মতামত

দলকানা ব্যাধি

মনের গহীনে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। যেখানে ছিল আস্থার বৃক্ষ, ঝরে পড়েছে সেই বৃক্ষের পাতা। ছায়া নেই। প্রখর রোদে শীতল উদ্যান পরিণত হয়েছে ধূ ধূ বালুচরে। যার বালিঝড়ে আক্রান্ত মন।

Advertisement

আস্থা ছিল চিকিৎসকে। মনে পড়ে কোন এক ঈদের দিন ছোটবোন কিভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছিল বিছানায়। ভয়ার্ত মা-বাবা এবং আমি ছুটে গেছিলাম ডাক্তারের বাড়ি। ঈদ আনন্দকে সরিয়ে রেখে তিনি ছোটবোনকে সুস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

দুপুর থেকে রাত পাশে থেকে সুস্থবোনকে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে পারাই ছিল তার ঈদ আনন্দ। এখনও সেই চিকিৎসকের মায়াবী মুখটি ভুলতে পারিনি। যেমন ভুলিনি তারকা খচিত আরেকজন চিকিৎসকের কথা। বোকাবাক্সের পরিচিত মুখ। যার আনুকুল্য পেলে মা’কে হাসপাতালে এক সপ্তাহ আগে ভর্তি করা যেতো। তিনি এখনো আমার সঙ্গে থাকতেন কিনা জানিনা, তবে যথাযথ চিকিৎসা পেতেন হয়তো তিনি।

নিজের চোখ নিয়েও দেখেছি চিকিৎসকদের রকমারি রূপ। কেউ কেউ আমাকে মওকা মতো পেয়ে লাভের অংক গুণতে শুরু করেছিলেন। আবার বিপরীত অনেকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল সকল শঙ্কা। ভুলতে পারিনি একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের কথা তিনি কিভাবে রোগীদের ধমকে ধমকে আতঙ্কিত করে তুলছিলেন। আমার এক সহকর্মী যখন সংকটাপন্ন তখন আরেক বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসককে দেখেছি কতো নির্দয় ভাবে রোগীকে হাসপাতাল থেকে বিদায় করে দিতে চাচ্ছেন।

Advertisement

অন্যদিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসকদের দেখতে পেলাম কিভাবে মূর্মূষু আমার সেই সহকর্মীকে কয়েকদিনের অক্লান্ত চেষ্টায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনলেন। অহেতুক সার্জারি, অহেতুক এবং অসংখ্যবার পরীক্ষা-নীরিক্ষা, ভুল চিকিৎসা, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়ার কর্কশ ও বেনিয়া চিকিৎসকেরা আড়াল করে দেন তাদের অসংখ্য সহকর্মীর মায়াঘেরা হাসিমুখকে। রাইফাকে হারিয়ে বিষণ্ণ হই আমরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি পড়া হয়নি। কলেজের উপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাতা ছিল। কিন্তু কাজের সূত্রে, ব্যক্তিগত পড়াশোনার ছুঁতোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর, চত্বর, কেন্টিন অচেনা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নবীন-প্রবীণ পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখার সুযোগ হয়েছে।

সান্নিধ্য পেতে গিয়ে নতজানু হয়েছি কতো শিক্ষকের জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বের সামনে। শিক্ষক বৃক্ষ হোন সেই প্রচলিত কথার প্রমাণ পেয়েছি ষোলআনা। তাদের প্রত্যেকের ছিল রাজনৈতিক বিশুদ্ধতা। তারা নিজ নিজ রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী হলেও, ক্লাসরুমে বা জ্ঞান চর্চায় কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে ওকালতি করেননি। পদের জন্য সেই সমকালীন শিক্ষকদের কেউ কেউ লালায়িত থাকলেও বেশির ভাগ শিক্ষক তাদের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেন লেখা ও বক্তৃতায়।

সেই শিক্ষকদের কাছে সাধারণ ও সকল মতের শিক্ষার্থীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছিল। এখন শিক্ষকরা সেই বৃক্ষের ছায়ায় নেই। তারা শিক্ষার্থীদের বিপরীত শক্তির দেয়াল তুলে দাঁড়িয়েছেন। ক্ষমতা বলয়ের ঠিকাদার এবং রক্ষকের ভূমিকায় তারা। শিক্ষার্থীদের কোন দাবি বা অধিকারের সঙ্গে নেই তারা। বরং সেই অধিকার বঞ্চিত করা, অধিকারের দাবিকে দমনের কর্মী হয়ে উঠেছেন শিক্ষকেরা।

Advertisement

কতিপয় শিক্ষক দিতে চান, থাকতে চান ছায়া হয়ে, কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পেতে জিভ জল আসা সহকর্মীদের জন্য তারাও বিপন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে নিলাম উঠে তোষামোদের মুদ্রায়। তোষামোদে কেনা পদ অবরুদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমন। আমরা আতঙ্কিত হই, শিক্ষকের হিংস্র অবয়ব দেখে।

চিকিৎসক এবং শিক্ষকদের মতো অন্য পেশাতেও যে স্খলন হয়নি তা বলা যাবেনা। সকলেই অন্ধ আজ। দলের চালসে পড়ে ঢুকে পড়েছেন নানা পেশার অলিগলিতে। গণমাধ্যমকর্মীরাও এই রোগ মুক্ত নন।

শিক্ষক, চিকিৎসক মহান পেশা বলে সমাজে প্রচলিত প্রবাদ আছে মানুষের জীবন গড়া এবং রক্ষার সঙ্গে এই দুই পেশা যুক্ত। একই ভাবে সমাজকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা আছে গণমাধ্যমকর্মীর। এই তিন যদি ‘দলকানা’ব্যাধিতে ভোগে তাহলে? ভাবতেই শরীর ও মন ভয়ে শীতল হতে শুরু করেছে।

চিকিৎসকরা দলকানা বা রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে থাকে বলেই , রোগীদের জিম্মি করে ধর্মঘট ডাকার দুঃসাহস দেখায়। শিক্ষকরা দলকানা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেদের আদর্শিক দলকেই দেখতে পান । বাকিরা বহিরাগত। আর গণমাধ্যমকর্মীরা একই ব্যাধিতে ভুগছেন বলে খবরে অস্ত্রোপচার করেন।

লেখক : হেড অব নিউজ, সময় টিভি।

এইচআর/আরআইপি