আন্তর্জাতিক

রাষ্ট্র পরিচয়হীন পাঁচ লাখ মানুষের ‘নায়ক’ একাপ্পল

কিশোরদের কাছে তিনি একজন সন্ন্যাসী, একজন কোচ। এখন নায়ক হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছেন বিশ্বজুড়ে। থাইল্যান্ডের উইল্ড বোর কিশোর ফুটবল দলের রাষ্ট্র-পরিচয়হীন বেশ কয়েকজন সদস্যের একজন তাদের কোচ একাপ্পল চ্যান্তাওং। ১৭ দিন চিয়াং রাইয়ের জলমগ্ন থ্যাম লুয়াং গুহায় আটকা দলের ১২ সদস্য ও কোচকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিশোরদের উদ্ধারের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান দেশটিতে লুকিয়ে থাকা রাষ্ট্রপরিচয়হীন মানুষদের নাগরিকত্ব না দেয়ার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে।

Advertisement

মঙ্গলবার সর্বশেষ বের করে আনা গ্রুপে ছিলেন ২৫ বছর বয়সী কোচ একাপ্পল; অন্ধাকারচ্ছন্ন গুহায় অনাহারে দিনাতিপাত করার সময় ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোরদের নিজের স্নেহের পরশে রেখে এখন দেশজুড়ে প্রশংসা পাচ্ছেন।

কিশোরদের দলে একমাত্র তিনিই ছিলেন প্রাপ্ত বয়স্ক। গত ২৩ জুন ওই গুহায় প্রবেশ করার পর কর্দমাক্ত ছোট এক ঢিবিতে তাদের প্রথমবারের মতো খুঁজে পান ব্রিটিশ দুই ডুবুরি। এই ঢিবির অবস্থান গুহার প্রবেশমুখ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে গুহার ভেতরের অংশ তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে তারা অবস্থান নেয়।

অারও পড়ুন : অসম্ভব এক মিশনের সফলতার গল্প

Advertisement

থ্যাম লুয়াং গুহার ভেতর থেকে যখন বিপজ্জনক প্রস্থানের অপেক্ষা করছিলেন একাপ্পল; তখন গুহার বাইরে থাইরা তাকে মায়ে সাই সম্প্রদায়ের একজন ভদ্র, বিনয়ী ও দায়িত্ববান সদস্য হিসেবে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন।

গত ৭ জুলাই গুহার ভেতর কিশোরদের কোচের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, সব বাবা-মা’র পক্ষ থেকে অনুরোধ, সব শিশুর যত্ন নেবেন। নিজেকে দোষী ভাববেন না। পরে কিশোরদের বাবা-মার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ক্ষমা চান কোচ একাপ্পল। একই সঙ্গে শিশুদের সর্বোত্তম যত্ন নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

তার এই হৃদয়স্পর্শী চিঠি থাই জনগণের মন জয় করে; বিশেষ করে যারা আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির নাগরিকত্ব পায়নি। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, থাইল্যান্ডে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার রাষ্ট্রহীন মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে অনেকেই পার্বত্য অঞ্চলীয় যাযাবর সম্প্রদায়ের; বাকিরা বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর। যারা শত শত বছর ধরে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস ও চীনের খণ্ডিত ভূমি যা ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ হিসেবে পরিচিত থাইল্যান্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত মায়ে সাইয়ে বসবাস করে আসছেন।

আরও পড়ুন : থাই কিশোরদের শ্বাসরুদ্ধকর গুহাবাস নিয়ে হলিউড চলচ্চিত্র!

Advertisement

জাতীয়তা নেই, দেশ নেই

উইল্ড বোর ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা নোপ্পার্যাত খান্থাভং বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন, থাই গুহায় আটকা পড়া কিশোর ফুটবল দলের কোচ একাপ্পলের পাশাপাশি তিন সদস্য দুল, মার্ক ও তি যাযাবর সম্প্রদায়ের; যাদের কোনো রাষ্ট্রীয় পরিচয় নেই।

‘জাতীয়তা পাওয়া ছেলেদের সবচেয়ে বড় আশা... অতীতে চিয়াং রাইয়ের বাইরে এই তিন কিশোরের খেলতে যাওয়ার সময় ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাদের পরিচয় না থাকার কারণে চিয়াং রাইয়ের বাইরে চলাচলে কড়া বিধি-নিষেধ রয়েছে।’

এমনকি আগামী মৌসুমে ফুটবল ক্লাব ম্যানেচেস্টার ইউনাইটেডের আমন্ত্রণে খেলা দেখতে যাওয়ার সম্ভব হবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পাসপোর্ট না পায়।

আরও পড়ুন : থাই কিশোরদের উদ্ধারের পর বাবা হারালেন অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক

তিন কিশোর ও কোচের নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে উল্লেখ করে উইল্ড বোর ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা নোপ্পার্যাত খান্থাভং বলেন, তারা পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়ও হতে পারবে না; কারণ তাদের জাতীয়তা নেই। তবে ছেলেদের এই প্রচেষ্টা থাই নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থাইল্যান্ডের পর্নপেন খংকাচোনকিয়েত বলেন, গুহার ভেতরে কিশোরদের আটকা থাকার ঘটনায় রাষ্ট্রহীন মানুষদের নাগরিকত্ব দিয়ে থাইল্যান্ডের ঘুম ভাঙা উচিত।

জাতিগত তাই লু সম্প্রদায়ের সদস্য কোচ একাপ্পল একজন নতুন সন্ন্যাসী। মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই তিনি ধ্যান করে আসছেন। কয়েক বছর অাগে মায়ে সাই এলাকায় তার দাদির দেখাশোনা করার জন্য বৌদ্ধ পাদরীর পদ ছেড়ে পুরোদস্তুর সন্ন্যাসী হয়ে উঠেন। পরে উইল্ড বোর ফুটবল দলের কোচ হিসেবে নাম লেখান তিনি।

আরও পড়ুন : থাই নেভি সিলের প্রশ্ন : এটা কী অলৌকিক ঘটনা?

মায়ে সাইয়ের আরেক সন্ন্যাসী এক্কাপল চুতিনারো বলেন, ‘ধ্যান, ভ্রমণ এবং বিদেশ ঘুরতে যাওয়াই কোচ একাপ্পলের নেশা। তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই জঙ্গলে যাইতাম। একাপ্পল সবসময় মরিচের ভর্তা ও আঠালো চাল নিয়ে আসতেন। আমরা সেখানে বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে দিতাম।’

একজন কোচ হিসেবে উদ্যমী ও ধৈর্যশীল শিক্ষকের মতো কম দক্ষতাসম্পন্ন শিশুদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন তিনি। কিন্তু যার কোনো নাগরিকত্বই নেই তার কোচিংয়ের পুরো গুনাগুণ অর্জনের জন্য এখনো অনেক বাকি আছে। উইল্ড বোরের প্রতিষ্ঠাতা নোপ্পার্যাত খান্থাভং বলেন, ‘তিনি রাষ্ট্রহীন। জাতীয়তা নেই। দেশ নেই।’

এসআইএস/এমএস