশফিক, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহরা।

Advertisement

রুবেল, কামরুল ইসলাম রাব্বি, মিরাজ, রাহি ও সাকিবের মত বোলারও যে হালে পানি পাচ্ছেন না- তা নিয়েও রাজ্যের হৈ চৈ হবে। বিশ্বকাপের সব আকর্ষণ, উত্তেজনা আর মোহ শেষে সবাই জানবেন, দেখবেন-শুনবেন জাতীয় দলের খারাপ খেলাই শেষ কথা নয়। গোটা দেশের ক্রিকেটের ‘বৃহস্পতি’ হারিয়ে গেছে। তার বদলে রীতিমত ‘শনি’ এসে ভর করেছে।

জাতীয় দলের পাশাপাশি চরম ব্যর্থ বাংলাদেশ ‘এ’ দলও। ঘরের মাঠে লঙ্কান ‘এ’ দলের কাছে চরমভাবে পর্যদুস্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম। চার দিনের আন-অফিসিয়াল টেস্ট ম্যাচে ইনিংস পরাজয়ের লজ্জায় ডুবেছেন সৌম্য, সাদমান, সাইফ, জাকির, আফিফ ও সাঞ্জামুলরা। তৃতীয় শেষ আন-অফিসিয়াল টেস্ট ম্যাচে চার দিনও টিকে থাকতে পারেনি বাংলাদেশ ‘এ ’ দল। সিলেটে আজ বৃহস্পতিবার সকাল, মানে তৃতীয় দিন প্রথম সেশনেই ম্যাচ শেষ।

সবচেয়ে বড় কথা, ঘরের মাঠে চেনা-জানা উইকেটে লঙ্কান ‘এ’ দলের বোলিংয়ের মুখে একবারের জন্যও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি স্বাগতিক তরুণরা। প্রথমবার ১৬৭ রানে অলআউট হবার পর লঙ্কান ‘এ’ দলকে ৩১২ রানে বেঁধে ফেলায়ও কোনই ফায়দা হয়নি। কারণ, দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১০৭ রানেই সবাই আউট বাংলাদেশের। তাই ইনিংস ও ৩৮ রানে হারের লজ্জা এসে গ্রাস করেছে।

তার মানে কি দাঁড়ালো, ওদিকে জাতীয় দল এর-ওর কাছে খাবি খাচ্ছে। দেরাদুনে আফগানদের দাপটে দিশেহারা হয়েছে। তিন ম্যাচের সিরিজে হয়েছে তুলোধুনো। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে প্রথম টেস্টে নিজেদের সর্বনিম্ন ৪৩ রানে অলআউট হবার লজ্জাসহ ইনিংস পরাজয়। এখন ঘরের মাঠে ‘এ’ দলের করুন পরিণতি। চারদিকে খারাপ খবর। বাজে পারফরমেন্স।

কেউ কেউ হয়ত বলবেন, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। খারাপ সময় আসতেই পারে। সব দলেরই আসে। যায়। হ্যাঁ, আসতেই পারে। আসেও। তাই বলে টি-টোয়েন্টি আর টেস্ট দুই ফরমাটেই খারাপ পারফরমেন্স? তাও মাস খানেকেরও কম সময়ের মধ্যে। আর জাতীয় দলের পাশাপাশি ‘এ’ দলও খারাপ খেলবে, ইনিংস পরাজয়ের লজ্জায় ডুববে। তাও ঘরের মাটিতে, শ্রীলঙ্কার কাছ নাকাল হবে?

সেটা আর নিশ্চয়ই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তখন আর তাকে আর হেলাফেলা করার বা ছোট-খাট ঘটনা বলে চিহ্নিত করার কিছু নেই। বরং জাতীয় দলের পাশাপাশি ‘এ’ দল যখন ঘরের মাঠে প্রায় কাছাকাছি শক্তি ও সামর্থ্যের শ্রীলঙ্কার ‘এ’ দলের কাছে ইনিংসে পরাজয় মানে- এক বড় নেতিবাচক বার্তা।

তার মানে বুঝতে হবে, জাতীয় দল শুধু নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই খারাপ সময় চলছে। চারিদিকে খারাপ পারফরমেন্স , করুন পরাজয় আর ব্যর্থতা সঙ্গী হয়ে দেখা দিয়েছে। যা স্বাভাবিক ঘটনা তো নয়ই। রীতিমত অস্বাভাবিক ঘটনা এবং বিষম চিন্তারও কারণ।

এ দল মানে ভবিষ্যত প্রজন্ম দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা নিউজিল্যান্ডের অনভ্যস্ত কন্ডিশনে গিয়ে খাবি খেলে, ইনিংসে হারলে তবু একটা কথা ছিল; কিন্তু তারা হেরেছে ঘরের মাঠে। চেনা-জানা পরিবেশে।

তার মানে পরিষ্কার, যাদের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে বা যাদের আগামীর বাংলাদেশ হিসেবে ভাবা হচ্ছে- হয় তাদের মেধা কম, সামর্থ্যে ঘাটতি পরিষ্কার। মান বর্তমানের চেয়ে খারাপ। তাই তারা ঘরের মাঠেও ইনিংস পরাজয়ের লজ্জায় ডুবছে। তার মানে বুঝতে হবে, সামগ্রিকভাবে দেশের ক্রিকেটের মান কমে গেছে। কোন না কোন জায়গায় বড় ধরনের ফাক-ফোঁকর আছে।

দেশের ক্রিকেটের উন্নয়ন কার্যক্রম নিশ্চয়ই সঠিক ভাবে এগুচ্ছে না। যা যা দরকার, প্রয়োজন, তা হচ্ছে না। এক কথায় নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটছে। কোথাও না কোথাও বড় ধরনের ভুল ত্রুটি এবং অনিয়ম হচ্ছে। তারই কারণে জাতীয় দলের পাশাপাশি ‘এ’ দলও খারাপ খেলছে।

ক্রিকেট বোর্ডকে এখনই এ ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। জানা হয়ে গেছে, বাংলাদেশের তামিম, সাকিব, মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর মত ঝানু-ঝানু ব্যাটসম্যানেরও ফাস্ট-বাউন্সি পিচে ভাল খেলতে সমস্যা হয়। তারা নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেন না। তারওপর বল সুইং করলে ‘ত্রাহিমধুসুদন’ বা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। এক কথায় স্বাভাবিক ব্যাটিং করতে সমস্যা হয়।

এর বাইরে এখন দেখা যাচ্ছে পাইপ লাইনের ক্রিকেটারদেরও সামর্থ্যে ঘাটতি। বড়রা তো দেশের বাইরে ফাস্ট-বাউন্সি আর বিষাক্ত সুংইংয়ের মুখে কুপোকাৎ। তারা ঘরের মাঠে লঙ্কান মাঝারি বোলিং শক্তির সামনেই মুখ থুবড়ে পড়ছেন। তার মানে সামর্থ্যে ঘাটতি। এটা দেশের ক্রিকেটের জন্য মোটেই ভাল খবর নয়।

আশ-পাশে আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ড ও নেপাল উন্নতি করছে দ্রুত। সিঁড়ি বেয়ে ক্রমেই ওপরে উঠে আসছে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা সেই কল্পলোকের ‘খরগোশের’ মত। ভুলে গেলে চলবে না পর্যাপ্ত গতি থাকার পরও খরগোশ কচ্ছপকে হেয় বা ছোট করে দেখে নিজের আলস্যের কারণে পিছিয়ে পড়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত কচ্ছপের কাছে হেরে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড, জাতীয় দল এবং ‘এ’ দলের ম্যানেজমেন্টেরও সম্বিৎ ফিরে পাবার এখনই সময়। এক বছরেরও কম সময় পর বিশ্বকাপ। এখনই কোথায় কি সমস্যা? তা খুঁজে বের করে সমাধানে ব্রত হওয়া দরকার।

আর শেষ কথা হলো, হাজারো কোচিং প্রোগ্রাম করে আর মোটা অংকের অর্থে হাই প্রোফাইল কোচ এনে লাভ হবে না। সবার আগে মন ও চোখ দিতে হবে ঘরের ক্রিকেটে। যে করেই হোক, দেশের ক্রিকেটকে উন্নত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, বোর্ডের চাকচিক্য কিন্তু জাতীয় দলের পারফরমেন্স ও ফলের ওপর নির্ভর করে। জাতীয় দল, ‘এ’ দল এবং বয়সভিত্তিক দলগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশে ও বাইরে ভাল খেলে সাফল্য পেলেই কেবল বিসিবির মুখ রক্ষা হবে। ওই দলগুলো খারাপ খেলার অর্থ ক্রিকেটের অবনমন। বোর্ডেরও অবনতি।

সে কারণেই সবার আগে দরকার ঘরোয়া ক্রিকেটে মনোযোগি হওয়া। ঘরোয়া ক্রিকেটের মান না বাড়ানো খুবই জরুরি। এ দিকে বোর্ডের আরও অনেক যত্নবানও হওয়া খুব জরুরি। যেতনতেনভাবে চলছে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট। মান খারাপ। অবকাঠামো দূর্বল। সুযোগ সুবিধা অপর্যাপ্ত। তাই মানও কম। প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আকর্ষণও তেমন নয়। সর্বোপরি দুর্বল ব্যবস্থাপনা। অপরিহার্য্য দুই উপাদান ‘উইকেট, আম্পায়ারিংয়ের’ অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। অনেক ক্ষেত্রেই খেলা পরিচালনায় অনিয়ম ও অব্যস্থাপনায় ভরা।

তারই নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও দূর্বল হয়ে পড়েছে ক্রিকেটাঙ্গন। সে কারণেই ব্যর্থতা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। এই উপলব্ধিটা সবার আগে দরকার যে, ক্রিকেটে হঠাৎ দুঃসময় বিরাজমান। কেন এই খারাপ সময়। সমস্যাটা কোথায়? তা খুঁজে বের করারও এখনই সময়।

শুধু প্রচুর অর্থ খরচ করে বিদেশি কোচ নিয়োগ আর ঘটা করে বিপিএল আয়োজনই ক্রিকেটে উন্নতিতে শেষ কথা নয়। ক্রিকটের সত্যিকার উন্নতির জন্য সবার আগে দরকার ঘরোয়া ক্রিকেটের মান উন্নত করা। ভাল স্পোর্টিং উইকেটে খেলা আয়োজন নিশ্চিত করা এবং আম্পায়ারিংয়ের মান নিশ্চিত করা ।

যে করেই হোক, ঘরোয়া ক্রিকেটকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রিমিয়ার, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ ও অন্য জুনিয়র লিগে যাতে অনিয়ম, বাজে এবং পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিং না হয়, খেলার মান-পরিবেশ ও আনুসাঙ্গিক সুযোগ সুবিধা যাতে ভাল হয়, তা নিশ্চিতে অতি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হয় সম্মুখে শুধুই অন্ধকার।

এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম