বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের কারণে সন্তানদের যে মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা নিয়ে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বলেন, প্রতিটি বিবাহবিচ্ছেদে সন্তানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের সবার অনুভূতি হয় একই রকম।
Advertisement
মাগুরার এক দম্পতির বিচ্ছেদের ঘটনায় তাদের দুই শিশু সন্তানকে বুধবার আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে শুনানিতে আদালত এই মন্তব্য করেন। আদালতে আজ বাবার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তাপস কান্তি বল। অন্যদিকে, মায়ের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।
স্ত্রীর পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকে আদালতে বাবা-মাসহ বাচ্চা দুটি উপস্থিত ছিল। আদালত আমাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন তাদের দুজনের পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কত দূর। আমরা বলেছি যে আর একটু সময় যদি আপনারা দেন, তাহলে আমি সন্তানের মায়ের পক্ষ থেকে বলেছি, মা ইতিবাচক আছেন।
অন্য দিকে, স্বামীর পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপক বলও জানান, সন্তানের ভালোর জন্য তিনি মেনে নেবেন। আমাদের এ বক্তব্য আদালত শুনে আগামী ১ আগস্ট পরবর্তী তারিখ রেখেছেন।
Advertisement
বিবাহবিচ্ছেদের কারণে বাবার হেফাজতে থাকা সন্তানদের নিজ হেফাজতে নিতে মায়ের পক্ষে করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৯ মে হাইকোর্ট এক রুল জারি করেন। এতে দুই শিশুকে আদালতে হাজির করতে বলা হয়। হাইকোর্টের এই আদেশ অনুযায়ী গত ২৫ জুন মাগুরা জেলা পুলিশ দুই শিশুকে আদালতে হাজির করা হয়। প্রায় ১৩ মাস পর (২৫ জুন) সেদিন মায়ের দেখা পায় তার দুই সন্তান। মা-ও দেখেন দুই সন্তানকে।
আদালতে বিচারক ও আইনজীবীর সঙ্গে উপস্থিত বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছিল দুই ছেলে। সবার চোখে ছিল ছলছল পানি। আদালতের ভেতরে সেইক্ষণের পরিবেশ ছিল ভারি হয়ে ওঠে। সন্তানরাও যে মা-বাবাকে এমন কড়া শাসন করতে পারে এই ঘটনা না দেখলে কারও বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়।
মা-বাবার সঙ্গে পরিবার নিয়ে প্রথমে ঢাকায় বসবাস করলেও ২০১৭ সালের মে’তে বিবাহবিচ্ছেদ (ডিভোর্স) হওয়ার পর বাবা দুই ছেলেকে মাগুরায় ফুফুর কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে লেখাপড়া করানোর জন্য তাদের দুই ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। এদিকে, বিচ্ছেদ হওয়ার পর মায়ের ঠিকানা হয় ঢাকার মোহাম্মদপুরে। অন্যদিকে, বাবার ব্যবসার দেখাশোনা করার সুবাদে বসবাস উত্তরায়।
হাইকোর্টের নির্দেশনাই আদালতে উপস্থিত হয়ে বাবা-মায়ের সংসার জোড়া লাগাতে ১২ বছরের শিশু ধ্রুব ও ৯ বছরের শিশু লুব্ধ অঝোরে কাঁদছে। তাদের কান্নায় সঙ্গী হন উপস্থিত সবাই। তাইতো তাদের কান্না দেখে এজলাস কক্ষে কাঁদলেন স্বয়ং বিচারপতি ও উপস্থিত শতাধিক আইনজীবী এবং সাংবাদিকরাও।
Advertisement
২৫ জুন সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ দৃশ্যের অবতারণা হয়।
সকালে এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। শুনানির এক পর্যায়ে শিশু দুটির বক্তব্য শুনতে চান আদালত। দুই শিশুর মধ্যে বড়জন সালিম সাদমান ধ্রুব আদালতকে বলেন, আমরা আর কিছু চাই না, বাবা-মাকে একত্রে দেখতে চাই।
শিশু দু’টির বক্তব্য শুনে আদালত ফের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনেন। এ সময় মায়ের পক্ষের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতকে বলেন, একটা বছর ধরে মা তার সন্তানকে দেখতে পাচ্ছেন না। আজকে যখন কোর্টে হাজির করা হয়েছে তখনও শিশুর ফুফু মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বাধা দিয়েছে। এ সময় তিনি সন্তানদের সঙ্গে মায়ের কথা বলার সুযোগ চান।
পরে আদালতের অনুমতি পেয়ে ছেলেদের কাছে এগিয়ে যেতেই মা দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেন। এ সময় ছেলেরাও দীর্ঘদিন পর মাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। বড় ছেলে তখন হাত বাড়িয়ে বাবাকেও ডাকতে থাকে।
ছেলে বলতে থাকে, বাবা, তুমি এসো। তুমি আমার কাছে এসো। আম্মুকে সরি বলো। এ সময় বাবাও এগিয়ে এলে আদালতের ভেতর এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। বাবা-মা এবং তাদের সন্তানদের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য দেখে বিচারক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সবার চোখে পানি চলে আসে। দীর্ঘ এক বছর পর বাবা-মাকে একসঙ্গে পেয়ে ছেলেদের কান্না সবার বিবেককে নাড়া দেয়।
এ সময় আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক আবার ওই শিশুদের ডেকে নেন। সঙ্গে মাকেও কাছে ডাকেন। আদালত বলেন, এ দৃশ্য দেখেও কি আপনাদের মন গলে না? আপনারা কি সন্তানের জন্যও নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না? সামনে তাকিয়ে দেখেন, আপনাদের এ দৃশ্য দেখে সবার চোখেই পানি চলে আসছে।
এ সময় আদালতে উভয়পক্ষের আইনজীবীসহ শতাধিক আইনজীবী দাঁড়িয়ে সমস্বরে সন্তানদের বিষয়টি চিন্তা করে বাবা-মাকে মেনে নেয়ার দাবি জানান। একই সঙ্গে সন্তানদের চাওয়া অনুযায়ী তাদের দাম্পত্য জীবন যাতে বজায় থাকে এ সেরকম একটি আদেশ দেয়ার দাবি জানান।
পরে আদালত দুই শিশু এবং তাদের বাবা-মা, নানি ও ফুফুকে আদালতের এজলাসের কাছে ডেকে নেন। একে একে প্রত্যেকের বক্তব্য শোনেন। পরে বিস্তারিত জানতে চেম্বারে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় বাবা ও মাকে।
ওইদিন আদালত আদেশে বলেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত শিশু দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এই সময়ে বাবা শিশুদের দেখাশোনা করার সুযোগ পাবেন। ৪ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে শিশু দুটিকে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি মুলতবি করেন।
এফএইচ/জেডএ/এমএস