মতামত

দুর্জনের গলার জোর বাড়লে দুষ্কর্মের পরিধি প্রসারিত হয়

হাসপাতালে অকারণ মৃত্যু। কোনটি ‘ভুল’, কোনটি ‘গাফিলতি’, কোনটি ‘স্বাভাবিক’, কোনটি ‘দুর্ভাগ্যজনক’ তা কে স্থির করবে? চিকিৎসকরা বলবেন, এটি ঠিক করার এখতিয়ার শুধুমাত্র তাদের, কারণ তারাই বিদ্যাটি জানেন। কিন্তু  চিকিৎসকরা কি এটা মানবেন যে, কিছুতেই নিজের দোষ স্বীকার না করাও বড় অপরাধ?

Advertisement

চট্টগ্রামে সাংবাদিক কন্যা, শিশু রাইফার মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসক ও ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে। খোদ সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে একথা উল্লেখ করা হয়েছে। অবহেলার দায়ে শিশুর মৃত্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে শিশু বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি পাঁচদিন তদন্তের পর এই তদন্ত প্রতিবেদন দেন।

চিকিৎসক যদি কাজে ভুল করেও না বোঝেন যে তিনি ভুল করলেন, তাকেও কখনো কখনো ক্ষমা করা যায়। কিন্তু যখন দল বেধে চিকিৎসক সমাজ এই ভুল অস্বীকার করতে থাকেন, যখন তারা বলেন অভিযোগ যেহেতু সাংবাদিকরা করেছে, তাই তাদের চিকিৎসা করা হবেনা, তখন বুঝতে হবে এরা আসলে চিকিৎসক নন, কসাইও নন, এরা খুনি।

এমন অপরাধের মোকাবেলা করা বড় কঠিন। তবুও মোকাবেলা করতে হবে।  অন্যায় ঘটলে তা স্বীকার করবার দায় চিকিৎসকের উপরই - কঠোর ভাবে প্রশাসনিক জায়গা থেকে এ কথা প্রতিষ্ঠা করতে  হবে। জেগে উঠুক আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এটা কেবল বাঞ্ছনীয় নয়, কর্তব্য। কারণ এই চিকিৎসক সমাজ কখনো নিজস্ব পরিমন্ডলে নীতি নৈতিকতার ধার ধারবেনা। আজ পর্যন্ত কি একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)? নেয়নি। আর না নেওয়ার কারণেই চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ দিন দিন কসাই থেকে দানব হয়ে উঠছে।

Advertisement

যতক্ষণ না প্রত্যক্ষগ্রাহ্য ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না হচ্ছে, হাসপাতালের চিকিৎসক কিংবা নার্সরা নিজেদের দায়িত্ব সৎ ভাবে পালন করবার তাড়াটি বোধ করবেননা। এর অর্থ এই নয় যে, সব চিকিৎসক বা নার্সই গাফিলতি-পরায়ণ। কিন্তু মুশকিল হল, যারা গাফিলতি করেন, বিনা শাস্তিতে তারা পার পেয়ে যান বলেই সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ ডাক্তারদের ভাগ্যেও দুর্নাম জোটে।

দেশে আইন-কানুনের একটা ফ্রেমওয়ার্ক থাকা প্রয়োজন। যদি কেউ অপচিকিৎসার শিকার হয়, তবে তার যেন প্রতিকার হয়—এর একটা সুসংগঠিত ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই শক্ত ফ্রেমওয়ার্ক নেই বলে সারা দেশে এ ধরনের অরাজকতা চলছেই।

চিকিৎসকরা একটা কথা বলবেন যে, কোনো চিকিৎসকই রোগীকে মারতে চান না। তাই প্রশ্নটা হত্যার নয়, বরং অবহেলা, ভুল এবং অদক্ষতার। পেশা হিসেবে চিকিৎসা অনন্য হলেও চিকিৎসক অনন্য নন, তারাও মানুষ। অন্য পেশার লোকদের মতোই তাদের ভেতরও দক্ষ ও অদক্ষ জনবল আছে। দক্ষ হাতের সেবার সঙ্গে সঙ্গে অবহেলা, ভুল ও অদক্ষতার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু এদেশে এখন অসংখ্য ডাক্তার আছেন, যারা কাজের বাইরে অকাজে, বিশেষ করে রাজনীতির সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেছেন যে, তারা রোগী দেখা থেকে শুরু করে তাদের সব কাজে ভয়ংকরভাবে অবহেলা করছেন, অরাজকতা করছেন, দুর্নীতি করছেন।

চিকিৎকরা রোগীর প্রতিপক্ষ নন। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা রোগীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। চিকিৎসকরা মানতে চাননা যে তারাও ভুল করেন। আর তাই তাদের ভুলের তদন্ত তারাই করতে চান। চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসার ভুল বা গাফিলতির তদন্ত করানো হলে আর যা-ই হোক, ভুক্তভোগীর কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হবেনা। বিএমডিসি-তে যদি সমাজের নানা অংশের যেমন চিকিৎসক, আইনজীবী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিত্ব না থাকে তবে, তার কোন তদন্ত গ্রহণযোগ্য হবেনা।

Advertisement

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি অন্যতম অভিযোগ হল রোগ নির্ণয় কেন্দ্র ও হাসপাতাল-নার্সিংহোমে রোগী পাঠিয়ে তার বিনিময়ে টাকা বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়াকে চিকিৎসকদের একাংশ অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেন। এটা অনৈতিক, ক্ষতিকারক। সাধারণ মানুষের ক্ষতি তো বটেই, চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাও কমছে। এ অবস্থা আকাশ থেকে পড়েনি, চিকিৎসার বাজারের ক্রমপ্রসারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, তার সাংস্কৃতিক ও চরিত্রগত চাহিদা মেটাতে গিয়েই এটা ঘটছে। পণ্য হিসাবে চিকিৎসার চরিত্র পাঁচটা ভোগ্যপণ্যের মতো হতে পারে কী? না পারে না। কারণ চিকিৎসা কেনাবেচার মধ্যে থাকে একটা মানুষের শরীর, মন, জীবনমরণ। উৎকোচ, দালালি ইত্যাদি বিষয়গুলো এই পেশার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। চিকিৎসকরা অনেকেই নিশ্চয়ই এখনও সেটা জানেন, মানেন। সমাজে, যে কোনও ক্ষেত্রে, এমন মানুষেরা আছেন বলেই সমাজ প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে চলে। কিন্তু চিকিৎসকদের একাংশের কাছে এগুলো আর অন্যায় নয়, বরং প্রায় অধিকারে পরিণত হয়েছে। এবং এই অংশটা ক্রমশ বাড়ছে। কেবল সংখ্যায় নয়, দাপটেও। আগে তবু একটু গোপনে চলত, এখন সব একেবারে প্রকাশ্যে এসে গেছে।

আবার যেসব চিকিৎসক নিজেদের বিকিয়ে দেননি, নিজের প্রতি, নিজের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল রয়েছেন তারাও চুপচাপ থাকেন। ফলে দুর্জনের গলার জোর বাড়ে, দুষ্কর্মের পরিধিও প্রসারিত হয়। আর সব পেশার মতো এখানেও যারা দুর্বৃত্ত তারা সাহস পেয়ে ক্রমশ এসে পড়েন বড় রাস্তায়। লোভ আর লাভের পিঠে চড়ে চিকিৎসা সেবার মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়ান। এদের স্বভাব ও চিন্তার অন্ধকার তখন অন্য সব আলোকে গ্রাস করতে থাকে, লোভের বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমাজে। এরাই চোখ রাঙিয়ে বলতে শুরু করেন, তারা যে পথে চলছেন সেটাই সাফল্যের পথ।

এই পথের আকর্ষণ স্বভাবতই বিপুল। অর্থ, স্বাচ্ছন্দ্য, সুযোগ, প্রতিপত্তি, এ-সবের এক আশ্চর্য মাদকতা থাকে। পেশাগত পরিসরে এই ধরনের মাদকপ্রবাহ যখন তীব্রতা পায়, তখন তা ন্যায়-অন্যায়ের বেড়াজাল ভেঙে দেয়। চিকিৎসা পেশায় যুক্ত কিছু মানুষ এই অন্যায়কে ন্যায্য ব্যবসা বলছেন, সেটা বড় কথা নয়, সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, তারা সেটাকেই সমস্ত পেশার স্বাভাবিক ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, প্রভাবিত করতে চান বৃহত্তর পরিমণ্ডলকে।গাফিলতির এই অপ্রতিহত অভ্যাস কী ভাবে গোড়াতেই আটকানো সম্ভব, সে বিষয়ে পদক্ষেপের কথা সরকার ভেবে দেখতে পারে। মানুষ মাত্রেই ভুল হয়, এই আপ্তবাক্য দিয়া তো আর চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার ব্যাখ্যা হয়না। চিকিৎসদের ‘ভুল’-এর দাম অনেক বেশি।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/বিএ/জেআইএম