খেলাধুলা

ঘরের ছেলে অঁরিই এখন ফ্রান্সের শত্রু

২০ বছর আগে প্যারিসের পার্ক ডি প্রিন্সেসে যখন জিদান-দেশম-লরা ব্লাঁ’রা বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিটা উঁচু করে তুলে ধরেছিলেন, থিয়ের অঁরির বয়স তখ মাত্র ২০। ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। যদিও ওই বিশ্বকাপের ফাইনালে জ্যাকেট আইমের একাদশে সুযোগ হয়নি সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণ ফুটবলারটির। সাইড বেঞ্চে বসে দেখেছেন পূর্বসূরীরা কিভাবে সেবার রোনালদো-দুঙ্গা-রিভালদো-বেবেতোদের দলকে হারিয়েছিল।

Advertisement

আট বছর পর সেই থিয়েরি অঁরি জুটি বেধেছিলেন জিনেদিন জিদানের সঙ্গে। এবার অঁরি পূর্ণাঙ্গন একজন ফুটবলার। যার পায়ের কারুকাজে ফুল ফোটে সবুজ ঘাসে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনালের হয়ে একের পর এক গোলের বন্যা বইয়ে দেন তিনি। সেই অঁরি ২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপে দলকে তুলে নিয়ে এলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে।

কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে জয়সূচক একমাত্র গোলটিই করেছিলেন থিয়েরি অঁরি। ফাইনালে ইতালিকে হারিয়ে জিদান-অঁরির হাত ধরেই ফরাসিরা ভেবেছিল দ্বিতীয় শিরোপা ঘরে তুলবে; কিন্তু ফাইনালে টাইব্রেকারে শট নেয়ার সুযোগ পাননি অঁরি। তার আগেই তাকে মাঠ থেকে তুলে নিয়েছিলেন কোচ রেমন্ড ডমেনেখ। কারণ, পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলেন তিনি। ফ্রান্সও হেরে যায় ইতালির কাছে।

১০ বছর পর আবারও শিরোপা জয়ের হাতছানি অঁরির সামনে। তবে এবার আর খেলোয়াড় হিসেবে নয়, কোচ হিসেবে। এমনকি প্রধান কোনো কোচ হিসেবেও নয়, সহকারী কোচ হিসেবে। আর মাত্র দুটি বাধা পার হতে পারলেই দুই দশক পর আরও একবার বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটায় চুমু খেতে পারবেন ফ্রান্সের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারটি। তিনি যে এখন বেলজিয়ামের সহকারী কোচ! সামনেই সেমিফাইনাল, এরপর ফাইনাল- স্বপ্ন ছোঁয়ার দুরত্ব তো মাত্র আর দুটি ধাপ!

Advertisement

কিন্তু সেই অধরা লক্ষ্য পূরণের আগে যে মধুর এক সমস্যায় পড়ে গেলেন অঁরি! কি করবেন এবার তিনি? কুল রাখি না শ্যাম রাখি- অবস্থা হয়ে দাঁড়ালো ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ বিজয়ী তারকার। রাশিয়া বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে তুলে নেয়ার ঠিক আগের ম্যাচে যে নিজ দেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হচ্ছে তাকে!

যে দেশটিকে বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছেন, যে দেশের হয়ে খেলেছেন আরও একটি বিশ্বকাপের ফাইনাল, সে নিজ দেশের বিপক্ষেই কি না রণপরিকল্পনা সাজাতে হচ্ছে থিয়েরি অঁরিকে। নিঃসন্দেহে বেলজিয়ামের এতদুর উঠে আসার পেছনে অন্যতম অবদান নেপথ্যে থাকা এই সহকারী কোচের। রবার্তো মার্টিনেজ হয়তো বেলজিয়ামের প্রধান কোচ। তার ট্যাকটিক্সের ওপর ভিত্তি করেই সাফল্যের গৌরবগাঁথা রচনা করছে বেলজিয়ানরা; কিন্তু নেপথ্যে থাকা অঁরির অবদান তো কোনো অংশেই কম নয়।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তারকা রোমেলু লুকাকু যে বিশ্বকাপের মঞ্চে এসে নিজেকে এত সুন্দর করে মেলে ধরেছেন, তার পেছনের কারিগর কিন্তু অঁরি। কিংবা ইডেন হ্যাজার্ড যে নীরবে-নিবৃতে বেলজিয়ামের সাফল্যের সৌধ নির্মাণ করে চলেছেন, তার নেপথ্যের নায়ক কিন্তু অঁরিই। তিনি ছোট ছোট কিছু পরিকল্পনা সাজিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিপক্ষের দুর্বোধ্য দেয়ালের ছিদ্র বের করে সেটাকেই কাজে লাগানোর কৌশল শেখাচ্ছেন।

ব্রাজিলের বিপক্ষে যেমন তিতের শীশাঢালা প্রাচীরের মত রক্ষণ দেয়ালের কিভাবে ফাঁক বের করতে হয়, সেটা নির্ধারণ করেছিলেন অঁরি। ক্যাসেমিরো, দানিলোর অবর্তমানে কিভাবে ডানপ্রান্তে প্রেসিং ফুটবল খেলে রক্ষণকে দুর্বল করে তোলা যায়, ফ্যাগনার, মার্সেলো কিংবা মিরান্দাকে অন্যদিকে ব্যস্ত রেখে কিভাবে থিয়াগো সিলভাকে একা করে ফেলা যায়, তার কৌশল নির্ধারণ করেছিলেন অঁরিই।

Advertisement

যার বদৌলতে বেলজিয়ামের দ্বিতীয় গোলটি পেয়েছিলেন কেভিন ডি ব্রুয়েনের। পাল্টা আক্রমণে প্রচণ্ড গতিতে ডান পাশ ধরে বল নিয়ে যান লুকাকু। তাকে থামানোর মত তখন কেউ ছিল না। মার্সেলো ছিলেন মিডফিল্ডে। সিলভা একা। মিরান্দা কিংবা ফ্যাগনাররা লুকাকুর গতির সঙ্গে পেরে উঠলেন না। যে কারণে ডি ব্রুয়েন বল পেয়েই অসাধারণ শটে গোলটা বের করে নিতে পেরেছিলেন।

ফ্রান্সের বিপক্ষে তেমনই কৌশল নির্ধারণ করতে হচ্ছে অঁরিকে। নিজ দেশকে কিভাবে হারাতে হবে, কিভাবে ভিন্ন একটি দেশের হাতে তুলে দিতে হবে বিশ্বকাপ শিরোপা, সে পরিকল্পনাই এখন করতে হচ্ছে সাবেক এই ফরাসি তারকাকে। ফ্রান্সের এই দলটিকে তিনি খুব ভালোকরেই চেনেন, জানেন। নিজ দেশের ফুটবলারদের খুব কাছ থেকে দেখার-জানার সৌভাগ্য হয়েছে অঁরির। সুতরাং, তাদের দুর্বলতা বের করা কোনো ব্যাপারই না অঁরির জন্য।

বিশ্বকাপে এবার পেকারম্যান, মার্টিনেজ, অসোরিওর মতো অনেক কোচ ছিলেন, যাঁরা অন্য দেশের কোচিং করাতে এসেছেন। কিন্তু অরির মতো কাউকেই এমন মধুর বিপদে পড়তে হয়নি। তার মতো নিজের দেশের বিরুদ্ধে অঙ্ক কষতে হয়নি কাউকেই। অঁরির মতো বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নিজের দেশের সব জয়ের ফর্মুলা তুলে দিতে হয়নি শক্রুর হাতে।

ফ্রান্সের সবচেয়ে নামী দৈনিক লেকিপ পত্রিকায় ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামকে বলা হচ্ছে দিদিয়ের দেশম বনাম থিয়েরি অঁরির লড়াই। সেখানে বলাই হচ্ছে না যে, অঁরির ‘বস’ রবার্তো মার্টিনেজ। বরং উঠে আসছে ইডেন হ্যাজার্ডের ‘ফ্রান্স কানেকশন’। তিনি ছোটোবেলায় বেলজিয়াম সীমান্তের ফরাসি শহরে ভাইয়ের সঙ্গে ট্রেনিং করতে যেতেন। তার বাবার নাম থিয়েরি। প্রিয় ফুটবলার জিদান।

বাবার নাম থিয়েরি হলেও এখন বেলজিয়াম দলে হ্যাজার্ডের বাবার চেয়েও বড় ভুমিকায় অঁরি। যার অন্য নাম ‘কিং অঁরি’। নামটা আর্সেনালে সোনার সময়ে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের দেওয়া। কিন্তু এই কিং’ই যে ধরনের বিপদে পড়েছেন, শেষ কোন বিশ্বকাপে এত বড় তারকা এমন ভয়ঙ্কর সমস্যায় পড়েছেন কি না জানা নেই।। এক দিকে মাতৃভূমির টান। অন্য দিকে পেশার।

বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে তিন জন ‘কিং’কে দেখা যাচ্ছে। ইংল্যান্ডের ‘কিং হ্যারি’ দু’জন। হ্যারি কেন এবং হ্যারি ম্যাগুইর। ফ্রান্সের ‘কিং হেনরি’। রাশিয়ায় এসে কিং হেনরির মতো বিপদে পড়েননি কেউ।

জিদানের পর ফ্রান্সের বাইরে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ফরাসি ফুটবলারকে নিয়ে টিপ্পনি শুরু হয়ে গেছে ফ্রান্স শিবিরেও। রোববারই অঁরিকে লক্ষ্য করে ফ্রান্সের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড অলিভিয়ের জিরুর মন্তব্য, ‘আমি খুব গর্বিত হব, যদি তিতিকে দেখাতে পারি, তুমি ভুল জায়গায় গিয়েছো।’

অঁরিকে ফরাসি ফুটবল মহল ডাকে ‘তিতি’ নামে। কাইলিয়ান এমবাপেকে ধরেছিল এক টিভি। তার কথাতেও এক সুর, ‘থিয়েরি আমার স্বপ্নের নায়ক। উনি আমাকে উদ্দীপ্ত করেন; কিন্তু এখন তিনি আমার প্রতিপক্ষ। তার টিমকে হারানোর জন্য যা খুশি করব।’

রাশিয়ায় এখন যে কোনও ফরাসি ফুটবলারকে সামনে পেলেই একটা প্রশ্ন যেন বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে, ‘প্রতিপক্ষে দলের বেঞ্চে থাকবেন অঁরি। আপনি কী ভাবছেন?’ একেবারে রুটিন প্রশ্ন। এ কারণেই জিরুর মন্তব্য, ‘আমি ব্যাপারটা মানতেই পারছি না। ওর তো আমাদের দিকে থাকা উচিত ছিল। আমাদেরই পরামর্শ দেওয়া উচিত ছিল। তবে ওর পরামর্শ যারা পাচ্ছে, তাদের জন্য আমার কোনও ঈর্ষা হচ্ছে না।’

লেফটব্যাক লুকাস ফার্নান্দেস উরুগুয়েকে হারিয়েই বলেছিলেন, ‘ফ্রান্স বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে জিততে পারলে অঁরি খুশিই হবে। কেননা সবার আগে অঁরি একজন ফরাসি।’ তার ব্যাখ্যা, ‘প্রত্যেক ফরাসি খুব ভালো করে জানে, থিয়েরি এক জন গ্রেট প্লেয়ার। আইকনিক প্লেয়ার। আশা করি, ও আমাদের হারাতে পারবে না।’

অঁরি, ফ্রান্সের সর্বকালের সেরা স্কোরার। অথচ তিনিই কি না নিজ দেশের বিপক্ষে অন্য আরেকটি দেশকে জেতাতে সাহায্য করবেন। কেন? বেলজিয়াম কোচ রবার্তো মার্টিনেজ তাকে এনেছিলেন দুটো কারণে। এক, ফরোয়ার্ডদের গোল চেনাবেন। দুই, নিজের জেতার অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন। দু’দিন আগে মার্তিনেসকে বলতে শোনা গেছে, লুকাকুর সাম্প্রতিক সাফল্যের পিছনে অঁরির হাত। ‘রোম (রোমেরু) এমনিতেই ভালো ফুটবলার। অঁরির হাতে পড়ে ও আরও উন্নতি করেছে।’

বেলজিয়াম বনাম ফ্রান্স ম্যাচ হলে কী হবে? এই প্রশ্নটা বিশ্বকাপের আগে করা হয়েছিল অঁরিকে। তার একটা বাঁধা উত্তর দিয়েছিলেন তিনি, ‘উই উইল ক্রস দ্যাট ব্রিজ, হোয়েন উই রিচ দেয়ার।’ কতবার কত জনকে যে বলেছেন তিনি। অথচ, এখন সেই নির্মম সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে তিতি। এই ম্যাচের পর কি করবেন তিনি! তাকে স্বান্তনা দিতে এগিয়ে আসবেন জিরু নাকি জিরুকে স্বান্তনা দিতে এগিয়ে যাবে অঁরি?

যেমনটা কোয়ার্টার ফাইনালের পর করেছিলেন অঁরি। কান্নায় ভেঙে পড়া নেইমারকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন সেদিন। কাজানে ব্রাজিলের হারের পর বিধ্বস্ত নেইমারের দিকে প্রথমে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন বেলজিয়ামের সহকারী কোচ অঁরি। তার পিছনে ছিলেন ইডেন হ্যাজার্ড। এবার মঞ্চে অঁরির সামনে আগমণ নতুন শত্রুর, যারা তারই ঘরের ছেলে। কি করবেন অঁরি?

আইএইচএস/জেআইএম