খেলাধুলা

বারুদের নয়, যে যুদ্ধ ছড়াবে ফুটবলের গন্ধ

রাশিয়ার তাতারস্থান প্রজাতন্ত্রের নামের সঙ্গে কেমন যেন যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ। বহুবছর আগের সেই যুদ্ধের গন্ধটা নতুন করে ছড়াচ্ছে তাতারস্থানের রাজধানী কাজানে। তবে সে গন্ধ গোলাবারুদের নয়, অনিন্দ্য সুন্দর ফুটবলের।

Advertisement

রাশিয়ার ক্রীড়া রাজধানীর খ্যাতি পাওয়া কাজান শহরের প্রতিটি ইট-পাথরের টুকরোও এখন যেন কথা বলে ফুটবলের সঙ্গে। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কান পাতলেই যেন একটাই শব্দ ভেসে আসে ‘ফুটবল’।

এখানে যুদ্ধ হবে। যুদ্ধের জন্য দুই দল সৈন্য তাবু গেড়েছে এই শহরের বুকে। তাদের এই যুদ্ধটা বেধে যাবে রেফারির বাঁশিতে। সৌন্দর্য্যের সে যুদ্ধ দেখতে পুরো বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে তাতারস্থানের রাজধানীর দিকে।

ভোলগা আর কাজানাক নদীর মিলনস্থলের এ শহর ছেড়ে একটু বাইরে গেলেই মাইলের পর মাইল ফসলী জমি। কোথাও সবুজে ভরপুর, কোথায় হলুদে ঢাকা মাঠ। ফাঁকে ফাঁকে বন-বনাঞ্চল। বিস্তৃণ এলাকাজুড়ে সেই নানা রঙ্গের মাঝ থেকে আজ কারা যেন শুধু হলুদটাই তুলে আনবেন কাজান এরেনার জন্য। দুপুরের পর থেকে বিশ্বকাপের অন্যতম এ ভেন্যুতে হলুদের ঢেউ খেলবে।

Advertisement

বিশ্বকাপ ও হলুদের ঢেউ-কোথাও যেন মিলে যাচ্ছে। অনেকেই মিলিয়েও নিয়েছেন। হ্যা; বিশ্বকাপ, ফুটবল, হলুদ ঢেউ-এ সবের সঙ্গে যায়তো একটি নাম ‘ব্রাজিল’। সেই ব্রাজিলই যে হলুদের ঢেউ খেলাতে নামবেন রাশিয়ার ষষ্ঠ সর্বাধিক জনবহুল এ শহরে।

রোস্তভ এরেনা, সেন্ট পিটার্সবার্গ, স্পার্টাক স্টেডিয়ামের পর সামারা এরেনায় হলুদের ঢেউ খেলিয়েছেন নেইমাররা। যে শহরের সঙ্গে খেলাধুলার ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে সেই কাজানও চাইবে তার বুকে ফুটবলের ফুল ফোটাক ব্রাজিল। আর্জেন্টিনা এই শহর থেকে দেশের টিকিট ধরেছে ফ্রান্সের কাছে হেরে। এখান থেকেই জার্মানিকে বিদায় করে দিয়েছে এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। সাবেক-বর্তমান দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে ছুটি দেয়া শহরেই এখন নেইমারদের পরীক্ষা।

শুধু পরীক্ষাই নয়, কঠিন পরীক্ষা। ব্রাজিলের সামনে সে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নাম ‘বেলজিয়াম’। ল্যাটিন ফুটবলের চিরায়িত ছন্দের অন্যতম ধারক ব্রাজিলকে পরীক্ষা দিতে হবে ইউরোপের গতিময় ফুটবলের সোনালী প্রজন্ম বেলজিয়ামের কাছে। ৯০ মিনিট, ১২০ মিনিট কিংবা টাইব্রেকার-যেখানেই শেষ হোক পরীক্ষা তার সনদ লুকিয়ে বসে আছে নিয়তি। যে নিয়তির নাম কাজান এরেনা।

যুদ্ধ মানেই ঢাল-তলোয়াড়। এক সময় ফুটবলযুদ্ধে ঢালকে পাত্তাই দিতো না ব্রাজিল। কী নিজের দলের, কী প্রতিপক্ষের। ব্রাজিলের ফুটবল মানেই ধারালো তলোয়ার। হালে সেই নীতিতে বদল এনেছে সাম্বার দেশ। আক্রমনের রংধনু থেকে কিছু রং খসিয়ে লেপে দিয়েছে রক্ষণ দেয়ালে। ব্রাজিলের ফুটবল মানেই এখন শুধু ছন্দ আর আক্রমন নয়, দূর্গ রক্ষাও বড় মন্ত্র।

Advertisement

কোচ তিতের সাম্রাজ্য আলাদা করে সাজানো। অন্য থিঙ্ক ট্যাংকদের চেয়ে তার রণকৌশলটা একটু ভিন্ন। রণাঙ্গনের নেতা তার একাধিক। ম্যাচে ম্যাচে নেতা বদল আর মাঠে ক্ষণেক্ষণে রংবদল তিতের এক নতুন ধাঁধা। সে গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেয়েছে কোস্টারিকা, সার্বিয়া ও মেক্সিকো। তিতে হয়তো এমন কিছু মস্তিস্কে লুকিয়ে রেখেছেন যা দিয়ে বিদায় করে দেবেন বেলজিয়ামকে।

তিতের এক হাতে নেইমার, উইলিয়ান, জেসুস, কৌতিনহো, পাউলিনহো নামের তলোয়ার। অন্য হাতে থিয়েগো সিলভা, মিরান্দা, মার্সেলো ও ফ্যাগনারদের মতো ঢাল। সবার শেষে গোলপোস্টের অতন্ত্র প্রহরী অ্যালিসন। বেলজিয়ামের রক্ষণকে কচুকাটার মতো অস্ত্র তিতের থাকলেও কম নেই বেলজিয়ামেরও। রোমেলু লুকাকু, ইডেন হ্যাজার্ড, মারুয়ানে ফেলাইনি ও আদনান জানুজাইরা ইতিমধ্যেই জানান দিয়েছেন তাদের রুখতে বাড়তি দক্ষতা লাগবে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের।

ফ্রান্স ও উরুগুয়ের মধ্যে রাশিয়া বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার প্রথম লড়াইটি শুরুর আগে কাগজ-কলমে পাবে সেরার স্বীকৃতি। সাবেক দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের লড়াই বলে কথা। কিন্তু জনতার সেরা ব্রাজিল-বেলজিয়াম ম্যাচ। খেলায় যে দলই জিতুক, ম্যাচ শুরুর আগে কাজান এরেনাই থাকবে বিশ্বজুড়ে আগ্রহ আর আলোচনার শীর্ষে। সে আলোচনা ও আগ্রহের প্রধান কারণ যে ‘ব্রাজিল’ তা বুঝতে ফুটবল বোদ্ধা হতে হবে না কারো।

সব বিশ্বকাপেই ‘নাম্বার ওয়ান ফেভারিট’ ব্রাজিল। বেলজিয়ামের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালেতো অবশ্যই। কিন্তু হলুদ সমর্থকদের একটা ভয়ও আছে। কাজান এরেনা যে ‘আজরাইলে চিনে গেছে।’ যে আজরাইলের নাম ‘জায়ান্ট কিলার’। আর্জেন্টিনা ও জার্মানিকে বিদায় করা ‘ভয়ঙ্কর’ এ ভেন্যু কী সাজিয়ে রেখেছে তার অন্তরে তা দেখা যাবে বাংলাদেশ সময় গভীর রাতে।

ভাগ্যের শিকে যাদেরই ছিড়–ক-যুদ্ধটা হবে হাড্ডা-হাড্ডি। ফুটবল পন্ডিতরা সে আভাসই দিচ্ছেন। তবে তাতারস্থানের রাজধানীতে সে যুদ্ধ বারুদের নয়, ছড়াবে ফুটবলের গন্ধ। আর ফুটবল বিশ্বের বেশিরভাগ দর্শকই চাইবে কাজানের বাতাসে যেন মিলিয়ে যায় সরষে ফুলের ঘ্রাণ। যে ঘ্রাণ মিলিয়ে যাবে কাজান থেকে পুরো রাশিয়ায়। রাশিয়া থেকে গোটা দুনিয়ার বাতাসে।

আরআই/এসএএস/এমএস