‘পোষা পাখি উড়ে যাবে স্বজনী/একদিন ভাবিনি মনে’ কবিয়াল বিজয় সরকার দেহতত্ত্বের ভাবনায় প্রাণপাখি চলে যাওয়ার এই ভাববিচ্ছেদ গানটি রচনা করেছিলেন সম্ভবত ষাটের দশকে। বৈঠকি আসরে রাত্রী শেষে এ গানে চোখের জলে ভাসেন ভজনপ্রিয় ভক্তরা।
Advertisement
কিন্তু একটি শালিক পাখির জন্য চোখের জল! হারিয়ে যাওয়া পাখিটির সন্ধান দিলেই ১০ হাজার টাকা পুরস্কার! তা ঘোষণা করে পোস্টারিং করা হয়েছে রাজধানীর বেইলিরোড, কাকরাইল, শান্তিনগরের গলিতে গলিতে। পোস্টারে পোস্টারে পাখিটির প্রাণহীন ছবি শোভা পাচ্ছে ঠিক, কিন্তু সপ্তাহ গড়ালেও সন্ধান মেলেনি তার।
পাখির পালনকর্তা সুফিয়া বেগমের চোখে ঘুম নেই, খাওয়া নেই দিনে রাতে। দিবানিশি অঝোরে কাঁদছেন অবুঝ পাখির জন্য। তিন বছর বুকে আগলে রেখে যার সঙ্গে প্রাণপাখির মিতালি, সে পাখি এভাবে ফাঁকি দেবে, তা ভাবতেও পারেননি সুফিয়া।
বলছিলেন, ‘আমার পাঁজর জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ বুঝলেই আন্নিকার (শালিকের নাম) ডাক শুনতে পাই। চোখ মেললে আর দেখতে পাই না। আমার শূন্য খাঁচা পড়ে আছে। জানালায় তাকিয়ে থেকেই দিন কেটে যাচ্ছে এখন।’
Advertisement
যেন বাউল সাধক মাতাল কবি রাজ্জাক দেওয়ানের লেখা ‘বনের কোকিলরে, কৃষ্ণশূন্য দেশে কেনে গাও’ গানটির অর্থকথা সুফিয়া বেগমের কান্নায়। এত প্রেম, এত ভালোবাসা, তবুও চলে গেলো!
ঘটনা তিন বছর আগের। ভোলা শহরে টোকাই শিশুদের কাছ থেকে শালিকের ছানাটি একশ টাকা দিয়ে নিয়েছিলেন সুফিয়া। স্বামী ও একমাত্র ছেলে আসিফ তখন দেশের বাইরে। ভোলার বাড়িতেই কয়েক সপ্তাহ পোষেণ শালিক ছানাটি। নরম কাপড়ে শুইয়ে আর দুধ-ভাত খাইয়ে বড় করতে থাকেন। পালক গজানোর পর ঢাকার বেইলিরোডের বাড়িতে নিয়ে আসেন। ততক্ষণে পোষ মানে শালিকটি। নাম দেয়া হয় আন্নিকা। এই নামে পরিচিত বহুতল ভবনটির অন্যদের কাছেও।
ছেলে আসিফ ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে দু’বছর আগে দেশে ফেরে। শালিক আন্নিকার সঙ্গে তারও ভাব জমে। এর আগে একবার উড়ে গিয়েছিল আন্নিকা। ভবনের ১৩তলা থেকে উদ্ধার করে আনেন আসিফ। তীব্র ভালোবাসায় মনের ভাষাও বুঝত শালিকটি। গোসল, খাওয়া সবকিছু ইশারাতেই করত।
‘খানিক শেখানো কথাও বলত শালিকটি। জিজ্ঞেস করতেই নিজের নাম বলে দিত পারত আন্নিকা’,- বলছিলেন সুফিয়া বেগম।
Advertisement
সুফিয়া বেগমের ঘরেই ছিল পাখিটির বাস। বেশির ভাগ সময় খাঁচার বাইরেই থাকতো। সুফিয়ার হাতে বা ঘাড়ে বসেই দিন কাটত ওর। খাঁচার বাইরে এলে ঘরের জানালা আটকা থাকত। মূল জানালার সঙ্গে নেটের জানালাও ছিল।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে গত ৪ জুলাই। জানালা কখন খুলেছিলেন, তা মনে রাখতে পারেননি সুফিয়া বেগম। খাঁচা থেকেও বেরিয়ে আসে পাখিটি। এর মধ্যে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সুফিয়া। খেয়াল করেননি বাসার কাজের বুয়াও। ততক্ষণে যা ঘটবার ঘটে যায়। বনের পাখি উড়ে গেছে বনে। যখন টের পান সুফিয়া তখন খোলা খাঁচা আর জানালা মিলেমিশে একাকার। শত ডাকেও আর ঘরে ফেরেনি আন্নিকা। আর সেই থেকে পাগলপ্রায় আন্নিকার জন্য সুফিয়া।
কষ্টকথায় সুফিয়া বলেন, ‘জীবনে আমি এত বড় আঘাত পাইনি। ওকে আমি সন্তানের মতো বড় করেছি। ওর সঙ্গে খেলা করেই আমার দিন কাটত। আমার আন্নিকাকে হারানোর ব্যথা সইতে পারছি না। কখন মা বলে ডাকবে, সে অপেক্ষা আর সইছে না। আমার সমস্ত সুখ চলে গেছে।’
যেন মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের লেখা আরেকটি গানের রূপায়ণ ‘আমার সুখ পাখিটি গেছে মারা, একটি তীরের আঘাত খাইয়া/ আমি আজও কান্দি পাখিটির লাগিয়া।’
ছেলে আসিফ বলেন, ‘মায়ের জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে। সারাক্ষণ কান্না করছেন। একটি পাখির জন্য এত ভালোবাসা, তা জানা ছিল না। ও আমাদের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল। উপায় না পেয়ে শালিকটির ছবি দিয়ে পোস্টারিং করেছি। যদি কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি সন্ধান দেন তাহলে ১০ হাজার টাকা বকশিশ দেব। শালিকটি আর দশটি পাখির মতো না। ওর আচরণে যে কেউ আলাদা করতে পারবেন এবং মনে হচ্ছে কারও না কারও ঘরে আশ্রয় নেবে আন্নিকা।
এএসএস/এআর/জেডএ/এমএস