নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী এখানে আসেন একটু প্রশান্তির খোঁজে। কিন্তু প্রকৃতির খেলায় সেখানেই নিখোঁজ হয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে সৈকতটি। কিন্তু কী এক মায়াবি টানে নিষিদ্ধ সৈকতে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা।
Advertisement
সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বিকেলে বেড়াতে এসে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হন তিন তরুণ। ভাটার প্রচণ্ড টান থাকায় পানিতে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই তলিয়ে যান তারা। চট্টগ্রাম নগরের মোমিন রোড এলাকা থেকে পরিবারসহ ২৩ সদস্যের একটি দল বেড়াতে আসেন বাঁশবাড়িয়ার নিষিদ্ধ এ সমুদ্র সৈকতে।
স্থানীয়রা জানান, সেখানে আসার পর প্রথমে তারা খাওয়া-দাওয়া শেষ করেন। এরপর বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা ঘোরাফেরা শুরু করেন। একপর্যায়ে সাইফুল ইসলাম (২৫), আলাউদ্দিন (২৬) ও ইয়াছিন (১৮) নামের তিন তরুণ উত্তাল সাগরে গোসল করতে নামেন। স্থানীয়রা বাধা দিলেও তারা কর্ণপাত করেননি। সাগরে সে সময় চলছিল ভাটার টান। পানিতে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা তলিয়ে যান।
আরও পড়ুন >> সীতাকুণ্ডে সৈকতে গোসলে নেমে তিনজন নিখোঁজ
Advertisement
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিখোঁজ তিন তরুণের মধ্যে দু’জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা হলেন- সাইফুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন। শনিবার দুপুর ১টার দিকে মরদেহ দুটি উদ্ধার করা হয়। সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা মো. ওয়াশি আজাদ জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) শম্পা রানী সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিখোঁজ পর্যটকদের সমুদ্রে নামতে স্থানীয়রা নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তারা নিষেধ উপেক্ষা করে পানিতে নামেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডুবে যান।’
‘সমুদ্রে এতগুলো লাল ফ্ল্যাগ ও বিলবোর্ডে ‘অনুমতি ছাড়া সাগরের পানিতে নামা নিষেধ’ লেখা থাকলেও কেউ তা মানছেন না। এ কারণে সাগরের পানিতে হারিয়ে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা বেড়েই চলছে’- যোগ করেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতে এভাবে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার প্রাণহাণির ঘটনা ঘটেছে। মাত্র ১৫ দিন আগে গত ২১ জুন সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হওয়ার পর মরদেহ ভেসে ওঠে নারায়ণগঞ্জ থেকে বেড়াতে আসা সানারপাড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র নাজমুল হাসান ইমন (১৯) ও দশম শ্রেণির ছাত্র রাজের (১৬)। ওই সময় তাদের সঙ্গে ভেসে যাওয়া আরও সাত বন্ধু হোসেন (১৯), রবিন (১৯), সজীব ইসলাম (১৮), টুটুল (১৯), পিয়াল (১৬), হোসেন (১৭) ও আরিফুর রহমান (১৬) কোনো রকম প্রাণে রক্ষা পান।
Advertisement
সম্প্রতি এ দুই ঘটনাই শুধু নয়, এর আগেও এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে অভিশপ্ত এ সৈকতে। বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর জাগো নিউজকে জানান, দুই বছর আগেও এ সৈকতে তিন দর্শনার্থী নেমে ভেসে যান। পরে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরও আগে সৈকতে আরও একটি নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। পরে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এভাবে একের পর এক দর্শনার্থী নিখোঁজের ঘটনা ঘটলেও বেড়াতে আসা মানুষ প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সাগরে নামছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
গত ২১ জুন দুই শিক্ষার্থী নিখোঁজের পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ সমুদ্র সৈকত বন্ধের নির্দেশনা দেন। কিন্তু এখনও তা কার্যকর হয়নি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এ সৈকতে আসছেন। স্থানীয়রা জানান, গতকাল শুক্রবার তিন যুবক নিখোঁজের পরও দর্শনার্থীদের সৈকত থেকে সরানো যাচ্ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তারিকুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ২১ জুন একটি দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসন অবৈধ এ সৈকত বন্ধ করে দেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সৈকতে না নামার জন্য সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে দেয়া হয়। এরপরও মানুষ বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন না।’
‘সাগরে না নামার জন্য স্থানীয়রাও দর্শনার্থীদের বার বার নিষেধ করছেন। কিন্তু অতি উৎসাহী কিছু দর্শনার্থী কারও কথা কর্ণপাত না করে সৈকতে নেমে পড়ছেন। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে’- যোগ করেন তিনি।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, দায় এড়ানোর জন্য প্রশাসন এমন মন্তব্য করছেন। সৈকতে এখন হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, দেশি-বিদেশি মদ, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক। নির্বিঘ্নে সৈকতে বসে উঠতি বয়সী দর্শনার্থীরা সেগুলো সেবন করছেন। প্রশাসনের চোখের সামনে এমন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলেও তাদের তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।
আরও পড়ুন >> সাগরে নিখোঁজ দুই তরুণের মরদেহ উদ্ধার
স্থানীয়রা আরও জানান, ২০০৯ সালের দিকে এম এ কাসেম রাজা নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত অবৈধভাবে জবরদখল করেন। দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে তিনি ব্যাপক প্রচারণাও চালান। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মোহে দর্শনার্থীরাও এখানে আসতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং সৈকতে যেতে বাঁশের সেতু বানিয়ে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে ৩০ টাকা হারে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। এর বিনিময়ে দর্শনার্থীরা সৈকতে অবাধ যৌনাচার, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা ও দেশি-বিদেশি মদ সেবনের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে এ সৈকতে উঠতি বয়সী দর্শনার্থীদের ঢলও থাকে প্রচুর।
এ প্রসঙ্গে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘সৈকতে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা নেয়া হলেও তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সৈকতের বিপজ্জনক এলাকায় ব্যবহার করা হয়নি কোনো লাল সংকেত। কোনো নিরাপত্তা প্রহরীও এখানে নেই। অথচ সৈকত থেকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা উপার্জিত হচ্ছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা জাফর আলম অভিযোগ করেন, ‘সৈকত থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে সমুদ্রের বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে সৈকতে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়ে একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। জোয়ার এলে এসব গর্ত পানিতে তলিয়ে যায়। এসব গর্তে পড়েই দর্শনার্থীরা মারা যাচ্ছেন।’
‘এর আগের প্রায় সবকটি ঘটনা একই স্থানে ঘটেছে’- বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা মো. ওয়াশি আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাঁশবাড়িয় সমুদ্র সৈকতটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এ সৈকতের গভীরতা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই কারও। ফলে এখানে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।’
‘সৈকতটি সত্যিই বিপজ্জনক। এ কারণে এখানে গোসল করতে না নামাই নিরাপদ।’
এমএআর/এমআরএম/আরআইপি