মতামত

খাবারে ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাট নিয়ে কী ভাবছি আমরা?

হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং স্মৃতি হারানোর মতো বিপদজনক রোগ সৃষ্টিতে ট্রান্স ফ্যাটের ক্ষতিকর প্রভাব এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ট্রান্স ফ্যাট কৃত্রিমভাবে তৈরি হয় ; যা শরীরে খারাপ চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং সেই সাথে ভালো চর্বির পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে রক্তনালীতে জমা হয়ে তা রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ। কৃত্রিম ট্রান্সফ্যাট হচ্ছে এমন এক ধরনের চর্বি যা ভেজিটেবল অয়েল যেমন পাম, সয়াবিন প্রভৃতি থেকে তৈরি হয়। এসব ভেজিটেবল অয়েলে “হাইড্রোজিনেশান” বা হাইড্রোজেন আয়ন যুক্ত করলেই তা ট্রান্স ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়।

Advertisement

কৃত্রিম ট্রান্সফ্যাটের ক্ষতিকর প্রভাব প্রমাণিত হওয়ার পর থেকে আমেরিকাতে তা নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হয়ে উঠছিলো। সেই দাবির প্রেক্ষিতে ১৭ জুন, ২০১৮ সোমবার আমেরিকাতে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ হলো কৃত্রিমভাবে তৈরি ট্রান্স ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার । যদিও ২০০৭ সালেই প্রথম দেশ হিসেবে ডেনমার্ক সেদেশে এ জাতীয় খাবার তৈরি এবং বিক্রিতে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

অবশ্য এফডিএ ( ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্টেশন, আমেরিকা) ২০০৬ সালে খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট থাকলে তা ঐ খাবারে কি পরিমাণে আছে সেটা উল্লেখ করতে খাদ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো নির্দেশনা প্রদান করে। এর নয় বছর পর ২০১৫ সালে এফডিএ মতামত প্রদান করে যে, ট্রান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার শরীরের জন্য অনিরাপদ। তাই ২০১৮ সালের জুনের ভেতরে এ ফ্যাট খাবার থেকে বাদ দিতে খাবার প্রস্তুতকারক কোম্পানি গুলো সময়সীমা বেঁধে দেয়।

জুন মাসেই সে সময়সীমার মেয়াদ শেষ হতে না হতেই এফডিএ’র নির্দেশনার মাধ্যমে আমেরিকাতে ট্রান্স ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার তৈরি এবং বিক্রি চূড়ান্তভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে গেলো। সে নির্দেশনায় খাবার প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি রেস্তোরাঁ এবং মুদি দোকানগুলোকেও এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

Advertisement

ফলে খাবার প্রস্তুতকারক কোম্পানি, বেকারি এবং রেস্তোরাঁতে তৈরি বিস্কিট, কেক, পপকর্ন, চিপস, পেস্ট্রি, হিমায়িত পিজাসহ অন্যান্য যে সকল খাবার তৈরিতে এতদিন কৃত্রিম ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার করা হতো সেগুলোতে এখন থেকে আর এ ফ্যাট আর ব্যবহার করা যাবে না । একই সাথে বাজারে এরই মধ্যে যে সকল ট্রান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার চলে এসেছে এক বছরের মধ্যে সেগুলোর বিক্রি শেষ করতেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর এই এক বছরের মধ্যে খাবার প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে কৃত্রিম ট্যান্স ফ্যাটের বিকল্প অনুসন্ধানে মনোযোগী হওয়ারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এফডিএর এমন নির্দেশনার পরে জনস্বার্থ সম্পর্কিত অলাভজনক বিজ্ঞান কেন্দ্রের ( Nonprofit Center for Science in the Public Interest) প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক মাইকেল এফ জ্যাকবসন বলেন,’খাবার থেকে কৃত্রিম ট্রান্স ফ্যাট বাদ দেয়ার এ নির্দেশনা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঐতিহাসিক এবং দীর্ঘ আন্দোলনের বিজয়’।

আমাদের দেশে এখন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। অসংক্রামক এসব রোগে এখন মৃত্যুর হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

তাছাড়া এসব রোগ হলে যেহেতু জীবনভরই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয় ফলে অনেক পরিবার সে ব্যয় আর বহন করতে পারে না। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা বন্ধ করলেই বা চিকিৎসাতে গাফিলতি হলেই মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়। ফলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়।

এ কারণে ট্রান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়ার ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করতে হবে। সেই সাথে খাবার প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকেও এ ব্যাপারে গাইডলাইন দিতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করতে হবে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে ওঠা এসব খাবার বাজারজাত পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করার জন্য।

Advertisement

জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বিবেচনায় ডেনমার্ক, আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলো কৃত্রিম এ ট্রান্স ফ্যাটের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। এ ব্যাপারে আমাদের নীতিনির্ধারকরা ঠিক কী ভাবছেন সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। আদৌ এ ব্যাপারে আমরা তেমন অবগত আছি কিনা সেটাই আমরা জানি না।

যদি অবগত থেকে থাকি তাহলে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার উৎপাদন, বাজারজাতকরণ বন্ধে আমাদের করণীয় এখনই নির্ধারণ করতে হবে। না হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব আরো বিস্তার লাভ করবে। তরুণ প্রজন্মের জন্য তা দারুণ ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। ফাস্টফুড, কেক, পেস্ট্রি এসবে ক্ষতিকর এ ট্রান্সফ্যাট খুব বেশি ব্যবহার করা হয়। কারণ এতে খাবার সুস্বাদু হয়। আমাদের দেশে তরুণ প্রজন্মের কাছে ফাস্ট ফুডের ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাই জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় খুবই উদ্বেগের বিষয়। জনস্বার্থ বিবেচনায় আমেরিকা, ডেনমার্ক ট্রান্স ফ্যাট বন্ধে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণ করতে তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে কি?

লেখক : শিক্ষক, চিকিৎসক।

এইচআর/আরআইপি