দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী শোলাকিয়া জঙ্গি হামলা মামলার দুই বছর পূর্ণ হবে ৭ জুলাই আগামীকাল শনিবার। তবে দীর্ঘ সময়েও চাঞ্চল্যকর এ মামলার আদালতে অভিযোগপত্র দিতে পারিনি পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা বদলের পর মূলত অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে মামলার তদন্ত কার্যক্রম।
Advertisement
হলি আর্টিজান হামলায় গ্রেফতার কয়েকজন জঙ্গিকে শোলাকিয়া হামলায় ‘শ্যোন এরেস্টে’ দেখানো ছাড়া এ মামলায় পুলিশের তেমন কোনো সাফল্য নেই। এমন কি ‘শ্যোন এরেস্টে’ দেখানো ৪ আসামির মধ্যে মাত্র একজন এ পর্যন্ত আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
পুলিশের মতে, শোলাকিয়া হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে চিহ্নিত ১০ আসামির মধ্যে ৫ জনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। তবে পুলিশ বলছে, বর্তমানে এ মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ দিকে। দ্রুত চার্জশিট দেয়া হবে।
অপরদিকে দুই বছর হয়ে গেলেও এখনও আতঙ্কে আছেন শোলাকিয়া ঈদগাহের আশপাশের বাসিন্দারা। বিশেষ করে ঈদু-উল-ফিতরের দিন সবার মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক বিরাজ করে। আর তাই গত ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহ ও আশপাশের এলাকায় নেয়া হয় নজিরবিহীন ৪ স্তরের নিরাপত্তা।
Advertisement
২০১৬ সালের ৭ জুলাই। সেদিন ছিল ঈদ-উল-ফিতর। ভোর থেকে লাখো মানুষের ঢল ছিল শোলাকিয়া ঈদগাহের দিকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত। কিন্তু, সকাল পৌনে ৯টার দিকে হঠাৎ করেই জঙ্গিদের গুলি আর বোমায় কেঁপে উঠে ঈদগাহের পাশে চর শোলাকিয়া এলাকা। পুলিশের সঙ্গে শুরু হয় জঙ্গিদের বন্দুকযুদ্ধ। মুহূর্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ঈদ জামাত শুরু হওয়ার কিছু আগে শোলাকিয়া ঈদগাহের কাছে আজিমউদ্দিন হাইস্কুল সংলগ্ন রাস্তায় মুফতি মুহাম্মদ আলী মসজিদের কাছে পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে অতর্কিত হামলা চালায় অস্ত্রধারী জঙ্গিরা। ঈদের খুশির দিনের বোমা আর গুলির শব্দে কেঁপে উঠে শোলাকিয়া ময়দানের আশপাশ। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ হয়।
এসময় জঙ্গিরা জবাই করে হত্যা করে পুলিশের দুই কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম ও আনসারুল হককে। আহত হয় পুলিশের অন্তত ৮ সদস্য। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলে নিহত হয় আবির রহমান নামে এক জঙ্গি। আহত অবস্থায় আটক করা হয় শফিউল ইসলাম ডন নামে এক জঙ্গিকে। পরে সেও মারা যায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে। একই সময় ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় জাহিদুল হক তানিম নামে স্থানীয় এক যুবককে। ঘটনার সময় নিজের ঘরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন গৃহবধূ ঝর্ণা ভৌমিক। শোলাকিয়া মাঠের কাছেই এ হামলা হলেও লাখ লাখ মুসল্লির জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে গোপন রাখা হয় হামলার বিষয়টি। সকাল ১০টায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে শেষ করা হয় ঈদের জামাত।
সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা : শোলাকিয়া হামলার ঘটনায় ২০১৬ সালের ১০ জুলাই নিরাপত্তা চৌকির দায়িত্ব পালনকারী পাকুন্দিয়া থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সামসুদ্দীন বাদী হয়ে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। আটক জাহিদুল হক তানিম ও শীর্ষ জঙ্গি শফিউল ইসলাম ডনসহ অজ্ঞাতনামা জঙ্গিদের এ মামলার আসামি করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় হামলার সময় বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছাড়াই সিভিল পোশাকে জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়া ওই সময়ের কিশোরগঞ্জ মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মুর্শেদ জামানকে।
হলি অার্টিজান থেকে শোলাকিয়া : চাঞ্চল্যকর শোলাকিয়া জঙ্গিহামলা মামলার প্রাথমিক তদন্তেই বেরিয়ে আসে ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। হামলায় অংশগ্রহণকারী একই জঙ্গিগ্রুপ। আর তাদের উদ্দেশ্য ছিল একই।
Advertisement
জানা গেছে, রংপুরে জাপানি নাগরিক হোসিও কুনিও ও ধর্মান্তরিত রহমত আলী, পঞ্চগড়ের যজ্ঞেশ্বর পুরোহিত, কুড়িগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী, গাইবান্ধার তরুণ দত্ত, দেবেশ ও ফজলে রাব্বী, টাঙ্গাইলের দর্জি নিখিল, পাবনার নিত্যানন্দ পান্ডব, নাটোরের সুনীল গোমেজ, কুষ্টিয়ার ডা. সানাউল, রাজশাহীর প্রফেসর রেজাউল ও ঢাকার সিজার তাবেলা হত্যাকান্ডসহ জেএমবির সদস্যরা সারাদেশে আরও ২৪ জনকে হত্যা করে।
শোলাকিয়ার নেতৃত্ব ছিল রাজীব গান্ধীর হাতে : শোলাকিয়া হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন রাজীব গান্ধী। তাকে সামনে রেখে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী, মারজান, সারোয়ান জাহান মানিক ও মেজর জাহিদ হামলার ছক তৈরি করে। হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল, ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম ফরিদ উদ্দিন মাউসদসহ মাঠের শত শত মুসল্লিকে হত্যা করে সরকারের পতন ঘটানো। সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেদের হুকুমত কায়েমের জন্য জঙ্গিরা ঢাকায় দু’দফা বৈঠক করে হলি অার্টিজান ও শোলাকিয়া হামলার ছক চূড়ান্ত করে। ওইসব হত্যার ঘটনায় যারা জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে থেকে সারাদেশে সিরিজ হত্যাকাণ্ডে সফল সাহসী সদস্যদের হলি আর্টিজান এবং শোলাকিয়ায় হামলার দায়িত দেন রাজীব গান্ধী। খায়রুল ইসলাম পায়েল বাধন, শফিউল ইসলাম ডন, রোহান ইমতিয়াজ স্বপন ও নির্বাস চৌধুরী, মোবাস্সের হোসেন, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও আবির রহমানকে হামলার দায়িত্ব দেয়া হয়।
হামলাকারীদের ৫ জনই নিহত বন্দুকযুদ্ধে : হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়া হামলায় অংশ নেয়া তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জে, মেজর জাহিদ ঢাকার রূপনগরে, আকাশ গাজীপুরের পাতারটেকে ও শফিফুল ইসলাম ওরফে ডন ময়মনসিংহের নান্দাইলে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে মারা যায়। এর আগে শোলাকিয়া হামলায় অংশ নেয়া আবির রহমান পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। সে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার ত্রিবিদ্যা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে। আবির ঢাকায় নর্থ- সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র ছাত্র ছিল। এদিন পুলিশের গুলিতে আহত আরেক জঙ্গি শফিউল ইসলামকে (ডন) ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট র্যাবের একটি দল ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ নিয়ে আসার পথে নান্দাইলে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে র্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধে’র সময় শফিউল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। সে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট এলাকার আব্দুল হাইয়ের ছেলে। পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে তাকে কিশোরগঞ্জে আনা হচ্ছিল।
মামলার সর্বশেষ অবস্থা : বর্তমানে এ মামলায় কারাগারে আছেন জেএমবির শীর্ষ নেতা মাস্টারমাইন্ড রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, অনোয়ার হোসেন, সোহেল মাহমুদ ও জাহিদুল হক তানিম।
তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য : ঘটনার এক বছর পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মুর্শেদ জামান অন্যত্র বদলি হওয়ায় মামলার আইও বদল করা হয়। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় কিশোরগঞ্জ মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আরিফুর রহমানকে। মূলত আইও বদলের পর থেকেই থমকে যায় মামলার তদন্ত। আইও পরিবর্তনের পর এ মামলায় নতুন কাউকে গ্রেফতার কিংবা মামলার কোনো নতুন ক্লু উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান জানান, মামলার তদন্ত কাজ প্রায় শেষের দিকে। অচিরেই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর এ মামলার চার্জশিট দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জেলা পুলিশকে তাগাদা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এখনও তদন্ত শেষ করতে পারছে না পুলিশ।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মাশরুকর রহমান খালেদ বিপিএম বলেন, এটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। দেশের দুটি আলোচিত হামলায় একই গোষ্ঠী জড়িত। এ ঘটনায় জড়িত জঙ্গিদের মধ্যে ৫ জন এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। তবে হামলায় অস্ত্র ও অর্থের জোগানদাতাদের চিহ্নিত করতে তদন্ত বিলম্ব হচ্ছে জানিয়ে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার বলেছেন, হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং খুব শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে।
এমএএস/পিআর