খেলাধুলা

ফ্রান্স-বেলজিয়াম ‘ইউরো’, আড়ালে লড়াইটা আফ্রিকানদেরও!

এবারের ফুটবল বিশ্বকাপ এখন ‘ইউরো কাপ’। আজ রাত থেকে সেমির যে মহারণ শুরু হবে, তার চার দলই (ফ্রান্স, বেলজিয়া, ইংল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়া) ইউরোপের।

Advertisement

৩২ দলের বিশ্ব আসর একদম শেষে এসে ইউরোপিয়ান কাপে পরিণত হয়েছে। শুধু চার সেমিফাইনালিস্টই নয়, গ্রুপ পর্ব ও রাউন্ড অফ সিক্সটিন শেষে কোয়ার্টার ফাইনালেও যে ছিল ইউরোপের একচ্ছত্র আধিপত্য, প্রভাব-কর্তৃত্ব। ব্রাজিল ছাড়া সেরা আটের লড়ইয়ে অংশ নেয়া সাতটিই ছিল ইউরোপীয়।

তারও আগে মানে গ্রপ পর্ব শেষে দ্বিতীয় রাউন্ডের ১৬ দলের ভিতরেও ছিল ইউরোপীয়দের প্রধান্য। যেখানে একমাত্র এশিয়ার প্রতিনিধি ছিল জাপান। আর ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে ও কলম্বিয়া খেললো লাতিন আমেরিকার হয়ে। উত্তর আমেরিকার একমাত্র দল হিসেবে খেলেছে মেক্সিকো ।

এছাড়া অন্য ১০ দলই (ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, সুইডেন, রাশিয়া, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, স্পেন, সুইজারল্যান্ড) ছিল ইউরোপের। মোটকথা, আট গ্রুপের প্রথম পর্ব শেষেই বিশ্বকাপে ইউরোপের প্রাধান্য ছিল পরিষ্কার। আর একদম শেষ দিকে এসে পুরোপুরি ‘ইউরো কাপ’ হয়ে গেছে। যে দুই দলই খেলুক না কেন, ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল হবে ইউরোপেরই দুই দলের মধ্যে।

Advertisement

অর্থাৎ, এবারো ফুটবলের বিশ্ব সেরার মুকুট পড়বে ইউরোপের কোন দল। বলার অপেক্ষা রাখে না ২০১৪ সালে হওয়া বিশ্বকাপের শেষ আসরের বিজয়ী দল জার্মানীও ইউরোপের। শুধু আগেরবার কেন , ২০০২ সালে এশিয়ার মাটিতে জাপান-কোরিয়ার যৌথ আয়োজনে হওয়া বিশ্বকাপের ১৮ নম্বর আসরের পর সর্বশেষ তিন বিশ্বকাপ বিজয়ীই ইউরোপের (২০০৬ সালে ইতালি, ২০১০ স্পেন ও ২০১৪ জার্মানী)।

ইতিহাস ও পরিসংখ্যান পরিষ্কার জানান দিচ্ছে ধীরে ধীরে দক্ষিন আমেরিকার আধিপত্য প্রায় শেষ। উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের চিরায়ত ছন্দময়, নান্দনিক, ধ্রুপদী ও শৈল্পিক ফুটবলের বদলে দিনকে দিন ইউরোপের কৌশল, ছক ও গতিময় কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ফুটবলই সবচেয়ে বেশি কার্যকর।

এই কৌশল ও ছকে ইউরোপ যতটাই এগিয়েছে আনুপাতিকহারে ঠিক ততটাই পিছিয়েছে আফ্রিকান দলগুলো। ‘সুপার ঈগল’ খ্যাত নাইযেরিয়া, ‘অদম্য সিংহ’ ক্যামেরুন (এবার মুল পর্বেই আসতে পারেনি), মিশর, মরক্কো, ঘানা ও সেনেগাল দিনকে দিন পিছিয়ে পড়েছে।

তার বদলে বরং সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জায়গা এশিয়ার উন্নতি ঘটেছে। এবার মুল পর্ব খেলতে আসা চার এশিয়ান দেশ জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, সৌদি আরব ও ইরান (ফুটবলীয় অঞ্চলে থাকলে আসলে অস্ট্রেলিয়া এশিয়া মহাদেশের বাইরে, তাই বিবেচনায় আনা হয়নি) এবার তুলনামুলক ভাল খেলেছে। বরং শক্ত, সুগঠিত শারীরিক কাঠামোর আফ্রিকানরাই তুলনামূলক পিছিয়ে পড়েছে। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে এবার ছিল না কোন আফ্রিকার দল।

Advertisement

খালি চোখে আফ্রিকা এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে ব্যর্থ মহাদেশ। অথচ নাইজেরিয়ার ‘রশিদি ইয়কিনি’ আর ক্যামেরুনের ‘রজার মিলার’ নাম সারা বিশ্ব জানতো। গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নব্বই দশকের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তাদের নাম শোনা যেত। নব্বই দশকের প্রজন্মর অনেক উৎসাহী কিশোর-তরুণের আদর্শ ফুটবলারের তালিকায় নাইজেরিয়ান রশিদি ইয়াকিনি আর ক্যামেরুনের রজার মিলার নাম থাকতো। অথচ এখন আর কোন কিশোর-তরুণ যুবার মুখে সেভাবে আফ্রিকান ফুটবলারদের নাম শোনা যায় না।

মোটকথা, যতই সময় গড়াচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্র থেকে আফ্রিকা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। লাতিন আমেরিকার ছন্দ, লয়, নান্দনিকতা, পায়ের সুক্ষ কারুকাজ, ব্যক্তিগত মেধা, মুন্সিয়ানা ও নৈপুণ্য রপ্ত করা সম্ভব হয়নি। ইউরোপের গতি, কৌশল, নানা আধুনিক ও কার্যকর ছক এবং মোক্ষম কাউন্টার এটাক নির্ভর কার্যকর ফুটবল শৈলির অনুকরণ করতে পারেনি আফ্রিকানরা। এখনো সেই শরীর নির্ভর ফুটবল খেলে আগানোর চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

তাই এক সময়ের আলোচিত, আলোড়িত ও সম্ভাবনাময়ের তকমাধারী আফ্রিকান ফুটবলাররা কালের বিবর্তনে অনেকটাই অনুজ্জ্বল। খালি চোখে তেমনি মনে হবে। আসলেই কি তাই?

একটু খুঁটিয়ে দেখলে কিন্তু আর তা মনে হবে না। বরং দেখবেন, জানবেন বিশ্ব ফুটবলে আফ্রিকানরা দিনকে দিন পিছিয়ে পড়ছে কথাটি মোটেই সত্য নয়। খালি চোখে রাউন্ড অফ সিক্সটিন আর সেরা আটে ছিল না আফ্রিকার কোন দল। কিন্তু শুনে অবাক হবেন, আজ ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের যে ধুন্ধুমার সেমির লড়াই হবে, তাতে রয়েছেন আফ্রিকানরা।

কি চমকে উঠছেন! বিস্ময় জাগছে? ভাবছেন ফরাসী ও বেলজিকদের সেমির যুদ্ধে আবার আফ্রিকানরা থাকে কি করে? তাহলে শুনুন, জানুন, আজ গভীর রাতে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের সেমিফাইনালে দু’দলের জার্সি গায়ে যারা মাঠে নামবেন, তাদের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। কারো পিতা আফ্রিকান। কারো মাতা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। আবার কেউবা জন্মসূত্রেই আফ্রিকান। বেড়ে ওঠা এবং ফুটবলে হাতেখড়িও আফ্রিকায়।

ফ্রান্স ও বেলজিয়াম স্কোয়াডে আফ্রিকানদের ছড়াছড়ির খবর। দু’দলের ৫০ ভাগ ফুটবলারই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে যে ২৩ জন করে ৪৬ ফুটবলার আছেন, তার ২৩ জনই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। এর ভেতর বেলজিয়াম প্রথম একাদশের ছয়জন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য পারফরমারই আফ্রিকান।

দলটির আক্রমন ভাগের প্রাণভোমরা ও মূল প্রাণশক্তি রোমেলু লুকাকু আর মাঝমাঠের অতন্দ্র প্রহরী ম্যারুয়েন ফেলাইনি হলেন মরক্কোন বংশোদ্ভূত। এছাড়া আদনান ইয়ানুজাই (কসোবো ও আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত), ভিনসেন্ট কোস্পানি ( বাবা কঙ্গো, মা বেলজিক), মুসা ডেম্বেলে (বাবা মালিয়ান), নাসের চাদলি (মরক্কোন বংশোদ্ভূত)।

অন্যদিকে ফরাসী শিবিরেও আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের ছড়াছড়ি। ফরাসীদের এক নম্বর তারকা ও আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু কিলিয়ান এমবাপে শতভাগ আফ্রিকান। পিতা ক্যামেরুনের, মা আলজেরিয়ার। এর বাইরে দু’দলে আরও বেশ ক’জন অতি উঁচু মানের মেধাবি ও কুশলী ফুটবলার আছেন।

ফ্রান্সের অন্যতম ডিফেন্ডার, যার রক্ষন দৃঢ়তা দলটির অন্যতম নির্ভরতার প্রতীক সেই স্যামুয়েল উমতিতির জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই আফ্রিকার ক্যামেরুনে। পিতা ও মাতা দুজনই ক্যামেরুনের। বর্তমানে বার্সেলোনার হয়ে খেলা উমতিতি ক্যামেরুন অনূর্ধ-১৭ ও ২১ দলের হয়েও খেলেছেন।

এছাড়া ফ্রান্সের অন্যতম শীর্ষ তারকা পল পগবাও পিতৃ ও মাতৃ পরিচয় ধরলে গিনির বংশোদ্ভুত। যদিও পল পগবার জন্ম ফ্রান্সে। তবে বাবা ও মা দুজনই গিনিয়ান। তাই পগবাও গিনি বংশোদ্ভূত। এছাড়া ফরাসী মিডফিল্ড জেনারেল ব্লেইস মাতুইদির বাবাও অ্যাঙ্গোলান বংশোদ্ভূত। তবে মা ফরাসী। এছাড়া অ্যাঙ্গোলো কান্তে- মালি বংশোদ্ভূত।

ওপরে যাদের নাম বলা হলো, এরাই যে সব; তা নয়। তাদের বাইরে দু’দলে আরও বেশ কয়েকজন অতি উঁচু মানের মেধাবী ও কুশলী ফুটবলার আছেন যারা ভাগ্য গড়ে দিতে পারেন।

তবে ফরাসী ও বেলজিক শিবিরে যে কয়েকজন আফ্রিকান আছেন, তাদের কিন্তু বিবেচনায় রাখতেই হবে। দু’দলের সাফল্য তথা সম্ভাবনা নির্ভর করছে আসলে আফ্রিকানদের ওপর। কাজেই ফ্রান্স-বেলজিয়াম খালি চোখে ইউরো, কিন্তু আসলে আফ্রিকানদের লড়াই। দেখা যাক এ লড়াইয়ে জয় কাদের হয়।

এআরবি/আরআর/এমএস