মতামত

চিকিৎসা : সেবা না বাণিজ্য?

মোহাম্মদ রাহীম উদ্দিন

Advertisement

স্কুলে “আমার জীবনের লক্ষ্য” রচনা লিখতে গিয়ে আমরা সবাই কিছু মহান পেশার কথা সদম্ভে লিখতাম। চিকিৎসক পেশা নিয়ে টানা-টানি শুরু হয়ে যেত। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী ডাক্তার হতে চাইতো। কেউ কেউ হয়তো লিখতো সে কৃষক হতে চায়।

এ দুটো পেশা বেছে নেওয়ার আধিক্য কেন তা আবাল-বৃদ্ধ বণিতা সবাই জানে। ডাক্তারী পেশা স্বর্গীয় পেশা। এই পেশায় খুব কাছ থেকে মানুষের সেবা করা যায়। তাই আমরা গর্ব করে “আমার জীবনের লক্ষ্য” রচনা লিখতে গিয়ে প্রথমত ডাক্তার হতে চাইতাম।

রচনায় আমরা লিখতাম ‘আমি বড় হয়ে একজন ডাক্তার হয়ে গ্রামে গিয়ে গ্রামের দরিদ্রদের বিনামূল্যে সেবা করতে চাই’। কিন্তু বর্তমানে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এখন বোধহয় আর কেউ ডাক্তারদের প্রতি সমান ভক্তি রাখতে পারেছেন না। কারণ এই মহান পেশায়ও আজ ঢুকে পড়েছে অপরাজনীতি।

Advertisement

ডাক্তাররা লেবাস ধরেছেন পেশধারী বাণিজ্যিকীকরণের। তাদের অবহেলায় সৃষ্ট অনাকাঙ্খিত ঘটনায় তারাই এখন ধর্মঘটের মতো অযৌক্তিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। এটা প্রমাণিত যে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় শিশু রাইফার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভুল চিকিৎসা কেন ডাক্তাররা করবেন। কেন তারা দায়িত্বে অবহেলা করবেন! তারাতো ভুল বিদ্যায় শিক্ষা পাননি।

জনগণ নিজের পকেটের টাকায় উচ্চ মূল্যে ডাক্তারদের (অপ) সেবা কিনে নিচ্ছেন। যে কজন চিকিৎসক দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তারাতো বিশেষজ্ঞ নামে পরিচিত এবং বর্তমানে প্রচলিত চিকিৎসা নামক ব্যবসার বড় বণিক।

তাছাড়া অভিযুক্ত ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বলছেন চিকিৎসক বিধান রায় তাদের নিবন্ধিত চিকিৎসক নন। তাহলে জনে জনে কিভাবে তিনি অভিযুক্ত ক্লিনিকের দ্বিতীয় তলায় নিজস্ব চেম্বার নিয়ে বিশেষজ্ঞ নামে রোগী দেখার ব্যবসা করে যাচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক তার সন্তান হারিয়েছেন অপচিকিৎসায়। মিডিয়াসহ সকল সামাজিক মাধ্যম তোলপাড়। অভিযুক্ত ক্লিনিকসহ সমস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে এখন রোষ চরমে।

এর আগে যে কতো অসহায় মানুষ তাদের আপনজন ও সম্পদ হারিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ক্লিনিকটির নিবন্ধন নিয়ে ঝামেলা রয়েছে। বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে আমাদের অজানা আরো কতো প্রতিষ্ঠান এভাবে বাণিজ্য করে যাচ্ছে অগোচরে।

Advertisement

নানারকম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার দায়ে র‌্যাব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অভিযুক্ত ক্লিনিকসহ চট্টগ্রামের মোট দুই ক্লিনিককে ১৪ লক্ষ্য টাকা জরিমানা করেছে। যা তাদের ইতিপূর্বেকার সেবা নামক পণ্যের বিনিময়ে সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে হাতিয়ে নেওয়া লভ্যাংশের তুলনায় খুবই সামান্য।

চিকিৎসা এখন আর সেবা নয়, রূপ নিয়েছে ব্যবসায়। চিকিৎসক হওয়া মানে কাড়িকাড়ি টাকা আর পার্সেন্টেজ। ঘরে বসেই বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া যায় সুবিধাদী। ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে টয়লেট টিস্যু থেকে শুরু করে ঘরের দেওয়ালের ফটো ফ্রেম, এমনকি বউয়ের পরণের শাড়ি পর্যন্ত পাওয়া যায়।

গ্রামে গিয়ে ছোটবেলার নিষ্পাপ লক্ষ্য ডাক্তার হতে চাওয়ার ব্রত এখন শহরমুখী হয়ে গেছে বড়লোক হওয়ার লোভে। সবাই লবিং করে গ্রাম থেকে শহরে এসে চিকিৎসক না হয়ে বণিক হয়ে যাচ্ছে। উপজেলা হাসপাতাল ও সদর হাসপাতালগুলোতো ডাক্তারের সংকট তাই সব সময় দৃশ্যমান। গ্রাম ও উপশহর থেকে মানুষ দলে দলে অর্থ খরচ করে ছুটে আসছে শহরের চিকিৎসা কারখানাগুলোতে।

রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের অবৈধ ও প্রশ্নবিদ্ধ শত শত বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বার বার ঘোষণা দিয়েও দেশব্যাপী কার্যকর অভিযান অব্যাহত রাখতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

র‌্যাব সদস্যের অভিযান প্রশংসিত হলেও তাদের পক্ষে ঘন ঘন অভিযান চালানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ফলে দেশজুড়ে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি। এদের অধিকাংশেরই নেই কোন সরকারি অনুমোদন। কেউ কেউ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে সাজিয়ে বসেছেন হাসপাতালের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক।

এমন ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানির শিকার হয়ে আসছেন রোগীরা। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই, হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে।

রোগী তার পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। যেহেতু ওই সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হলে তবেই চিকিৎসা। পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছেমাফিক টাকা-পয়সা আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। নিয়ম আছে রেট চার্ট স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ার মতো স্থানে লাগিয়ে রাখার।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও দেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা জানিয়েছেন।

রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। এসব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির ডাক্তারের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর।

এসব প্রতিষ্ঠানের সামনে সুপরিচিত ডাক্তার বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ তালিকাযুক্ত বিরাট মাপের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হলেও প্রয়োজন মতো গিয়ে তাদের কাউকে পাওয়া যায় না। জানা যায়, রোগী আকর্ষণের জন্যই শুধু বিশেষজ্ঞদের নাম সাইনবোর্ডে লেখা হয় এবং নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেয়া হয় তাদের।

এই চিকিৎসা-বেনিয়ারা যাচ্ছেতাই করবে, ভুল চিকিৎসা দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলবে, মৃত মানুষকে দিনের পর দিন আইসিইউতে রেখে টাকা আদায় করবে, হার্টে ব্লক না থাকলেও রিং পরিয়ে টাকা আদায় করবে, সিজারের প্রয়োজন না হলেও সিজার করিয়ে ছাড়বে, মন যা চায় তাই করবে, কিন্তু তাদেরকে কিচ্ছুটি বলা যাবে না। এসব অবৈধ ক্লিনিক, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনসাধারণকেও সোচ্চার হতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২৯ জুন রাতে ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আড়াই বছর বয়সী শিশু রাইফার মৃত্যু হয়। রাইফার পরিবার অভিযোগ করে, ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় রাইফার মৃত্যু হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে পহেলা জুলাই রোববার রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি তদন্ত দল হাসপাতালটি পরিদর্শন করে। এসময় নানা অনিয়মের খোঁজ পায় তদন্ত কমিটি। পরে ১১টি অনিয়মের কথা উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নোটিশ পাঠায়।

এরমধ্যে ৮ জুলাই সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, ওষুধ প্রশাসনের চট্টগ্রামের পরিচালকের উপস্থিতিতে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত হাসপাতালটিতে অভিযান পরিচালনা করে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নামে হয়রানির অভিযোগে চট্টগ্রামের সব প্রাইভেট ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ‘বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতি’।

গত রোববার ৮ জুলাই ২০১৮ এ ধর্মঘট শুরু হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ২০ ঘন্টা কর্মবিরতি ও ধর্মঘট পালন শেষে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে সংগঠনটি। এতে চরম ভোগান্তিতিতে পড়েছেন রোগীরা। চিকিৎসকদের কর্মসূচির কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছিলেন রোগী ও তাদের স্বজনেরা। রোগীদের জিম্মি করে ক্লিনিক-হাসপাতাল মালিকদের এই ধর্মঘট নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রোগী ও স্বজনরা।

হাসপাতালগুলোতে অনিয়ম ছিল বলেই জরিমানা করা হয়েছিল। এটা আইন অনুযায়ীই হয়েছে। আর আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। প্রতিষ্ঠানের মালিক ও চিকিৎসকেরা আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে না দিয়ে যদি জনগণকে জিম্মি করেন, তাহলে সেটা হবে অন্যায়।

লেখক : কলামিস্ট। mrahim04@hotmail.com

এইচআর/জেআইএম