গাজীপুরে পরিবেশের কোনো অংশই আজ দূষণমুক্ত নয়। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণ ঘটছে ব্যাপক হারে। বদলে যাচ্ছে জলবায়ু পরিস্থিতি। দূষণের ঝুঁকিতে পড়ে মানুষসহ সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন ধারণে বিঘ্ন ঘটছে। পরিবেশের মাটি, পানি ও বায়ু, মাটির উপরের পানি এমনকি ভূগর্ভস্থ পানি কোনো কিছুই নিরাপদে নেই। যা অবহাওয়ার বিরূপ আচরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
Advertisement
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য, দেখা দিচ্ছে নানা রোগব্যধি। জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও স্বীকার করছেন এ অবস্থার পরিবর্তন করা না গেলে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিস্থিতি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে উঠবে চরম হুমকিস্বরূপ।
প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম উপাদান বনভূমি বেদখল হচ্ছে। উজাড় হচ্ছে বনজসম্পদ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বন কর্মকর্তাদের গোচরেই কলকারখানার মালিক ও প্রভাবশালীরা বিভিন্ন কৌশলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি গ্রাস করছে। এতে সবুজ বেষ্টিত বন ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ভূমি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করে প্রভাবশালীদের হাত থেকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি রক্ষা করতে না পারলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের গাছসহ জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে বলে মনে করছে এখানকার বাসিন্দারা।
এদিকে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গাজীপুরের কালিয়াকৈর, শ্রীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বনের ভেতর অবৈধভাবে একের পর এক করাতকল গড়ে উঠছে। রাতে এসব করাতকলে বন বিভাগের সড়কের পাশেই শত শত গাছ চেরাই করা হচ্ছে। এতে উজাড় হচ্ছে বন, হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য।
Advertisement
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় বন কর্মকর্তা ও পুলিশকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে অবৈধভাবে এসব করাতকল চালানো হচ্ছে। মাঝে মধ্যে বন বিভাগ বনের ভেতরে করাত কলে অভিযান চালালেও বন্ধ হচ্ছে না করাতকলগুলো।
এ ছাড়া সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অবৈধ ইটভাটার কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। টনের পর টন গাছ এসব ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করায় পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ যেমন বাড়ছে তেমনিভাবে কমছে গাছের সংখ্যা। শুষ্ক মওসুমে ইটভাটার ধুলো আর ধোঁয়ায় এলাকার ফসলি জমিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফসলহানি, ফল ও সবজি পচে যাওয়া, কুঁকড়ানোসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। নগর ও জেলার দুই শতাধিক ইটভাটায় আইন অমান্য করে অবাধে কাঠ পোড়ানোয় বাতাসে কার্বনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন।
সামগ্রিকভাবে পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও প্রশাসনের নেই তেমন কার্যকরী উদ্যোগ। আগ্রাসী নদী দখল আর দূষণে নদীর পানিতে মাছ নেই বললেই চলে, নদী রূপ নিচ্ছে মরা খালে।
দখল ও দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে গাজীপুরের বিভিন্ন নদ নদী ও জলাশয়। দখলবাজদের দৌরাত্ম্যে অস্তিত্ব হারাচ্ছে নদী। নদীর পাড়ে ও এলাকায় বিভিন্ন কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। কেমিক্যাল মিশ্রিত কালচে ও নীল রঙের পানিতে ভয়াবহ দুর্গন্ধ থাকায় এ পানি ফসলি জমিতেও ব্যবহার করতে পারছেন না কৃষক। পানিতে দূষণের মাত্রা বেশি থাকায় অক্সিজেনের পরিমাণ নেই বললেই চলে। আর এতে করে এসব নদী ও খালে মাছসহ নানা জলজ প্রাণি হারিয়ে গেছে।
Advertisement
তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শত শত কারখানা। ডায়িং, প্রিন্টিং, নিটিং সিরামিক, ইটভাটাসহ এসব কারখানার অধিকাংশের ইটিপি না থাকায় সরাসরি বর্জ্য মিশছে নদীর পানিতে। এ ছাড়া বাসা বাড়ির মলমূত্র, গৃহস্থালী বর্জ্যও মিশছে নদীর পানিতে। ফলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে ভয়াবহ হারে। বিভিন্ন কলকারখানা এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া ও রাসায়নিক মিশ্রিত শিল্প বর্জ্য, জমিতে ব্যবহৃত কিটনাশক, রাসায়নিক সার, ময়লা-আবর্জনা, পলিথিন, প্লাাস্টিক ইত্যাদি পরিবেশের উপাদানকে দূষিত করছে।
নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে পয়ঃনিষ্কাশন ও শিল্প বর্জ্য অনেক বেড়ে গেছে। খাদ্যের উচ্ছিষ্ট ময়লা আবর্জনা, জীবজন্তুর মৃতদেহ, গৃহস্থালীর ব্যবহার্য নানা ধরনের পচনশীল বস্তু যেখানে সেখানে ফেলা হয়। এগুলো পচে বিভিন্ন রোগের জীবাণুর সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও বৃষ্টির পানির সঙ্গে এগুলো মিশে পুকুর, নদী ও জলাশয়ের পানিতে মিশে যাচ্ছে। ফলে পানিও দূষিত হচ্ছে। এসব বর্জ্য বিভিন্ন জলাশয়ে পড়ছে।
জলাশয় থেকে নদীতে এবং নদী থেকে সাগরে যাচ্ছে। ফলে পানি দূষিত হচ্ছে। এগুলো মাটির নিচের পানির সঙ্গেও মিশে পানিকে দূষিত করছে। পানি দূষিত হলে সেই পানিতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীও বাঁচতে পারে না। ফলে পানির পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। পরিবেশ দূষণ থেকে জেলাবাসীকে রক্ষার বিষয়ে জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, গাজীপুরে নদী দূষণ রক্ষায় একাধিক কমিটি কাজ করছে। দূষণ, দখল রোধ এবং নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে শিল্প কারখানার বর্জ্য ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করছে। এটি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হুমকি।
আমিনুল ইসলাম/এমএএস/জেআইএম